হুমায়ূনের আখ্যান: অলৌকিকতার ছায়ায় মানব-হৃদয়ের অনুসন্ধান
রবিবার, ৯ নভেম্বর, ২০২৫ ৪:৪১ অপরাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাংলা সাহিত্যের আকাশে এক অদম্য নক্ষত্রের মতো উদিত হয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ, যাঁর কলমের স্পর্শে সাধারণ জীবনের সূক্ষ্মতা অসাধারণতায় রূপান্তরিত হয়।
তাঁর সৃষ্টি কেবল গল্পের সীমানা অতিক্রম করে মানুষের অন্তরের গহ্বরে প্রবেশ করে, যেখানে হাস্যের স্ফুলিঙ্গ অতিপ্রাকৃতের ছায়ায় মিলিত হয়ে এক অপূর্ব সামঞ্জস্য সৃষ্টি করে। বাংলা কথাসাহিত্যের এই অভিনব কণ্ঠস্বর, যা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের মানসিকতাকে আয়নায় প্রতিফলিত করে, শুধুমাত্র জনপ্রিয়তার শিখরে অধিষ্ঠিত হয়নি, বরং সাহিত্যিক গভীরতার মানদণ্ডও নির্ধারণ করেছে। তাঁর উপন্যাস, ছোটগল্প এবং নাটকের জগতে আমরা দেখি এক বিস্তৃত ক্যানভাস, যার রঙগুলো গ্রামীণ মাটির সৌরভ, নগরীয় মধ্যবিত্তের উদ্বেগ এবং মানবমনের অসীম কল্পনার মিশ্রণে উজ্জ্বল।
হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যিক যাত্রা শুরু হয় উপন্যাসের মাধ্যমে, যা তাঁর সৃষ্টির মূল স্তম্ভ। তাঁর প্রথম উপন্যাস 'নন্দিত নরকে' থেকেই আমরা লক্ষ্য করি এক অসাধারণ শক্তির উদ্ভাস, যেখানে যৌবনের অস্থিরতা এবং সমাজের দ্বন্দ্ব মিলে এক অস্তিত্ববাদী অনুসন্ধানের রূপ নেয়। এই উপন্যাসে চরিত্রগুলো কেবল ঘটনার অংশ নয়, তারা মানুষের অন্তর্নিহিত বিদ্রোহের প্রতীক, যা পাঠককে প্রশ্ন করে: জীবনের নরক কি বাহ্যিক, নাকি অন্তরের সৃষ্টি? এই থিমটি পরবর্তীকালে তাঁর সৃষ্টিতে আরও গভীর হয়, যেমন 'দেবী' (১৯৮৫) উপন্যাসে, যা বাংলা সাহিত্যে নারীচরিত্রের এক অভূতপূর্ব চিত্রায়ন। এখানে দেবী নামক নারীটি কেবল একটি চরিত্র নয়, সে এক অতিপ্রাকৃত শক্তির অবতার, যার মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদ প্রকাশ করেন মাতৃত্বের পবিত্রতা এবং সমাজের পুরুষতান্ত্রিক বন্ধনের বিরুদ্ধে এক নীরব প্রতিবাদ। উপন্যাসের ভাষা সহজবোধ্য হলেও, তার অন্তর্নিহিত প্রতীকবাদ অত্যন্ত জটিল—দেবীর অলৌকিক ক্ষমতা কি সত্যিকারের, নাকি মানুষের বিশ্বাসের ফসল? এই দ্বৈততা তাঁর সাহিত্যের একটি চিরন্তন বৈশিষ্ট্য, যা পাঠককে বাস্তবতা এবং কল্পনার সীমানায় দাঁড় করিয়ে দেয়।
এই অতিপ্রাকৃতের ছোঁয়ায় মিলিত হয় 'হিমু' সিরিজ, যা হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যে এক বিপ্লবী ধারা। 'কাগজের নৌকা' (১৯৮২) থেকে শুরু করে 'হিমু' (১৯৮৭), 'ময়ূরাক্ষী' (১৯৯২) এবং 'হিমুর হলদি রঙের পোশাক' (২০০৯) পর্যন্ত এই সিরিজে হিমু চরিত্রটি এক অদ্ভুত দার্শনিকের রূপ ধারণ করে। সে একজন অসামাজিক যুবক, যার জীবনযাত্রা সমাজের নিয়মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী—কোনো পেশা নেই, কোনো দায়িত্ব নেই, কিন্তু তার কথায় লুকিয়ে আছে জীবনের গভীরতম সত্য। হিমুর মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদ অন্বেষণ করেন অস্তিত্বের অর্থহীনতা এবং সেইসঙ্গে তার অপার সৌন্দর্য। উদাহরণস্বরূপ, 'ময়ূরাক্ষী'-তে হিমুর সঙ্গিনী ময়ূরাক্ষী এক অন্ধকার রহস্যের প্রতীক, যা জীবনের অন্ধকার দিকগুলোকে আলোকিত করে। এই সিরিজের ভাষা কথ্য, কিন্তু তার অন্তর্নিহিত দর্শন শ্রীঅরবিন্দের মতো আধ্যাত্মিক—হিমু বলে, "জীবনটা একটা খেলা, খেলতে হয় সবাইকে।" এই সরল উক্তিতে লুকিয়ে আছে এক গভীর নীতিকথা, যা পাঠককে সমাজের কৃত্রিমতার বাইরে নিয়ে যায়। হিমু সিরিজের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেন যে সাহিত্য কেবল বিনোদন নয়, এটি একটি জাগরণের হাতিয়ার, যা মানুষকে তার নিজের অস্তিত্বের প্রতি সচেতন করে।
একইভাবে, 'মিসির আলি' সিরিজ তাঁর সাহিত্যে রহস্যের এক নতুন মাত্রা যোগ করে। 'দেবী' (১৯৮৫) থেকে 'নিশীথিনী' (১৯৯৯) এবং 'অন্যভুবন' (২০০৩) পর্যন্ত এই সিরিজে মিসির আলি এক যুক্তিবাদী চিন্তাবিদ, যিনি অতিপ্রাকৃত ঘটনাগুলোকে বিজ্ঞানের আলোয় বিশ্লেষণ করেন। এখানে হুমায়ূন আহমেদের রসায়নশাস্ত্রের পটভূমি স্পষ্ট হয়ে ওঠে—মিসির আলির যুক্তি কেবল ঘটনার ব্যাখ্যা নয়, এটি মানুষের অজানা ভয়ের মুখোমুখি হয়ে তার সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করে। 'নিশীথিনী'-তে একটি ভূতুড়ে গল্পের মাধ্যমে তিনি প্রশ্ন তোলেন: “বিজ্ঞান কি সবকিছুর উত্তর দিতে পারে, নাকি কল্পনা তার চেয়ে শক্তিশালী?” এই সিরিজের আকর্ষণ তার সাসপেন্সে নয়, বরং দার্শনিক গভীরতায়—যেখানে রহস্যের সমাধান কেবল ঘটনার নয়, মানুষের মনের। এইভাবে, তাঁর উপন্যাসগুলো একটি জাল বুনতে থাকে, যার সুতোয় মিলিত হয় যথার্থতা এবং অলৌকিকতা, সমাজ এবং ব্যক্তি, হাস্য এবং বিষাদ।
হুমায়ূন আহমেদের ছোটগল্প সংকলনগুলো এই জালের আরও সূক্ষ্ম অংশ, যা সংক্ষিপ্ততায় অপার গভীরতা লুকিয়ে রাখে। 'অন্তরজ্বালা' (১৯৭২) থেকে শুরু করে 'লীলাবতী' (১৯৮৬) এবং 'আঁধার আলো' (১৯৯৫) পর্যন্ত এই সংকলনগুলোতে আমরা দেখি বাংলা ছোটগল্পের এক নতুন যুগের সূচনা। এখানে গল্পগুলো কেবল ঘটনার সংযোজন নয়, তারা মানুষের দৈনন্দিনতার সূক্ষ্ম অনুভূতির প্রতিফলন—একটি বৃষ্টির দিনের উদাসীনতা, একটি পুরনো বাড়ির রহস্য, বা একটি শিশুর অদ্ভুত কল্পনা। 'লীলাবতী'-তে লীলাবতী চরিত্রটি এক নারীর জটিল মনস্তত্ত্বের প্রতীক, যার মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদ প্রকাশ করেন সমাজের নারী-দমনের নীরব যন্ত্রণা। গল্পের ভাষা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, কিন্তু তার প্রতিটি বাক্যে লুকিয়ে আছে এক অপ্রত্যাশিত টুইস্ট, যা পাঠককে চমকে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, 'আঁধার আলো'-র গল্পগুলোতে অন্ধকার এবং আলোর দ্বন্দ্ব মিলে হয় এক দার্শনিক অনুসন্ধান, যা জীবনের দ্বৈততাকে প্রতিফলিত করে। এই ছোটগল্পগুলোর শক্তি তার সরলতায়—তারা কোনো জটিল কাঠামোর প্রয়োজন রাখে না, কারণ তাদের মূল উৎস মানুষের সাধারণ অভিজ্ঞতা, যা হুমায়ূন আহমেদের কলমে অমর হয়ে ওঠে। এই সংকলনগুলো বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পকে একটি নতুন জনপ্রিয়তা দিয়েছে, যেখানে রবীন্দ্রনাথের গভীরতা এবং শরৎচন্দ্রের যথার্থতা মিলে এক অভিনব রূপ নেয়।
তাঁর সাহিত্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ নাটক এবং চিত্রনাট্য, যা তাঁর কথাসাহিত্যকে মঞ্চ এবং চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বিস্তৃত করে। 'কোথাও কেউ নেই' (১৯৮৬) নাটকে আমরা দেখি গ্রামীণ বাংলার এক অসাধারণ চিত্র, যেখানে চরিত্রগুলোর সংলাপে মিলিত হয় হাস্য এবং বিষাদের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। এই নাটকের ভাষা কথ্য এবং সংলাপপ্রধান, যা পাঠক বা দর্শককে অন্তরঙ্গ অনুভূতিতে আচ্ছন্ন করে। 'বীরটি কমলা' (১৯৮৯) নাটকে কমলা চরিত্রটি এক নারীর সাহসের প্রতীক, যার মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদ সমাজের লৈঙ্গিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক সূক্ষ্ম ব্যঙ্গ করেন। চিত্রনাট্য হিসেবে তাঁর 'আগুনের পরশমণি' (১৯৯৪) উপন্যাসের অভিযোজন দেখায় কীভাবে তিনি সাহিত্যকে দৃশ্যমানতায় রূপান্তরিত করেন—এখানে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে জাতীয়তাবাদী চেতনা মিলে হয় এক ঐতিহাসিক উপাখ্যান, যার ভাষা কাব্যিক কিন্তু যথার্থ। এই নাটক এবং চিত্রনাট্যগুলো তাঁর সাহিত্যের একটি বহিরাগত মাত্রা, যা কেবল পড়ার জন্য নয়, অনুভবের জন্য সৃষ্ট—তারা মঞ্চে উঠে বাঙালির সামূহিক স্মৃতিকে জাগ্রত করে।
হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যিক শৈলীর মূলে রয়েছে এক অসাধারণ সরলতা, যা তার গভীরতাকে আরও উজ্জ্বল করে। তাঁর ভাষা কথ্য বাংলার সঙ্গে সাহিত্যিকতার এক নির্বাঘ মিলন ঘটায়—সংলাপগুলো যেন দৈনন্দিন কথোপকথনের অংশ, কিন্তু তার অন্তর্নিহিত অর্থ অত্যন্ত গভীর। হাস্যরসের ব্যবহার তাঁর একটি অস্ত্র, যা সমাজের দৈন্যকে উন্মোচিত করে; উদাহরণস্বরূপ, 'শঙ্খনীল কারাগার' (১৯৭৩) উপন্যাসে বন্দিত্বের থিম হাস্যের মাধ্যমে এক দার্শনিক মাত্রা লাভ করে। অতিপ্রাকৃত উপাদানগুলো—ভূত, জীবন্ত মূর্তি, অদ্ভুত স্বপ্ন—কেবল বিনোদনের জন্য নয়, তারা মানুষের অজানা ভয় এবং আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। থিমগতভাবে, তাঁর সাহিত্য গ্রামীণ বাংলার রোমান্টিকতা, নগরীয় মধ্যবিত্তের উদ্বেগ এবং নারীচরিত্রের জটিলতায় সমৃদ্ধ। নারীগুলো তার সৃষ্টিতে কেবল পটভূমির অংশ নয়, তারা কেন্দ্রীয়—যেমন 'জোছনা ও জননীর গল্প' (১৯৯৩) উপন্যাসে জননী চরিত্রটি মাতৃত্বের এক অমর চিত্র, যা বিষাদ এবং আশার মিশ্রণে গঠিত। এই থিমগুলো মিলে তাঁর সাহিত্য একটি সামগ্রিক দর্শন সৃষ্টি করে, যা জীবনকে এক অদ্ভুত খেলা হিসেবে উপস্থাপন করে—যেখানে মৃত্যু এবং জন্ম, বিচ্ছেদ এবং মিলনের মধ্যে লুকিয়ে আছে অপার সম্ভাবনা।
তাঁর সাহিত্যের প্রভাব বাংলা কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে অপরিসীম। তিনি শরৎচন্দ্রের পর সেই লেখক, যাঁর কলমে সাধারণ মানুষের গল্প অমর হয়ে ওঠে, কিন্তু তাঁর অভিনবতা অতিপ্রাকৃত এবং দার্শনিকতার মিশ্রণে। 'মধ্যাহ্ন' উপন্যাসে দুপুরের নিস্তব্ধতার মাধ্যমে তিনি সময়ের অস্থায়িত্ব অন্বেষণ করেন, যা পাঠককে তার নিজের জীবনের প্রতি চিন্তাশীল করে। এই প্রভাব উত্তরসূরিদের মধ্যেও দৃশ্যমান—অনেক যুব লেখক তাঁর শৈলী অনুসরণ করে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন, কিন্তু কেউ তাঁর মতো সরল গভীরতা অর্জন করতে পারেননি। তাঁর সৃষ্টি বাংলা সাহিত্যকে এক নতুন যুগে নিয়ে এসেছে, যেখানে সাহিত্য কেবল বুদ্ধিজীবীদের নয়, সকলের—শহরের ছাত্র থেকে গ্রামের কৃষক পর্যন্ত। এই জনপ্রিয়তা কোনো দুর্বলতা নয়, বরং শক্তি; কারণ তাঁর মাধ্যমে সাহিত্য সামাজিক চেতনার এক হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য এক অবিরাম প্রবাহ, যা বাঙালির আত্মাকে স্পর্শ করে। তাঁর কলমে জীবনের সকল রঙ—হাস্যের স্ফুলিঙ্গ, বিষাদের ছায়া, কল্পনার উড়ান—মিলে হয় এক অমর ক্যানভাস। এই সাহিত্য আমাদের শেখায় যে, সত্যিকারের সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে সাধারণতায়, এবং সেই সাধারণতা থেকেই উদ্ভাসিত হয় অসাধারণের আলো। তাঁর সৃষ্টি চিরকাল পাঠকের অন্তরে বেঁচে থাকবে, কারণ এটি কেবল গল্প নয়, এটি জীবনের এক অপূর্ব আয়না।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, সহকারী অধ্যাপক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, আশুলিয়া, ঢাকা।
১৬৬ বার পড়া হয়েছে