৫০টিরও বেশি গণসংগীত লিখেছেন কৃষক সোহরাব আলী
শনিবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৫ ৫:০৮ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
সিলেবাসের বাইরের বিশাল জগৎ যে মানুষের চোখ খুলে দেয়-এ উপলব্ধি স্কুলজীবনেই হয়েছিল রাজশাহীর তানোর উপজেলার মাদারীপুর (জমসেরপুর) গ্রামের কৃষক সোহরাব আলীর।
সেই উপলব্ধি থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা ছেড়ে ঝুঁকেছিলেন বিশ্বসাহিত্য, দর্শন ও ইতিহাসের গভীর সাগরে। এখন বয়স ৭২, কিন্তু তাঁর পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ এখনও একই রকম অটুট।
ইতিহাস-দর্শনের মোটা বই কিনে তিনি শুধু নিজে পড়েন না, পড়তে দেন গ্রামের অন্য কৃষকদেরও। যেসব কৃষক কোনোদিন স্কুলে যাননি, তাঁদেরও পাঠক বানিয়ে তুলেছেন সোহরাব। তাঁর লক্ষ্য ছিল কৃষকদের সত্যিকারের শিক্ষিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা।
কৃষকদের জীবন, শোষণ, শ্রমিক আন্দোলন- এসবকে উপজীব্য করে এ পর্যন্ত ৫০টির বেশি গণসংগীত লিখেছেন তিনি। ‘কাস্তে হাতুড়ি আর গাঁইতি হাতে…’ কিংবা ‘বারবার আসে প্লাবন খেয়ে যায় সোনার ধান…’-স্থানীয় শিল্পীরা নিয়মিত পরিবেশন করেন তাঁর লেখা এমন গান।
কণ্ঠশিল্পী ও শিক্ষক আতাউর রহমান বলেন, সোহরাব আলীর গান শ্রমজীবী মানুষের যন্ত্রণাকে অনন্যভাবে ফুটিয়ে তোলে।
কবি ও ঔপন্যাসিক মঈন শেখ জানান, সোহরাব আলীর গান যেমন সমৃদ্ধ, লেখার ধরন তেমনই ছন্নছাড়া। কখনো সিগারেটের খোলা প্যাকেটে, কখনো ছেঁড়া কাগজে লেখা-অনেক গানই নষ্ট হয়ে গেছে। স্থানীয় শিল্পীদের সুরে ধারণ করা গানগুলোই এখন টিকে আছে।
সোহরাব আলীর ঘরে সাজানো আছে ‘ভারতীয় দর্শন’, ‘সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট’, ‘রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম’, ‘ক্যাপিটাল’, ‘জাপান যাত্রী’সহ অসংখ্য বই। তাঁর সংগ্রহে আছে মোট ছয় শতাধিক বই। এর মধ্যে পাঁচ শতাধিক বই এখন পাঠকদের বাড়িতে পড়ার জন্য ছড়িয়ে রয়েছে।
তিনি জানান, এক পাঠকের কাছে দুই বছর ধরে থাকা আরজ আলী মাতুব্বরের ‘চিন্তার জগৎ’ আরেকজনের কাছে থাকা হায়দার আকবর খান রনোর ‘ফরাসি বিপ্লব থেকে অক্টোবর বিপ্লব’ ফেরত আনতে তাঁকে গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত ছুটতে হয়েছে।
স্কুলে পড়ার সময় হরলাল রায়ের ব্যাকরণের ‘চোরের আত্মকাহিনী’ নামের গল্পটি তাঁর জীবনদর্শন পাল্টে দেয়। ছোটবেলায় তিনি নিঃস্ব হাড়িপাড়ার মানুষের ঘরে চাল চুরি করে দিতেন-এ গল্প বলতে গিয়ে তিনি স্মরণ করেন ভিক্টর হুগোর লা মিজারেবল-এর জাঁ ভ্যালজাঁর দুর্ভাগ্যের কাহিনি, যা এখনও তাঁকে ব্যথিত করে।
কার্ল মার্ক্স, লেনিন, মাও সে-তুং, চে গুয়েভারা, ফিদেল কাস্ত্রো থেকে আব্রাহাম লিংকন- অসংখ্য মনীষীর জীবন তাঁকে প্রভাবিত করেছে। ছোটবেলায় উপন্যাস, পরে দর্শন-তাঁর ভাষায়, 'এখন দর্শন ছাড়লে ভালো লাগে না।'
চার সন্তানদের পড়াশোনা করিয়ে সংসারী করেছেন তিনি। তবুও নিজের সারা জীবন কাটিয়েছেন জন্মের দেড় শত বছরের পুরোনো মাটির ঘরেই-যেখানে অন্য পরিবারগুলো বড় বড় পাকা বাড়িতে চলে গেলেও তিনি থেকে গেছেন কৃষকের জীবনের সঙ্গেই।
তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল-এত পড়াশোনা করে কেন কৃষকই থেকে গেলেন? উত্তরে তিনি উদ্ধৃত করলেন বেগম রোকেয়ার কবিতা- 'এ কঠোর মহীতে চাষা এসেছে শুধু সহিতে...'। সোহরাব আলীর ভাষায়, 'আমি চাষার ছেলে, চাষাই হয়েছি-সম্ভবত এ কারণেই এসব আমাকে নাড়া দিয়েছে।'
১০৫ বার পড়া হয়েছে