সেনাসমর্থিত ইউএসডিপির একতরফা জয়ের আভাস, বাধ্য করার অভিযোগ
সোমবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৫ ২:৩৩ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
টানা পাঁচ বছর পর জাতীয় নির্বাচনের মুখ দেখল মিয়ানমার। তবে ২০২০ সালের নির্বাচনের মতো কোনো উৎসবমুখর পরিবেশ ছিল না। আতঙ্ক, চাপ ও সেনা নজরদারির মধ্যেই শেষ হয়েছে সামরিক জান্তার আয়োজিত প্রথম দফার ভোটগ্রহণ। ভোটকেন্দ্রগুলোতে ছিল না সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি; বরং ভয় দেখিয়ে ভোট দিতে বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছে জান্তার বিরুদ্ধে।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ইরাবতী, বিবিসি ও রয়টার্স জানায়, ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই কম। যারা ভোট দিয়েছেন, তাদের বড় একটি অংশ সরকারি চাকরিজীবী—উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ও শাস্তির ভয়ে কেন্দ্রে যেতে বাধ্য হয়েছেন তারা। ভোটকেন্দ্র ও আশপাশে উর্দিবিহীন সেনাসদস্য মোতায়েন ছিল, যারা নজরদারি করেছে কে ভোট দিচ্ছে আর কে দিচ্ছে না।
রোববার মান্দালয় শহরের ৪২ বছর বয়সী সরকারি কর্মচারী ওয়াই ইয়ান অং জানান, নিজের ইচ্ছায় নয়, বরং বাধ্য হয়েই তিনি ভোট দিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমাদের জানানো হয়েছে, কে ভোটে অংশ নিয়েছে তা যাচাই করা হবে। আমার মতো মানুষের জন্য এটি কোনো পছন্দের বিষয় নয়।”
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর মতে, ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার লক্ষ্যে এই নির্বাচন আয়োজন করেছে জান্তা সরকার। সরকারি চাপ, নজরদারি, গ্রেপ্তার ও শাস্তির আশঙ্কায় অনেক ভোটার কেন্দ্রে যেতে বাধ্য হলেও সামগ্রিক উপস্থিতি ছিল ‘হাতে গোনা’। এএফপি ও আল-জাজিরা জানায়, শহরাঞ্চলে ভোটের আগের রাত থেকেই ভোটকেন্দ্র ঘিরে রাখা হয় এবং সড়কের মোড়ে মোড়ে মোতায়েন ছিল সশস্ত্র পুলিশ।
চলতি বছরের জুলাইয়ে জান্তা সরকার ‘নির্বাচন সুরক্ষা আইন’ পাস করে। ওই আইনে নির্বাচনবিরোধী সমালোচনাকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ভোট বর্জনের আহ্বান জানালে এক বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এই আইনে এখন পর্যন্ত অন্তত ৩২৯ জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
ইয়াঙ্গুন শহরের ৪১ বছর বয়সী খুচরা দোকানি নিলার নয়ে বলেন, “না চাইলেও সবাই জানে ভোট দিতে আসতেই হবে।” তার ভাষায়, ভোট না দিলে শাস্তির আশঙ্কা থেকেই যায়।
এবারের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করা হয়েছে। তবে এসব মেশিনে নিজের পছন্দমতো নাম লেখার সুযোগ নেই এবং ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যালট বাতিল করার কোনো ব্যবস্থাও রাখা হয়নি—যা নির্বাচনটির স্বচ্ছতা নিয়ে নতুন প্রশ্ন তুলেছে।
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করার পর এটিই প্রথম সাধারণ নির্বাচন। রোববার সকাল ৬টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ চলে। ইয়াঙ্গুন ও মান্দালয়ের মতো বড় শহরগুলোতে তরুণ ভোটারদের উপস্থিতি ছিল অত্যন্ত কম; ভোট দিতে আসা অধিকাংশই মধ্যবয়সী বা প্রবীণ।
ইয়াঙ্গুনের একটি ভোটকেন্দ্রে প্রায় ১ হাজার ৪০০ নিবন্ধিত ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন মাত্র ৫০০ জন। স্থানীয় এক যুবক বলেন, “মানুষ এই নির্বাচনের ন্যায্যতায় বিশ্বাস করে না। কেউই এই বিশৃঙ্খলার অংশ হতে চায় না।”
জাতিসংঘের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি টম অ্যান্ড্রুজ এই সামরিক-পরিচালিত নির্বাচন প্রত্যাখ্যানের আহ্বান জানিয়ে বলেন, “জান্তা বেসামরিকদের ওপর বোমা ফেলছে, রাজনৈতিক নেতাদের কারাবন্দি করছে এবং সব ধরনের ভিন্নমতকে অপরাধে পরিণত করেছে। এটি কোনো নির্বাচন নয়—এটি বন্দুকের মুখে মঞ্চস্থ একটি প্রহসন।”
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক প্রধান ভলকার তুর্কও বলেন, মিয়ানমারে মতপ্রকাশ, সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতার কোনো পরিবেশ নেই। সাধারণ মানুষ একদিকে সেনাবাহিনী, অন্যদিকে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর বর্জন-হুমকির মধ্যে চরম চাপে রয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, সেনাসমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) এই নির্বাচনে বিজয়ী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। অন্তত ৩১ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে পারেন, যাদের মধ্যে ২৬ জনই ইউএসডিপির।
আগামী ১১ জানুয়ারি ও ২৫ জানুয়ারি আরও দুটি দফায় ভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। তবে ফলাফল ঘোষণার কোনো নির্দিষ্ট সময় এখনো জানায়নি জান্তা সরকার।
১২১ বার পড়া হয়েছে