সর্বশেষ

মতামত

বাংলাদেশে ফেক ইনফরমেশন মহামারী: বৈশ্বিক প্রবণতা ও প্রতিরোধের পথ

মনজুর এহসান চৌধুরী
মনজুর এহসান চৌধুরী

বৃহস্পতিবার , ১৩ নভেম্বর, ২০২৫ ৩:০১ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
বিশ্বজুড়ে ফেক ইনফরমেশন বা ভুয়া তথ্য এখন এক ভয়াবহ মহামারীর রূপ নিয়েছে। সম্প্রতি Statista ও আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ভারত শীর্ষে থাকলেও বাংলাদেশও এখন ফেক নিউজ বিস্তারে অন্তত শীর্ষ ২০ দেশের তালিকায় উঠে এসেছে।

বিশ্বরাজনীতির নানা গতি-প্রকৃতি ও আধুনিক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ভারতে প্রশিক্ষিত অনুসারীদের মাধ্যমে দেশের সোশ্যাল মিডিয়া জগতে গুজব ও বিভ্রান্তি বাড়ছে—এমন মনোভাবও দেখা গেছে নানা সময়।

সাম্প্রতিক সময়ে এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। নতুন পালা শুরু হয়েছে ১৩ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিচার সংক্রান্ত রায় এবং আওয়ামী লীগের “লকডাউন আন্দোলনের” ডাককে ঘিরে, যেখানে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গুজব জনমনে ভয়, বিভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।

নভেম্বর: আতঙ্ক, তথ্যযুদ্ধ, এবং গুজবের ঝড়
নভেম্বরের শুরু থেকে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে অনলাইন-অফলাইন উভয় মাধ্যমেই “লকডাউন”, “জরুরি অবস্থা”, “সহিংসতা”, “সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার উসকানি”, “রাজনৈতিক নেতাদের আত্মগোপন”—এমন নানা শিরোনামের ওপর ভিত্তি করে গুজব-প্রতিযোগিতা চলছে।

ফেসবুক, এক্স (টুইটার), ইউটিউব, ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং—সবখানেই ছবি, ভিডিও, পোস্টের মাধ্যমে ভুয়া খবর ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। পুরনো ফুটেজ নতুন প্রসঙ্গে, এআই দিয়ে তৈরি/বিকৃত ছবি বা গণকবরের ভিডিও, কিংবা ভুয়া পরিচয়ে বিশেষজ্ঞ-কলাম—সব জায়গায়ই দেখা যাচ্ছে বিভ্রান্তি ছড়ানোর প্রবণতা। প্রশাসনের বিশেষ সেল ও স্বতন্ত্র সংস্থা ইতোমধ্যে সনাক্ত করেছে—শতাধিক গুজব ও বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট দেশের রাজনীতির পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও আতঙ্কে রেখেছে।

সাধারণ মানুষের জীবনে প্রতিক্রিয়া
গুজবের প্রভাবে রাজধানীর অনেক দোকান আগেভাগে বন্ধ, পরিবার-প্রতিষ্ঠান নিরাপত্তার জন্য স্বতঃপ্রণোদিত ছুটি, শিক্ষার্থী ও কর্মজীবীদের মধ্যে আতঙ্ক—এসব এখন বাংলাদেশে অস্বাভাবিক রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
‘রায় ঘিরে ঢাকা অচল’, ‘প্রধান নেতা দেশত্যাগে’, ‘সেনা ও বিমান বাহিনীর প্রস্তুতি’—এমনকি গ্রাম-শহর সর্বত্রই মিথ্যা বা “আংশিক সত্য” খবর ঠাঁই পাচ্ছে।

ফেক ইনফরমেশনের চালক কারা?
প্রথমত, দলীয় অনুসারী ও নেতাকর্মী; দ্বিতীয়ত, ‘ট্রল’ ও গোপন অ্যাকাউন্ট, যারা সাম্প্রদায়িক, রাজনৈতিক বা সামাজিক উত্তেজনা উসকে দেয়; তৃতীয়ত, বিদেশি প্ল্যাটফর্ম—যেখানে রাজনৈতিক বিরোধকে ঘিরে “ইনফরমেশন ওয়ারফেয়ার” এখন সাধারণ বিষয়।
এমনকি, মূলধারার সংবাদমাধ্যমও অনেক সময় যাচাই না করে ভুল তথ্য প্রচার করে বিভ্রান্তি বাড়াতে ভূমিকা রাখছে।

বিশ্বব্যাপী প্রতিরোধ ও বাংলাদেশের অবস্থান
চীন, সিঙ্গাপুর, রাশিয়া এবং কিছু ইউরোপীয় দেশে ভুয়া তথ্য ছড়ালে রয়েছে জরিমানা, কারাদণ্ড, এমনকি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অনলাইনে নিষেধাজ্ঞা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডিজিটাল সার্ভিসেস অ্যাক্টের মতো পদক্ষেপও রয়েছে—যেখানে বড় সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মগুলোকে বাধ্য করা হচ্ছে সন্দেহজনক কনটেন্ট দ্রুত সরাতে।
বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সাইবার সুরক্ষা সংস্থা (NCSA)-এর বিশেষ সেল, এবং ফ্যাক্ট-চেক সংস্থা (যেমন: রিউমার স্ক্যানার, যাচাই, এএফপি ফ্যাক্ট চেক) সক্রিয়। প্রশাসনকে সহায়তা করছে পুলিশ, প্রশাসন, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (BTRC) এবং প্রিন্ট-ইলেকট্রনিক মিডিয়া।
তবে চ্যালেঞ্জ: আইনের অপব্যবহার, তথ্য-স্বাধীনতা খর্ব হওয়া, সাধারণের সচেতনতায় ঘাটতি এবং ভুল তথ্য শনাক্তে প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত দূরত্ব রয়ে গেছে।

করণীয়—বেরিয়ে আসার পথ কী?
১. নিরপেক্ষ ফ্যাক্ট-চেকিং ও গণসচেতনতা: জন-বিশ্বাসযোগ্য প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে দ্রুত ফেক কনটেন্ট যাচাই ও সচেতনতা।
২. মিডিয়া ও ডিজিটাল লিটারেসি: শিক্ষাঙ্গন ও কমিউনিটিতে তথ্য যাচাই শেখানো বাধ্যতামূলক করা।
৩. আইন প্রয়োগে স্বচ্ছতা ও মানবিকতা: জনস্বার্থের বাইরে আইনের অপব্যবহার এড়িয়ে যাচাই-বাছাই নিশ্চিত করা।
৪. টেক কোম্পানির দায়িত্ব: ফেসবুক, ইউটিউব, এক্স ইত্যাদিকে বাংলা ভাষায় সহজ রিমুভ ও রিপোর্ট সিস্টেম চালু করা বাধ্যতামূলক।
৫. স্থানীয় কমিউনিটি ও নিজস্ব নেতৃত্ব: ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নেতাদের গণমাধ্যমে যুক্ত করে গুজব প্রতিরোধে কার্যকরী প্রচার।
৬. উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার: এআই-ভিত্তিক দ্রুত যাচাই টুল ও স্বয়ংক্রিয় সতর্কীকরণ।

আসল কথা
বাংলাদেশে ফেক ইনফরমেশনের বিস্তার এখন আর মাত্র বিশেষ কোনো দিবস বা রাজনীতিক ঘটনা ঘিরে সীমাবদ্ধ নয়—গত ১৫ মাসে অভ্যুত্থানের আগেও এবং পরের সময়টায় দেশের হঠাৎ করে ফিরে পাওয়া বাকস্বাধীনতার বাস্তবতায় নতুন এক ডিজিটাল দুর্যোগ তৈরি হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় “ভিউ ব্যবসায়ী”, রাজনৈতিক বট বাহিনী ও দলীয় কর্মীরা প্রতিদিনই ভুয়া নিউজ তৈরি করে, জনপ্রিয়তা ও প্রভাব বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় সেটি বারবার শেয়ার করেন—এতে জনজীবনে আতঙ্ক, বিভ্রান্তি ও সামাজিক অনাস্থার এক চুরি-ভর্তি বাতাস বইছে।
১৩ নভেম্বরের মতো আলোচিত কোনো ঘটনার সময় এই প্রবণতা শুধু বেশি দৃশ্যমান হয়, বাস্তবে এটি দেশের প্রতিদিনের সাধারণ বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এএফপি ফ্যাক্টচেক, রিউমার স্ক্যানার এবং সরকারি পর্যবেক্ষকদের প্রতিবেদন বলছে, বিনা যাচাইয়ে কনটেন্ট তৈরি, পুরনো ভিডিও-ছবি নতুন নামে ছড়ানো এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণেীত প্রচারণা গত এক বছরে বহু গুজবের জন্ম দিয়েছে, যার শিকার জনসাধারণ।

এই পরিস্থিতিতে শুধু সরকার নয়—গণমাধ্যম, সিভিল সোসাইটি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রযুক্তি কোম্পানি এবং প্রত্যেক ফেসবুক বা এক্স ব্যবহারকারীর সচেতন আন্তরিকতা অপরিহার্য। তথ্যের স্বতন্ত্রতা বজায় রেখে, আইনের অপব্যবহার না করে, শক্তিশালী সামাজিক সচেতনতাই পারে জনগণকে বিভ্রান্তির হাত থেকে রক্ষা করতে এবং সত্য তথ্যের ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নির্মাণের পথ সুগম করার এখনই সময়।



লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

১৪০ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

৩০০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন
এলাকার খবর

বিজ্ঞাপন

৩০০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ সব খবর
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন