সর্বশেষ

মতামত

খাজা পরিবারের আত্মিক উত্তরাধিকার ও ইসলামী দাওয়াহর বহমান ধারা

খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী
খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী

রবিবার, ৯ নভেম্বর, ২০২৫ ৭:১৮ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
নবাব খাজা আহসান উল্লাহ (রহ:) (২২ আগস্ট ১৮৪৬-১৬ ডিসেম্বর ১৯০১) এর যোগ্য উত্তরসূরী খাজা ফয়েজ উদ্দিন (রহ) (১৮৫৪-১৯৫৫) বাংলার সুফি ঐতিহ্যের ইতিহাসে ও “খাজা পরিবার” এর ইতিহাসে এক অনন্য আধ্যাত্মিক ধারা- যেখানে ইসলামী দাওয়াহ, সমাজসংস্কার ও রুহানিয় চেতনা মিলেমিশে এক আলোকিত সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে।

এই পরিবারের আত্মিক উত্তরাধিকার কেবল বংশপরম্পরায় সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি এক সিলসিলা, এক রুহানিয় চেইন, যার মাধ্যমে আল্লাহর হিদায়াত, জ্ঞান ও আখলাক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়েছে।

 

কুরআনের ভাষায়- আমি তাঁদের বংশধরদের মধ্যে নবুয়ত ও কিতাব দান করেছি।
(সূরা আনকাবূত: ২৭)

 

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় স্পষ্ট হয় যে, আল্লাহ তাআলা আত্মিক দায়িত্বকে বংশধারার মধ্য দিয়ে অব্যাহত রাখেন, যেন মানবতা যুগে যুগে হিদায়াতের আলোয় উদ্ভাসিত হয়।

খাজা ফয়জ উদ্দিন (রহঃ) এবং তাঁর উত্তরসূরিদের জীবন সেই ঐশী ধারারই বাস্তব রূপ- যেখানে সুফিবাদ ও সমাজসেবার মেলবন্ধনে দাওয়াহর এক মানবিক ও নৈতিক জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। এই নিবন্ধে আমরা সেই আত্মিক উত্তরাধিকার, সিলসিলার ধারাবাহিকতা, ওসিয়াতের নৈতিক তাৎপর্য এবং সুফি দাওয়াহর দর্শনকে ইসলামী ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

খাজা ফয়জ উদ্দিন (রহঃ) বাংলার রুহানিয় জাগরণের এক পথিকৃৎঃ
১৮০০ শতাব্দীতে ব্রিটিশ শাসিত অবিভক্ত বাংলা ও দক্ষিণ অঞ্চলে আসাম,চব্বিশ পরগনা,পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা মেঘালয়, বঙ্গ দেশে হযরত শাহসুফী খাজা ফয়জ উদ্দিন (রহঃ) ছিলেন আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের প্রতীক। তাঁর রুহানিয় শিক্ষা কাদরিয়া তরিকার আদর্শে অনুপ্রাণিত, যার উৎস হযরত বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ)-এর প্রতিষ্ঠিত কাদরিয়া তরিকা।

 

তাঁর দাওয়াহ দর্শনের মূল ভিত্তি ছিল চারটি নীতি:

 

১. নফসের মোজাহাদা (spiritual self-discipline)
২. খালেস ইবাদত
৩. সমাজে ন্যায় ও মানবতা প্রতিষ্ঠা
৪. আন্তধর্মীয় সহাবস্থান ও দয়া

তাঁর খানকাহ ছিল এক আধ্যাত্মিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখানে ধর্মীয় জ্ঞান ও সামাজিক নৈতিকতার এক সমন্বিত চর্চা চলত। ঐতিহাসিক সূত্রে দেখা যায়, ১৮০০ শতাব্দীতে বরিশাল অঞ্চলে সুফি দরবারগুলোর মধ্য দিয়ে ইসলাম প্রচার ও সামাজিক সংস্কারের ধারাটি পুনরুজ্জীবিত হয়। খাজা ফয়জ উদ্দিন (রহঃ) সেই নবজাগরণের অন্যতম অগ্রপথিক।

সিলসিলার আত্মিক চেইন ও দাওয়াহর ধারাবাহিকতাঃ

তাসাউফে “সিলসিলা” মানে হলো সেই চেইন যা শায়খ থেকে মুরিদ, এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আত্মিক আলোক স্থানান্তর করে। ইমাম আল-কুশাইরি তাঁর রিসালাতুল কুশাইরিয়াতে বলেন-  আল-সিলসিলা হিয়াল-ইত্তিসাল বাইনাল কুলুব- “সিলসিলা হলো হৃদয়সমূহের মধ্যে সংযোগের বন্ধন।”

খাজা পরিবারের এই সিলসিলা রক্তের নয়, রুহানিয় সংযোগের ধারা- যেখানে আত্মিক দায়িত্ব হস্তান্তরিত হয় এক মুর্শিদের ওসিয়াতের মাধ্যমে। ২০১৭ সালের সেই ফজরের পরে নিজ পিতার ওসিয়াত এই ধারারই জীবন্ত প্রতিফলন ঘটে জীবনে, যেখানে পিতা পুত্রকে বলেন- বাবা, আমার মৃত্যুর পরে তুমি এই সিলসিলা ধরে রেখে দ্বীন ও ধর্মের খেদমত করে যাবে।

এই ওসিয়াত শুধু পারিবারিক আদেশ নয়, বরং এটি আল্লাহর পথে আহ্বান- যার দায়িত্ব নবুয়তের উত্তরাধিকারীদের ওপর ন্যস্ত।

ওসিয়াত ও তাসাউফ-দায়িত্বের পাশাপাশি প্রেমের পরীক্ষাঃ
তাসাউফের ভাষায় ওসিয়াত মানে শুধুই নির্দেশ নয়, এটি প্রেম ও বিশ্বাসের পরীক্ষা।

ইমাম গাজ্জালী তাঁর ইহইয়া উলুমুদ্দিন-এ বলেছেন-আল-মুহাব্বাহ লা তাকুনু সত্যা ইল্লা ইযা তুবতালাঃ “ভালোবাসা সত্য হয় না, যতক্ষণ না তা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়।”

খাজা পরিবারের উত্তরাধিকার এই পরীক্ষারই ফল। পিতা যেমন সন্তানকে দায়িত্ব দিয়েছেন, তেমনি তাকে কঠিন পথে হাঁটতেও প্রস্তুত করেছেন। দাওয়াহ মানে শুধু প্রচারণা নয়; এটি নফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, ধৈর্যের পরীক্ষা, এবং তাওয়াক্কুলের অনুশীলন।

 

এই দর্শনের প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় কুরআনের এই আয়াতে— إِنَّ اللّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ (সূরা বাকারা: ১৫৩)। অর্থাৎ দাওয়াহর শক্তি আসে ধৈর্য থেকে, আর ধৈর্যের উৎস রুহানিয় প্রেম।

মায়ের দোয়া ও রুহানিয় সুরক্ষাঃ

তাসাউফে বলা হয়- “দোয়া-ই-ওয়ালিদাইন জাবাতুল আসমান” (পিতামাতার দোয়া আসমানের আহ্বান)। খাজা পরিবারের ইতিহাসে এই ধারণা জীবন্ত। পরহেযগার মা ও তাহাজ্জুদগোজার বাবা-মায়ের কান্না ও দোয়া সন্তানদের আত্মিক ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে আমার জিবনে।

 

কুরআনে বলা হয়েছে- আত্-তাকওয়া তানজিলুল বালা- পরহেযগারি ও দোয়ার মাধ্যমে বিপদ দূর হয়। এ ধারণা শুধু তত্ত্ব নয়, বরং বাস্তব অভিজ্ঞতা, যা লেখকের জীবনে প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর মা-বাবার দোয়ার ফলস্বরূপ।

বাংলার সুফি সমাজে খাজা পরিবারের ভূমিকাঃ

বাংলার ইসলামায়নের ইতিহাসে সুফিদের ভূমিকা ছিল কেন্দ্রীয় চন্দ্রদ্বীপ অঞ্চলে সুফি পীরগণ স্থানীয় সমাজে মানবিকতা, শিক্ষা, ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার সংস্কৃতি গড়ে তোলেন। খাজা পরিবার সেই ধারার উত্তরসূরি হিসেবে শুধু খানকাহ পরিচালনা করেননি, বরং আধুনিক প্রেক্ষাপটে ইসলামী দাওয়াহকে সামাজিক সংস্কারের সঙ্গে যুক্ত করেছেন।

 

এই ধারার বৈশিষ্ট্য তিনটি স্তরে বিভক্ত-
১. আত্মিক স্তর: নফস ও রুহের শুদ্ধি
২. সামাজিক স্তর: দাওয়াহ ও মানবসেবা
৩. নৈতিক স্তর: সত্য, ধৈর্য ও তাওয়াক্কুল

এই তিন স্তরের সমন্বয়েই খাজা পরিবারের দাওয়াহ দর্শন গঠিত। খাজা পরিবারের আধ্যাত্মিক ধারা প্রমাণ করে- রুহানিয় উত্তরাধিকার কেবল রক্তের সম্পর্ক নয়, বরং এটি আত্মার এক সেতুবন্ধন। পিতা-মাতা, মুর্শিদ-মুরিদ, এবং শিক্ষক-শিষ্যের সম্পর্কের মধ্য দিয়েই এই দাওয়াহ প্রবাহিত হয় যুগে যুগে।

এই সিলসিলা টিকে আছে ধৈর্য, প্রেম, ও খেদমতের ওপর- 

যেমন খাজা ফয়জ উদ্দিন (রহঃ) বলেছেন- দাওয়াহ মানে কাউকে জোর করা নয়; বরং তার অন্তরে আল্লাহভীতি জাগানো।

আজকের বিশ্বে যেখানে ধর্মীয় বিভাজন ও নৈতিক অবক্ষয় প্রকট, সেখানে এই সিলসিলা এক আলোকবর্তিকা। এটি আমাদের শেখায়- দায়িত্ব পেলে গর্ব নয়, বরং ভয় করা শিখো। কারণ সিলসিলা মানুষের নয়, এটি আল্লাহর আমানত।

 


লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক, বেসরকারি গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক এবং ব্রাক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘদিনের কর্ম-অভিজ্ঞ।

১৪১ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন