সর্বশেষ

মতামত

চট্টগ্রাম বন্দর: বিশেষ সুবিধা, দুর্নীতি ও বিদেশি লিজ-বাংলাদেশের স্বার্থ কোথায়?

মনজুর এহসান চৌধুরী
মনজুর এহসান চৌধুরী

সোমবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৫ ২:২৩ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ঘটা করে দেশের প্রধান দুটি সমুদ্রবন্দর—চট্টগ্রাম ও ঢাকার পানগাঁও—সহ কয়েকটি বস্তুত গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ৩০ বছরের জন্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে লিজ দেওয়ার চুক্তি করেছে।

এ নিয়ে দেশে বিস্তর বিতর্ক ও বিরোধিতা চলছে। অন্যদিকে, গত এক যুগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেশের বন্দর, অবকাঠামো ও সংলগ্ন খাত গুলোতে নানা অনিয়ম, অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতি বছরের পর বছর ধরে বিদ্যমান। আর এসব কারণেই দেশে বহু সুবিধাভোগী শক্তি গড়ে উঠেছে, যারা রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা নিয়ন্ত্রণে অব্যস্ত। প্রতিবেদনটি এই প্রেক্ষাপট ও অতীত-বর্তমান সুবিধা ও ঝুঁকি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছে।

অতীত: ভারতের জন্য উন্মুক্ত বন্দর, পারস্পরিক ‘সহজ সুবিধা’
২০০৯ সালের পর থেকে শেখ হাসিনা সরকারের সময় বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, মোংলা ও পরে পায়রা বন্দর ভারতীয় বাণিজ্য-পরিবহনের জন্য খুলে দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের চুক্তির সূত্রে ভারত স্থায়ীভাবে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের মাধ্যমে উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়সহ বিভিন্ন রাজ্যে পণ্য পরিবহনের সুযোগ পায়। ভারতীয় পণ্যবাহী জাহাজ ও ট্রান্সশিপমেন্ট কার্যক্রমে অগ্রাধিকার ভোগ করে এবং সংযুক্ত নদী, রেল ও সড়কপথে পূর্ণ সুবিধা নিশ্চিত হয়। এই চুক্তিতে ভারতীয় পণ্যের জন্য ট্রানজিট ও আন্তঃদেশীয় পরিবহন খরচ নামমাত্র নির্ধারণ করা হয়—যা পার্শ্ববর্তী প্রতিযোগী দেশের তুলনায় অত্যন্ত সুবিধাজনক। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে নতুন নদীপথ ও নতুন রেল সংযোগ (আখাউড়া-আগরতলা, খুলনা-মোংলা) এবং সীমান্ত বান্ধব বাজার চালু উঠে আসে এই দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার আওতায়। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি চুক্তিতেও ভারত অগ্রাধিকার ভিত্তিক সুবিধাপ্রাপ্ত হয়।
তৎকালীন জনগণ এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিরোধিতা খুব একটা দেখা যায়নি। বিশ্লেষকদের মতে, তখনকার সুবিধাভোগী গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় অংশীদারিত্বে ‘নিয়মিত ভাগ’ পাওয়ায় প্রতিবাদে সক্রিয় ছিলেন না—বরং মৌন সমর্থন দিয়েছিলেন।

বর্তমান: অপরিসীম দুর্নীতির আবর্তে বিদেশি লিজ
বর্তমানে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলোর অব্যবস্থাপনা, প্রতিযোগিতা সংকট এবং দীর্ঘায়িত দুর্নীতির অভিযোগে কর্তৃপক্ষ ‘দক্ষতা ও জবাবদিহিতা’র যুক্তিতে বড় টার্মিনালগুলো দীর্ঘমেয়াদি লিজে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দিচ্ছে। সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডভিত্তিক একটি কোম্পানির সঙ্গে ৪৯০ কোটি টাকা বিনিয়োগ এবং ১৮ কোটি টাকার সাইনিং মানির চুক্তি হয়েছে পানগাঁও বন্দরের জন্য। চট্টগ্রামের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনালের দায়িত্বও বিদেশিদের হাতে যাচ্ছে।

এই সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ, স্বচ্ছতা, নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রবল প্রশ্ন উঠেছে। প্রধান প্রেক্ষাপট হচ্ছে:
ঐতিহাসিকভাবে চট্টগ্রাম, মোংলা, পায়রা ও পানগাঁও বন্দরে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতিতে দেশের আমদানী-রপ্তানী খরচ বাড়ে, এবং গতি কমে যায়।
গত দু’দশকে দুর্নীতি প্রবণতার কারণে রাষ্ট্র-রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা নষ্ট হয়েছে।
সরকার যুক্তি দিয়েছে—বন্দর ব্যবস্থাপনায় নানা অনিয়ম ও রাজনৈতিক অনুপ্রবেশ রোধ, সক্ষমতা ও জবাবদিহিতা বাড়াতে আধুনিক বিদেশি কোম্পানির অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো জরুরি।

বিতর্ক: স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী বনাম জাতীয় স্বার্থ
বিদেশি অপারেটরদের মাধ্যমে বন্দর পরিচালনা বিষয়ে বিরোধিতারা বলছে—দেশীয় জনশক্তি, অর্থনীতি, রিজার্ভ এবং স্বকীয়তা ঝুঁকিতে পড়বে। চুক্তি প্রক্রিয়া অভিযোগে কেউ কেউ বলছেন, খোদ দেশের জনগণ জানে না শর্তাবলী কী, কতটুকু আর্থিক বা কৌশলগত লাভ ক্ষতি। অনেকে মনে করছেন, অতীতের মতো ‘কমিশনভোগী’ সুবিধাভোগী শ্রেণী এখন স্বার্থ হারানোর ভয়ে প্রতিবাদ করছে, যদিও তাদের অনেকেই অতীতে ভারত ও অন্যান্য দেশের স্বার্থরক্ষায় নীরব ছিলেন।

বিশ্লেষণ: কার্যকারিতা বনাম সার্বভৌমতা
বিদেশি কোম্পানির হাতে বন্দর গেলে দক্ষতা-বৃদ্ধি, খরচ কমানো এবং আন্তর্জাতিক মানের অপারেশনের ব্যাখ্যা দেওয়া হলেও—শ্রমিক, স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বুদ্ধিজীবী মহলে প্রশ্ন দেখা যাচ্ছে, এতে বাংলাদেশ গত দুই দশকে নানা সুবিধা দিয়েও অবকাঠামো উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারেনি কেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা ও দেশীয় সমন্বিত উন্নয়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব বলেই এই স্থবিরতা। একদিকে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি হস্তান্তর, অন্যদিকে রাজস্ব ও নিয়ন্ত্রণ হারানোর সম্ভাবনা—এই দ্বন্দ্বেই জনগণ বিভক্ত।

সবশেষে
দুই দশক ধরে বিদেশি ও অভ্যন্তরীণ স্বার্থান্বেষী শক্তির দাপটে বাংলাদেশের বন্দর, অবকাঠামো ও অর্থনীতির মালিকানা ও সুবিধা-ভোগের হিস্যা নিয়ে বিরোধ চলছে। ভারতকে বিশেষ সুবিধার সময় যে নীরবতা ছিল, আজ বিদেশি অপারেটরকে লিজের প্রশ্নে সেই সুবিধাভোগীরাই বেশি সরব। রাষ্ট্রীয় স্বার্থে দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও আধুনিকায়নের জন্য কাঠামোগত সংস্কার জরুরি হলেও, তা যেন জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও স্বকীয়তাকে জলাঞ্জলি না দেয়—এটাই দেশের বৃহৎ অংশের প্রাণের চাওয়া।


লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

১৫২ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন