শূন্য থেকে ইতিহাস- জোহরান মামদানির নিউইয়র্ক জয়
বৃহস্পতিবার , ৬ নভেম্বর, ২০২৫ ৪:০৮ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
নিউ ইয়র্ক সিটি- বিশ্বের অর্থনীতির ইঞ্জিন। এই শহরের ইতিহাসে ২০২৫ সালে এক অনন্য মাইলফলক তৈরি করেছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত উগান্ডার কাম্পালাতে জন্ম নিয়ে আমেরিকায় আসা মুসলিম-খৃষ্টান-হিন্দু-ইহুদি মিলনের প্রতীকের মতো তরুণ নেতা- জোহরান মামদানি। যাঁর হাতে আজ নিউইয়র্কের নেতৃত্ব, যাঁর যাত্রা সত্যিই শূন্য থেকে একশোতে গিয়ে ঠেকেছে।
নির্বাচনের শুরু: মাত্র ১% থেকে উত্থান
মাত্র এক বছর আগে, নির্বাচনী প্রচারণার শুরুতে মামদানিকে জনমত সমীক্ষাগুলোতে মাত্র ১% ভোটের সমর্থনে দেখা যাচ্ছিল। বড় কোনো ডোনার বা কর্পোরেট অনুদান ছাড়াই, আত্মবিশ্বাস আর বিরাট স্বপ্ন নিয়েই তিনি বাড়ি-বাড়ি ঘুরেছেন- নিজ হাতে প্রচারপত্র বিলিয়েছেন, রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলেছেন, “এই যে, প্রচারপত্র নেবেন? সিটি নির্বাচন সম্পর্কে একটু শুনবেন?” অনেকেই তখনো তাঁর নাম জানতেন না; তাঁর পথ একেবারেই ছিল সাধারণ মানুষের আন্দোলনের পথ।
মানুষের আসল সমস্যার কথা ও ভূমিধস বিজয়
ভোটারদের হৃদয় জয় করতে তিনি তুলে ধরেছেন দৈনন্দিন আসল সমস্যা: উচ্চ ভাড়া, গণপরিবহন দুর্বলতা, অপর্যাপ্ত শিশু যত্ন ও ব্যয়বহুল শিক্ষা। মামদানির স্পষ্ট কথা- ”আমি ভাড়া কমানোর কথা বলছি, দেশের সবচেয়ে ধীরগতির বাসগুলোকে দ্রুত আর নিখরচায় করার কথা বলছি, সবার জন্য সার্বিক চাইল্ডকেয়ার চালু করার কথা বলছি।” - লাখো মানুষের মনে গেঁথে যায়। তাঁর নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল: ৬০ লাখ বাসিন্দার জন্য ‘রেন্ট ফ্রিজিং’ (বাসা ভাড়ায় স্থবিরতা), কম আয়ের মানুষের জন্য ২ লাখ নতুন বাসা, শহরের প্রতিটি মানুষকে ফ্রি বেবি কেয়ার, সব MTA বাস ফ্রি, উচ্চআয়ের নাগরিক ও কর্পোরেটের জন্য করবৃদ্ধির মাধ্যমে সেবা খাতে বিনিয়োগ এবং নগর জীবনে বৈষম্যহীন, নিরাপদ, অভিবাসীবান্ধব পরিবেশ।
বাধা, ষড়যন্ত্র ও নেতিবাচক প্রচার
তাঁর বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর নেতিবাচক প্রচার হয়েছে। প্রচারিত হয়েছে তাঁর মুসলিম পরিচয়, ৯/১১-র প্রসঙ্গ টেনে বিভাজন। ‘ইমিগ্রান্ট,’ ‘কমিউনিস্ট’ আখ্যা দিয়ে ট্রাম্প ও প্রচলিত মিডিয়া বারবার অপপ্রচারে লিপ্ত ছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় খাওয়ার ছবি, ধর্মীয় পরিচয়, গাজা প্রশ্ন নিয়ে যত রকম বিদ্বেষ ছড়ানো সম্ভব- সবকিছু তাঁকে ঘিরে কেন্দ্রিক হয়েছে। তীব্র ইসলামোফোবিয়া, বহিরাগত তকমাসহ নানা ফেক ভিডিও দিয়ে এএফপিও তাকে পথচ্যুত করার চেষ্টা করেছে।
মাথা নিচু না করেই প্রচারণা
জোহরান মামদানি তাঁর বিশ্বাসকেও আত্মপ্রকাশে কখনো সংকোচ করেননি; বরং তিনি প্রকাশ্যেই মুসলিম পরিচয় ও ঐতিহ্য নিয়ে গর্বিত লড়াই করেছেন। নগরবাসীর সঙ্গে একত্ব হয়ে, মাথা উঁচু করে, বীরের মতো সালাম দিয়ে সকল ধর্ম-বর্ণ, পেশাজীবীর মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। হাসপাতালের নার্স, স্কুলশিক্ষক, বাসচালক, ট্যাক্সি ড্রাইভার, বিত্তবানের পাশাপাশি নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী- সবাইকে তিনি নিজ জীবনের কাহিনী, সংগ্রাম, এবং আন্তরিকতা জানাতে পিছপা হননি। নিউ ইয়র্কের বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজে, তিনি ধর্মের গণ্ডী পেরিয়ে সকল সম্প্রদায়ের জন্য সংহতি, ন্যায্যতা আর হৃদয়ের বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন, যা তাঁকে জীবন্ত গণতন্ত্রের প্রতীক ও সকল নাগরিকের “আপনজন” করে তুলেছে।
না থেমে এগিয়ে চলা, মূল্যবোধে অবিচল
তবুও মামদানি থেমে যাননি। সংহতির রাজনীতি ও মানবিক মূল্যবোধ থেকে একবিন্দু সরেননি। তিনি গাজা ইস্যুতে নিরাপত্তাহীনতায় থেকেও স্পষ্ট বক্তব্য রেখেছেন, বলেছেন, “নিউ ইয়র্ক শহরের জনগণের মূল্যবোধ আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত, আমাদের কাজও তেমনি হওয়া উচিত।” - এমন বার্তা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে বিরল।
চূড়ান্ত হিসেব: ভোটের ফলাফল ও প্রতিদ্বন্দ্বীরা
৩ নভেম্বরের নির্বাচনে মোট ১,৮৭৮,৫৪০ ভোট গণনা হয়েছে। মাত্র এক বছর আগের ১% থেকে মামদানির প্রাপ্ত ভোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৪৮,২০২ (৫০.৫%)। দ্বিতীয় স্থানে সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুয়োমো পেয়েছেন ৭৭৬,৫৪৭ (৪১.৩%) ও রিপাবলিকান কার্টিস স্লিওয়া ১৩৭,০৩০ (৭.৩%)। তাঁর বিজয় ভাষণে তিনি জওহরলাল নেহরুর কথা ও ভারতীয় “ধুম” ছবির গান বাজিয়ে নতুন প্রজন্ম-সহ বৈচিত্র্যের জয়োল্লাস করেন।
শেষ কথা: বৈচিত্র্যের হৃদয়ে, সংহতির শহরে
নিউ ইয়র্ক সিটির ইতিহাসে মামদানির এই বিজয় শুধু নির্বাচন নয়- এ এক সামাজিক আন্দোলন, বহুত্ববাদের জয়। মুসলিম পরিচয় হয়েও আন্তঃধর্মীয় সোহার্দ্য, মূল্যবোধে অবিচলতা, শ্রমজীবী মানুষের পাশে থাকা আর অদম্য লড়াই- এসবই আজ তাঁকে লাখো মানুষের হৃদয়ের নেতা করে তুলেছে। তাঁর জয় তাই শুধু একজন অভিবাসী মুসলিম তরুণের কথা নয়- নিউইয়র্কের গণতন্ত্র, বৈচিত্র্য, সমানাধিকারের সত্যিকারের সংজ্ঞা।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
১১৮ বার পড়া হয়েছে