সর্বশেষ

সাহিত্য

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত: বাংলা কাব্যের জঙ্গম যাত্রী ও শাশ্বতের অন্বেষক

গাউসুর রহমান 
গাউসুর রহমান 

বুধবার, ১৯ নভেম্বর, ২০২৫ ৪:৩৯ অপরাহ্ন

শেয়ার করুন:
বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বাংলা কাব্য-পরিমণ্ডলে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের আবির্ভাব এমন এক সন্ধিক্ষণে সংঘটিত হয়, যখন তিরিশের দশকের আধুনিকতাবাদী উত্তরাধিকার নবীন শৈল্পিক অনুসন্ধান ও নন্দনতাত্ত্বিক পুনর্বিন্যাসের জন্ম দিচ্ছিল।

রবীন্দ্র-পরবর্তী কাব্যধারার মূল স্রোত যখন দ্বিধাবিভক্ত—একদিকে জীবনানন্দ-সুধীন্দ্রনাথের প্রজ্ঞাঋদ্ধ নিরীক্ষা, অন্যদিকে চল্লিশের দশকে উঠে আসা রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার তীব্র অভিঘাত—ঠিক সেই সময়ে অলোকরঞ্জন অতি সতর্ক পদক্ষেপে নিজের কাব্যপথ নির্মাণ করেন। সমালোচকেরা তাঁকে প্রধানত ‘পঞ্চাশের কবি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, কিন্তু তাঁর শৈল্পিক মনন ও দার্শনিক অবস্থান সমকালীন অন্য কোনো প্রধান গোষ্ঠীর সাথেই সম্পূর্ণভাবে সম্পৃক্ত ছিল না। তাঁর প্রথম কবিতা ১৯৪৯ সালে, মাত্র ষোলো বছর বয়সে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, যা তাঁর কাব্যযাত্রার সূচনাকে পঞ্চাশের দশকের ঠিক প্রান্তদেশে স্থাপন করে। এই সময়কালে বাংলা কবিতা যখন ‘কৃত্তিবাস’ ও ‘শতভিষা’—এই দুই প্রধান মেরুতে বিভক্ত, তখন অলোকরঞ্জনের কাব্যিক অবস্থান ছিল স্বতন্ত্র ও প্রায় অ-সম্পৃক্ত। এই স্বাতন্ত্র্যই তাঁকে বাংলা আধুনিকতার ইতিহাসে এক বিকল্প মার্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে, যেখানে বিদ্রোহ নয়, বরং গভীর মগ্নতা ও আত্মিক অনুসন্ধান প্রধান চালিকাশক্তি।

 

পঞ্চাশের দশকের কাব্য আন্দোলনকে যারা কাছ থেকে দেখেছেন, তারা জানেন যে ‘কৃত্তিবাস’ গোষ্ঠীর কবিরা—সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ—প্রথমত রবীন্দ্র-উত্তরাধিকারের বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তাঁদের কাব্যভাষা ছিল স্থূল বস্তুবাদের জয়গান এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের এক ধরনের ‘সম্পূর্ণ আমিত্বের বর্বর আবিষ্কার’-এর পথে অগ্রসর হওয়া। এই গোষ্ঠীর কবিরা যেখানে কাব্যকে নৈরাজ্য ও সামাজিক অসঙ্গতির নির্মম প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন, বাংলা কবিতার প্রথাগত স্নিগ্ধতাকে ‘মধ্যবিত্তীয় পলায়ন’ বলে মনে করতেন, সেখানে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত শতভিষা-পন্থী মনোধর্মে স্পষ্টতই নিষ্কম্প থাকেন, তাঁর নন্দনতাত্ত্বিক ভিত্তি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি রবীন্দ্রনাথকে প্রত্যাখ্যানের পরিবর্তে গ্রহণ করেন, তবে সেই গ্রহণ ছিল ঐতিহ্যবাহী আনুগত্যের চেয়ে আধুনিক সংবেদনশীলতার এক মননশীল স্বীকৃতি। তিনি রবীন্দ্রনাথকে ‘মৌলি পাহাড় জলপ্রপাত’ রূপে ব্যাখ্যা করেন—যা একইসঙ্গে মহৎ ও চিরন্তন গতিশীল—এবং কবিতাপাঠের আসরে ঘোষণা করেন তাঁর সুচিন্তিত কাব্যদর্শন: “disturb করা কবিতার ধর্ম নয়”। এই স্থির, প্রশান্ত অবস্থান তাঁকে সমকালীন স্থূল বিদ্রোহ এবং কাব্যিক নৈরাজ্যের উন্মত্ততা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায় এবং আধুনিকতার এক বিকল্প ধারা প্রতিষ্ঠা করে; যে ধারা তীব্রতা ও চাঞ্চল্যের মধ্যেও শাশ্বতের অন্বেষণকে অগ্রাধিকার দেয়।

 

অলোকরঞ্জনের এই নন্দনতাত্ত্বিক দর্শনের মূলে প্রোথিত ছিল এক গভীর প্যান্থেইস্টিক (pantheistic) উপলব্ধি, যেখানে তিনি জগতের প্রতিটি ক্ষণিক অস্তিত্বের মধ্যে চিরন্তনের স্বাক্ষর দেখতে পান। তাঁর বিখ্যাত পঙক্তিগুচ্ছ— “আমি যে সব-কিছুর ভিতরেই/ শাশ্বতের কারুকার্য দেখি।/ জগৎটারে যখনই লাগে ভালো/ তখন আমি নিজেরই মনে খুশি”—তাঁর কাব্যিক মানসের সারাংশকে ধারণ করে। এই ‘শাশ্বত কারুকার্য’ বস্তুজগৎ ও মরমীজগতের মধ্যে এক সেতু নির্মাণ করে। অলোকরঞ্জনের কাছে আধুনিকতা তাই ভাঙনের সমার্থক ছিল না, বরং তা ছিল মহৎ ঐতিহ্যের পুনর্বিন্যাস এবং ক্ষণিকের মধ্যে চিরন্তনের লৌকিক অথচ গভীর উপলব্ধি। তাঁর কাব্যে এই অনুসন্ধিৎসু মনোবৃত্তিই ‘জঙ্গমতা’ বা নিরন্তর গতিশীলতার জন্ম দেয়, যা সমালোচকেরা তাঁর দীর্ঘ কাব্য-যাত্রার মূল চালিকাশক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

 

এই ‘জঙ্গমতা’ কেবল ভৌগোলিক ভ্রমণ বা দেশান্তরের অভিজ্ঞতা নয়, বরং আঙ্গিকগত, দার্শনিক ও আত্মিক স্তরে এক অবিরাম আত্ম-বিনির্মাণ ও আত্ম-বিধ্বংসের প্রক্রিয়া। এটি স্থিরতা ও স্থবিরতার বিরুদ্ধে আধুনিক চেতনার এক গভীর প্রতিরোধ। এই গতিশীলতার প্রথম স্ফুরণ ঘটে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ যৌবন বাউল (১৯৫৯)-এ। ১০৮টি কবিতার এই সংকলনটিতে প্রকৃতিকে আশ্রয় করে নিঃসঙ্গতার মধ্য দিয়ে এক মরমী বিভোরতা ঘোষণা করা হয়। এই যৌবন বাউল নামাঙ্কনটি কেবল লোকসংস্কৃতির প্রতিধ্বনি নয়, বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে উদ্ভূত নৈরাজ্য ও বিপর্যয়ের মুখে শিকড় (root) ও ভ্রমণের (travel) দ্বৈত অভিজ্ঞতার সংশ্লেষণ। বাউল-মনস্কতা এখানে ঐতিহ্য ও আধুনিক বিচ্ছিন্নতার মধ্যে এক সংলাপে প্রবৃত্ত হয়। অলোকরঞ্জন যেন জীবনানন্দ দাশের নিসর্গ-চেতনা এবং জীবনানন্দ-উত্তর যুগের existential angst-এর সমন্বয়ে এক নতুন সুর সৃষ্টি করেন। তিনি ভ্রমণ করেন, কিন্তু সেই ভ্রমণ কোনো পর্যটকের উদ্দেশ্যহীন পদচারণা নয়, বরং আত্মিক উপলব্ধির জন্য প্রয়োজনীয় এক নিরন্তর pilgrimage।

 

এই মগ্ন বাউল চেতনার পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলিতে—যেমন নিষিদ্ধ কোজাগরী (১৯৬৭), নির্বাসন (১৯৭২) এবং বসন্তের গান (১৯৭৬)—এক স্থানান্তরিত longing-এর সুর প্রবল হয়। জঙ্গমতা এখানে আর ব্যক্তিগত মগ্নতায় সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং ব্যক্তিগত আত্মদর্শন ও সমাজের নগরায়নের অস্থিরতা অভিন্ন হয়ে ওঠে। কবির অন্তরলোকের ভ্রমণ ক্রমশ স্থান পরিবর্তন করে গ্রামীণ অর্থনীতির ভাঙন ও নগরকেন্দ্রিক বিচ্ছিন্নতার দলিল রচনায়। ‘এক-জানালা-রাত্রি আমার’ কবিতায় ব্যক্তিগত ভ্রমণের মগ্নতা শেষ হয় যখন তিনি দেখেন—‘শহরে কাজ নিতে পালায় বলাই বনমালি’। এই পঙক্তিটি গ্রামীণ ভারতের অর্থনৈতিক পরিবর্তনের এক গভীর চিত্র তুলে ধরে: কবি যেখানে শাশ্বতের অন্বেষণে মগ্ন, সেখানে সমাজের সাধারণ মানুষ কেবল জীবিকা ও টিকে থাকার লড়াইয়ে স্থানচ্যুত হচ্ছে। অলোকরঞ্জনের জঙ্গমতা তখন কেবল মিস্টিক অভিজ্ঞতা নয়, বরং সমাজ-সচেতনতার এক সূক্ষ্ম প্রকাশ। তাঁর নির্বাসন বা দেশান্তরের অনুভূতি তাই কেবল

 

ব্যক্তিগত শোক নয়, বরং সামগ্রিক জীবনযাত্রার অস্থিরতা ও মূল উৎপাটনের প্রতীক হয়ে ওঠে। অলোকরঞ্জনের জঙ্গমতা চরম রূপ লাভ করে তাঁর কাব্য-যাত্রার শেষ দশকে, যখন তিনি অবিরাম যুদ্ধের ভয়াবহতা ও নৈতিক সংকটের সম্মুখীন হন। এই সময় তিনি প্রথাগত গীতিকবিতার সীমা অতিক্রম করে জার্মান দার্শনিক থিওডর আডর্নোর বহুল আলোচিত প্রশ্নের মুখোমুখি হন: “Is there any place for the lyric after Auschwitz?” দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে আডর্নোর এই প্রশ্ন শিল্প ও নৈতিকতার সম্পর্ককে পুনর্বিচার করতে বাধ্য করেছিল। অলোকরঞ্জন তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থগুলিতে, বিশেষত ২০০৩ সালের যুদ্ধের ছায়ায় লেখা কবিতাগুচ্ছে, এই নৈতিক সংকটের প্রতি তীব্র দায়বদ্ধতা দেখান। তিনি বুঝতে পারেন, ঐতিহ্যবাহী গীতিকবিতার মাধুর্য বা প্রশান্তি ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডির বিশালতাকে ধারণ করার পক্ষে যথেষ্ট নয়।

 

এই বোধ তাঁকে আঙ্গিকগত বিপ্লবের দিকে চালিত করে। তিনি কোলাজ-আঙ্গিকে গদ্য, পদ্য, তথ্যপত্র, অনুবাদ, ভ্রমণকাহিনি এবং সমকালীন রাজনৈতিক ভাষ্যকে একত্রিত করেন। এই আঙ্গিকগত পরিবর্তন নিছক শৈল্পিক পরীক্ষা ছিল না; এটি ছিল ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডির প্রতি নৈতিক দায়বদ্ধতার ফলশ্রুতি। জঙ্গমতা এখানে শুধুমাত্র আত্মিক ভ্রমণ নয়, বরং কাব্যের স্থিতিশীল কাঠামোকে ভেঙে ফেলার মাধ্যমে নৈতিক সত্যকে প্রকাশ করার এক মরিয়া চেষ্টা। এই কোলাজ-ফর্ম ‘বিশৃঙ্খলার শিল্প’ (art of fragmentation) হিসেবে কাজ করে, যা যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ওfragmented বাস্তবতাকে মূর্ত করে তোলে। অলোকরঞ্জনের এই বিলম্বিত আঙ্গিকগত আধুনিকতা প্রমাণ করে যে, তিনি কেবল শাশ্বতের অন্বেষক ছিলেন না, তিনি সময়ের ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা উপলব্ধি করে নিজের কাব্যিক কাঠামোকেও বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিলেন। তাঁর কাব্য তখন ব্যক্তিগত মগ্নতা অতিক্রম করে সময়ের মহামিছিলে এক জঙ্গম যাত্রী হিসেবে পদার্পণ করে।

 

কাব্য রচনার পাশাপাশি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত একজন নিবেদিতপ্রাণ অনুবাদক ও মননশীল গবেষক হিসেবে বাংলা প্রবন্ধসাহিত্যে নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেছেন। তাঁর Goethe and Tagore (১৯৭৩)—যা পরবর্তীকালে বাংলায় ‘গোটে এবং রবীন্দ্রনাথ’ নামে প্রকাশিত হয়—এ এক তুলনামূলক সাহিত্যতত্ত্বের গভীর ও বিশ্লেষণাত্মক দিগন্ত উন্মোচিত হয়। প্রবন্ধে তাঁর দার্শনিকতার গভীরতা, তুলনামূলক দৃষ্টি এবং সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা প্রতিফলিত। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি ও সময়ে দাঁড়িয়ে দুইজন মহৎ কবি মানবজীবন ও প্রকৃতির শাশ্বত সত্যকে অন্বেষণ করেছেন। তাঁর এই গদ্যগুলি কেবল তাঁর পাণ্ডিত্যের পরিচায়ক নয়, বরং তাঁর কাব্যিক নন্দনতত্ত্বের দার্শনিক ভিত্তি নির্মাণেও সহায়ক। তাঁর কবিতা ও গদ্য—উভয় মাধ্যমেই তিনি অচল বা স্থির কোনো ধারণাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছেন।

 

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত বাংলা কাব্য-পরিমণ্ডলে এক বিরল আধুনিক সত্তা, যিনি বিদ্রোহের পথ এড়িয়ে গভীর ধ্যানের মাধ্যমে শাশ্বতের অন্বেষী হয়েছেন। পঞ্চাশের দশকের দুই প্রধান মেরুর বিপরীতে দাঁড়িয়ে তিনি ‘জঙ্গমতা’কে তাঁর জীবনের ও শিল্পের মূল দর্শন হিসেবে গ্রহণ করেন। এই জঙ্গমতা তাঁকে স্থবিরতা থেকে বাঁচিয়ে ক্রমাগত আঙ্গিক, দর্শন ও আধ্যাত্মিকতার স্তরে নিজেকে পুনর্বিন্যাস করতে সাহায্য করেছে। তাঁর বাউল-মনস্কতা এবং  শেষ জীবনে ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডির প্রতি তাঁর নৈতিক দায়বদ্ধতা—সবই এই জঙ্গম যাত্রার বিভিন্ন পর্যায়। ‘শাশ্বত কারুকার্য দেখার’ এই নিরন্তর প্রচেষ্টাই অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে বাংলা আধুনিক কাব্যের ইতিহাসে এক অনন্য ও চিরন্তন অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছে, যেখানে গতিশীলতা নিজেই স্থিতিশীল সৌন্দর্যের কারণ। তিনি প্রমাণ করেছেন যে, আধুনিকতা মানে কেবল নৈরাজ্য নয়, বরং গতিশীলতার মধ্যে স্থিত শাশ্বত সত্যের সন্ধানও হতে পারে।

১৩৪ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
সাহিত্য নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন