১৩ সেনা কর্মকর্তা ট্রাইব্যুনালে: ১ হাজারের বেশি গুম-খুনের অভিযোগ
রবিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৫ ১০:২৩ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলাগুলোর একটি—গুম ও হত্যার অভিযোগে সাবেক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল হাসানসহ ১৩ সেনা কর্মকর্তাকে আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছে।
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এক হাজারেরও বেশি গুম, হত্যা এবং নির্যাতনের অভিযোগ আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করা হয়েছে, যা দেশের বিচারব্যবস্থা ও মানবাধিকার পরিস্থিতিতে নতুন পর্যায়ের গুরুত্ব নিয়ে এসেছে।
মামলার প্রেক্ষাপট ও অভিযোগ
দীর্ঘকাল ধরে অভিযোগ ছিল, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশে অসংখ্য গুম, খুন ও নির্যাতন সংঘটিত হয়েছে। তদন্ত সূত্রে জানা যায়, এসব ঘটনার পেছনে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা সংস্থার কেউ কেউ সক্রিয় ছিলেন এবং তা সুনির্দিষ্টভাবে “ওয়াইডস্প্রেড ও সিস্টেম্যাটিক”—অর্থাৎ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ও পরিকল্পিতভাবে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ।
মূলত, এসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে সরকারি ক্ষমতা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অপব্যবহারের মাধ্যমে, যার নেতৃত্বে ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে ডিএসজি, র্যাব, ডিজিএফআই-এর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।
অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের নাম
মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে প্রধান আসামি করা হয়েছে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকীকেও।
অন্যান্য অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল হাসান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কামরুল হাসান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহাবুব আলম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কেএম আজাদ, কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন, কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান (অব.), লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাশিউর রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন, মো. আকবর হোসেনসহ আরও অনেকে। এই তালিকায় রয়েছেন বেশ ক’জন র্যাব ও ডিজিএফআই-এর সাবেক পরিচালকও।
চীফ প্রসিকিউটরের বক্তব্য
চীফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম অভিযোগপত্র পেশের সময় বলেন, দীর্ঘদিন গুম ও হত্যার মতো অপরাধ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছে এবং এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিচার কাজ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। তিনি আরো জানান, এই মামলাতে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্পূর্ণ সহযোগিতা করেছে এবং বিচারকাজে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। প্রসিকিউশনের বক্তব্যে উঠে এসেছে—এই ঘটনাগুলি বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন এবং বিচার প্রতিষ্ঠার উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত হবে।
মামলার পরিমাণ ও পরিসংখ্যান
গুম তদন্ত কমিশন ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের হিসেবে, ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত গুম-হত্যার অভিযোগ জমা হয়েছে ১,৬০০ থেকে ১,৯০০টি। নির্দিষ্ট তদন্তে শুধু জিয়াউল হাসান ও তার টিমের বিরুদ্ধেই ১,০৩০ হত্যাকাণ্ড ও হাজারের অধিক গুমের বাস্তব শিকার প্রমাণিত হয়েছে।
মামলার বর্তমান অবস্থা ও বিচার কার্যক্রম
২৩ নভেম্বর শুনানিতে প্রসিকিউশন পক্ষ আগামী মাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমার জন্য সময় চেয়েছে এবং আদালত ১১ ডিসেম্বর পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করেছে। বিচারকাজ শুরুর পর দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনা ও তৎপরতা দেখা যাচ্ছে—বিচার বিভাগ, সেনাবাহিনী ও প্রশাসনসহ সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে। আদালত সূত্রে জানানো হয়েছে, এই মামলা দীর্ঘমেয়াদি হলেও দ্রুত ও সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা বজায় রেখে বিচার কার্যক্রম পরিচালনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।
শেষ কথা
বাংলাদেশে গুম ও হত্যা—যা দীর্ঘদিন ধরে চলছিল, নজিরবিহীন এই বিচার কার্যক্রম নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সংস্থাগুলোর সমবায়, বিচারকদের কঠোরতা ও প্রসিকিউটরের উদ্বেগ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পুরো বিশ্ব এই আইনি প্রক্রিয়ার দিকে নজর রাখছে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
১২৫ বার পড়া হয়েছে