নিউ টাউন সোসাইটি-র উন্নয়নে সিডরো (SEDRO)-র ভূমিকা
রবিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২৫ ৪:০৩ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
সিডরো "Social Education Development and Research Organisation (SEDRO)" বাংলাদেশের সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক, স্বেচ্ছাসেবী, আর্ত মানবতার সেবায় কাজ করা একটি জাতীয় বেসরকারি গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা।
বাংলাদেশে নগরায়ণ দ্রুত গতিতে ঘটছে। UN‑Habitat বলছে, বাংলাদেশের নগর জনসংখ্যা ৬২০০ লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে এবং নগর সুবিধা-সুবিধা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জলাবদ্ধতা ও মশা-নিয়ন্ত্রণের মতো চ্যালেঞ্জ বাড়ছে। সেইসঙ্গে, এনজিও (NGO)-র ভূমিকা নগর দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।
এই পেপারে আমরা বিশ্লেষণ করব— কীভাবে সিডরো (SEDRO)‐র এক প্রকল্প নগরপ্রান্তিক অঞ্চলে অবকাঠামো, পরিচ্ছন্নতা ও সবুজায়নের মাধ্যমে নাগরিক অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন অনুশীলন করছে, তার কার্যকারিতা, সীমাবদ্ধতা এবং ভবিষ্যৎ সুপারিশ।
ঢাকার প্রান্তিক এলাকা ডেমরা (Demra) অনেক বছর ধরে অবকাঠামোগত দুরবস্থা, জলাবদ্ধতা, অপরিষ্কার রাস্তাঘাট ও ড্রেনেজ, মশা ও বর্জ্য দূষণের কারণে বেশ সমস্যায় ছিল।স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগ সীমিত ছিল এবং নাগরিকদের মৌলিক সেবা থেকে অনেকাংশে বঞ্চিত ছিল।
নগরায়ণ, অবকাঠামো ও পরিবেশ-সচেতন সংগঠনগুলোর তরফে দেখা যাচ্ছে, অংশগ্রহণমূলক নগর উন্নয়ন মডেল কার্যকর হতে পারে—উদাহরণস্বরূপ BRAC-র Urban Development Programme (UDP)-র অভিজ্ঞতা: কমিউনিটি-ভিত্তিক, অংশগ্রহণমূলক আর দায়বদ্ধতার সঙ্গে কাজ করছে। এছাড়াও, “NGO’s role in fostering equity and social inclusion in cities of Bangladesh: the case of Dhaka” গবেষণায় দেখা গেছে যে, এনজিওগুলো নগর দরিদ্রদের মধ্যে সামাজিক অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।
এই প্রেক্ষাপটে, SEDRO-এর উদ্যোগ একটি ‘মডেল’ প্রকল্প হয়ে উঠতে পারে, যেখানে স্থানীয় বাসিন্দাদের অংশগ্রহণ, অবকাঠামো উন্নয়ন, পরিচ্ছন্নতা, মশা-নিয়ন্ত্রণ ও সবুজায়ন একসঙ্গে চলছে।
প্রকল্প বাস্তবায়ন ও কার্যক্রমঃ
প্রকল্পের বিবরণ অনুযায়ী—
স্থান: ডেমরা, ঢাকা
বাস্তবায়ন সংস্থা: SEDRO
সহযোগী: নিউ টাউন সোসাইটি (বাসিন্দাদের গঠন করা কমিটি) ও দৈনিক কালের কথা (জাতীয় পর্যায়ের একটি দৈনিক পত্রিকা)
প্রকল্পকাল: জানুয়ারি ২০২৪ – অক্টোবর ২০২৫
লক্ষ্য: টেকসই নগর উন্নয়ন, পরিচ্ছন্নতা, জনস্বাস্থ্য ও সবুজায়ন
অবকাঠামো উন্নয়ন ও রাস্তাঘাট সংস্কার
প্রথম পর্যায়ে ১.২ কিমি রাস্তা মেরামত এবং ৩টি মূল ড্রেন পরিষ্কার ও নতুন ঢাকনা স্থাপন করা হয়। এতে বর্ষায় জলাবদ্ধতা ও দুর্গন্ধজনিত সমস্যা প্রায় ৬০ % হ্রাস পেয়েছে।
পরিচ্ছন্নতা ও মশা-নিধন কার্যক্রমঃ
দ্বিতীয় পর্যায়ে ‘কমিউনিটি ক্লিনিং ডে’ চালু করা হয়, যেখানে স্থানীয় নারী-পুরুষ ও কিশোররা অংশ নেয়। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় প্লাস্টিক ও জৈব বর্জ্য আলাদা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এছাড়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সহযোগিতায় মশা-নিধন কার্যক্রম পরিচালিত হয় এবং স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের তথ্যানুসারে গত তিন মাসে ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়া সংক্রমণ ৭০ % পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে বলে জানা গেছে।
সবুজায়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণঃ
সোসাইটির ২০টি রাস্তার দুই পাশে ২৫০টিরও বেশি ফলজ ও
বনজ গাছ রোপণ করা হয়। এছাড়া স্থানীয় স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠন করা হয় ‘গ্রীন অ্যাম্বাসেডর টিম’, যারা গাছের পরিচর্যা ও বর্জ্য ফেলার নিয়ম তদারকি করছে।
অংশগ্রহণমূলক দৃষ্টিভঙ্গিঃ
সিডরো (SEDRO)-র প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী বলেছেন: “আমাদের লক্ষ্য কেবল - নাগরিকদের মধ্যে মালিকানা ও দায়িত্ববোধ তৈরি করা। উন্নয়ন তখনই টেকসই হয়, যখন জনগণ নিজেই পরিবর্তনের অংশ হয়ে ওঠে।” এমন অংশগ্রহণমূলক মনোভাব প্রকল্পকে সাধারণ সিন্ধান্তগ্রহণমূলক উন্নয়নমডেল হিসেবে দাঁড় করায়।
বিশ্লেষণ:
এই প্রকল্পের ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে—
(ক) অংশগ্রহণ ও মালিকানার অনুভূতি-বাসিন্দাদের নিজস্ব উদ্যোগে কমিটি গঠন, স্বেচ্ছাসেবী টিম গঠন ও সিডরো (SEDRO)-র সঙ্গে অংশগ্রহণ এই ধারণাকে শক্তিশালী করেছে যে ‘নাগরিক অংশগ্রহণ’ শুধু আনুষঙ্গিক নয়, উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। দৃষ্টান্ত হিসেবে স্থানীয় বাসিন্দার কথাবলিতে দেখা যায়—“আগে যেখানে কাদা আর জল, আজ সঠিক রাস্তা, পরিষ্কার ড্রেন।” এই পরিবর্তন তাদের জীবনের সাথে সরাসরি যুক্ত। প্রতিপাদ্য হলো— গভীর স্থানীয় অংশগ্রহণ উন্নয়নকে টেকসই করে তোলে।
এই দৃষ্টিকোণ আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার সঙ্গেও মিলে যায়; যেমন BRAC-UDP-র অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে—“people-centric city planning enables healthy and better-living conditions”.
(খ) অবকাঠামো ও পরিষেবার গুণমান উন্নয়ন-রাস্তা ও ড্রেন মেরামত, মশা-নিয়ন্ত্রণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা—এসব কার্যক্রম শুধু পরিমিত নয়, একসাথে প্রান্তিক নগরবাসীর দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা বদলে দিয়েছে। এটি স্পষ্ট যে অবকাঠামো উন্নয়ন এবং পরিষেবা সরবরাহ একান্ত জরুরি, তবে সেইসাথে ব্যাপক অংশগ্রহণ, সচেতনতা এবং রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থাও থাকতে হবে।
(গ) পরিবেশ ও সহায়ক উপাদান-সবুজায়ন, ফলজ ও বনজ গাছ রোপণ, শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ—এসব উদ্যোগ শুধু সৌন্দর্যবর্ধক নয়, নগর জীবনে পরিবেশ ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ। নগরায়ণে গাছ-গাছালি, জনসাধারণের বজায় রাখা সবুজ এলাকা, পরিচ্ছন্নতা—এসব বিষয় নগর বাসযোগ্যতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখে। উদাহরন করে, পরিবেশসংক্রান্ত এবং স্বাস্থ্যাভিজ্ঞতা সংশ্লিষ্ট গবেষণা সাপেক্ষে এইমত ধরা যায় যে, পরিবেশ উন্নয়ন ও সবুজায়ন নগরবাসীর জীবনের মান বৃদ্ধিতে কার্যকর।
(ঘ) চ্যালেঞ্জ:
যদিও প্রকল্পটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছে, কিন্তু টেকসুইটি তথা স্থায়িত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু বিষয় গুরুত্বপূর্ণ—
রক্ষণাবেক্ষণ ও দীর্ঘমেয়াদি পরিচালন ব্যবস্থা কি নিশ্চিত করা হয়েছে?
স্থানীয় কমিটি ও স্বেচ্ছাসেবী টিম কতটুকু নিয়মিত ও নিয়ন্ত্রিতভাবে কাজ করছে?
অর্থায়ন ও স্থানীয় সরকার/সিটি কর্পোরেশনের অংশগ্রহণ কতটুকু স্থায়ী?
অন্যান্য এলাকায় প্রতিলিপি করা যায় কি না — অর্থাৎ স্কেল-আপ ব্যর্থ হবে কি না?
এই প্রশ্নগুলো শুধুই এই প্রকল্পের জন্য নয়, বরং বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি নগর উন্নয়ন উদ্যোগের জন্যই প্রাসঙ্গিক। যেমন, “Bangladesh National Urban Policies” প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—কার্যকর নগর উন্নয়ন অনেকাংশে এনজিও, স্থানীয় সরকার ও বেসরকারি অংশীদারিত্বের ওপর নির্ভরশীল।
(ঙ) শিক্ষণীয় বিষয়
অংশগ্রহণমূলক উদ্যোগের ক্ষেত্রে স্থানীয় কমিটি গঠন ও স্বেচ্ছাসেবী টিম কার্যকর।
অবকাঠামো + পরিচ্ছন্নতা + পরিবেশ — মোট আলোচনায় নিয়ে গেলে পরিবর্তনের গতি বেশি।
মশা ও বর্জ্য নিয়ন্ত্রণের মতো জনস্বাস্থ্য বিষয়গুলোর সঙ্গে অবকাঠামো উন্নয়ন একসাথে হলে সাফল্য বৃদ্ধি পায়।
স্থানীয় সচেতনতা ও মালিকানার অনুভূতি স্থায়ী পরিবর্তনের জন্য মূল।
দ
৫. সীমাবদ্ধতা:
এই গবেষণায় কিছু সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে—
প্রকল্পের পরিসংখ্যান ও পর্যবেক্ষণ অনেকটাই স্থানীয় তথ্যের ওপর নির্ভর, স্বাধীন তৃতীয় পার্টি মূল্যায়ন অনুপস্থিত।
দীর্ঘমেয়াদি রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্প্রসারণ বিষয়ে তথ্য সীমিত।
অন্যান্য এলাকার তুলনায় এই প্রকল্প এক পাইলট মাত্র; স্কেল-আপ করার ক্ষেত্রে ভৌগোলিক বা অর্থনৈতিক ভেরিয়েবল ভিন্ন হতে পারে।
নির্ধারিত সময়সীমা (২০২৪-২০২৫) শেষে পরবর্তী পর্যায়ে যে কার্যক্রম নেওয়া হবে, তার বাস্তবায়ন এখনও পর্যবেক্ষণ করা হয়নি।
৬. সুপারিশ সমূহ :
এই প্রকল্প ও বিশ্লেষণ থেকে নিচের সুপারিশগুলো দেওয়া যেতে পারে—
১. স্থানীয় সরকার ও সিটি কর্পোরেশনের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে প্রকল্প রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্প্রসারণ সম্ভব হয়।
২. অংশগ্রহণমূলক মডেল আরও সংগঠিত করতে, স্থানীয় কমিটির সক্ষমতা বৃদ্ধি ও নিয়মিত ক্ষমতায়ন (capacity-building) জরুরি।
৩. পর্যায়ক্রমে প্রকল্পের ফলাফল মাপার জন্য পরিমাপক সূচক (monitoring & evaluation framework) গঠন করা উচিৎ, যাতে কার্যকারিতা ও স্থায়িত্ব মূল্যায়ন করা যায়।
৪. টেকনোলজি ও নতুন উদ্ভাবন (smart waste management, IoT-ভিত্তিক মনিটরিং) প্রয়োগ করা যেতে পারে, যেমন গবেষণায় দেখানো হয়েছে “IoT Based Smart Waste Management System” সম্পর্কে।
৫. পরিবেশ-উন্নয়নমূলক কার্যক্রম (যেমন বৃক্ষরোপণ, গ্রীন স্পেস বাড়ানো) ও জনস্বাস্থ্য উদ্যোগের সমন্বয় বজায় রাখতে হবে, যাতে নগর বাসযোগ্যতা বাড়ে।
৬. সফল মডেল হিসেবে এই প্রকল্পের অভিজ্ঞতা অন্যান্য প্রান্তিক এলাকায় প্রয়োগ করার আগে, স্থানীয় প্রেক্ষাপট অনুসারে রূপান্তর পরিকল্পনা করতে হবে।
সিডরো (SEDRO)-র নিউ টাউন সোসাইটি প্রকল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ যে—নাগরিক অংশগ্রহণ, এনজিও সহায়তা ও স্থানীয় উদ্যোগ একসাথে হলে নগর প্রান্তিক এলাকায় টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। এই প্রকল্প শুধু অবকাঠামো উন্নয়নই করেনি, বরং স্থানীয় মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, দায়িত্ববোধ ও সচেতনতা উন্নয়নের মাধ্যমে পরিবর্তন এনে দিয়েছে। তবে স্থায়িত্ব ও সম্প্রসারণ-ক্ষমতা (scalability) নিশ্চিত করতে হলে সুসংহত পরিকল্পনা, স্থানীয় অংশীদারিত্ব ও দীর্ঘমেয়াদি রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম অপরিহার্য।
এই গবেষণাপত্রটি প্রযুক্তিগত ও ব্যবহারিক অনুমান উভয়ই প্রদান করেছে—নগর উন্নয়নের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণমূলক মডেল কতটা কার্যকর হতে পারে, এবং তার সীমাবদ্ধতা কোথায় রয়েছে তা স্পষ্ট করেছে। আগামী দিনে এই ধরনের প্রকল্পের কার্যকর মডেল এবং প্রচলিত সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মধ্যে সমন্বয় বাড়ালে বাংলাদেশের নগরায়ণ আরও মানবিক, টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়ে উঠবে বলে আশা করা যায়।
১১৪ বার পড়া হয়েছে