সর্বশেষ

সাহিত্য

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্যের ত্রিবেণী-সংগম: অস্তিত্বের ক্ষত, মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান ও হিরন্ময় তাৎপর্য

গাউসুর রহমান 
গাউসুর রহমান 

মঙ্গলবার, ৪ নভেম্বর, ২০২৫ ৫:০১ অপরাহ্ন

শেয়ার করুন:
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের আবির্ভাব ঘটে, যখন দেশভাগের ঐতিহাসিক অভিঘাত বাঙালি সমাজকে গভীর আর্থ-সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক সংকটে নিমজ্জিত করেছিল।

ময়মনসিংহে জন্ম এবং পিতার রেলের চাকরি সূত্রে শৈশবে দীর্ঘকাল অসম, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের বিভিন্ন স্থানে যাযাবর জীবন অতিবাহিত করা  লেখকের মানসলোকে এক সূক্ষ্ম বিষাদ, অস্থিরতা এবং জীবনজিজ্ঞাসার বীজ রোপণ করে। দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, উদ্বাস্তু আগমন ও একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙনের মতো বাস্তব অভিজ্ঞতাই তাঁর সাহিত্যকে সমৃদ্ধিদান করেছে। ফলস্বরূপ, তিনি শুধু জীবনের বাস্তব চিত্রকর নন, বরং "মায়াবী দৃষ্টিসম্পন্ন আধুনিক যুগযন্ত্রণার কথাকোবিদ" হিসেবে বাংলা সাহিত্যে এক স্বতন্ত্র ও কালজয়ী আসনে প্রতিষ্ঠিত। 

​শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্যিক প্রজ্ঞা মূলত তিনটি মৌলিক উপাদানের সফল মিশ্রণে নিহিত: প্রথমত, জীবনের মূল অর্থ ও তাৎপর্য অনুসন্ধানের তীব্র জীবনবোধ; দ্বিতীয়ত, মানব মনের জটিলতা, নৈতিকতার দ্বন্দ্ব ও অবক্ষয়ী বাঙালি মধ্যবিত্তের মনস্তাত্ত্বিক ব্যবচ্ছেদ; এবং তৃতীয়ত, আধ্যাত্মিক মুক্তি সন্ধানের জন্য পরাবাস্তবতা ও অলৌকিক উপাদানের শৈল্পিক ব্যবহার। তাঁর রচনার মূল কাঠামোটি নির্মিত হয়েছে সাবলীল, স্বচ্ছন্দ ও ঘরোয়া গদ্যশৈলীর উপর , যা পাঠককে গল্পের অভ্যন্তরীণ জগতে অনায়াসে প্রবেশাধিকার দেয়। 

​শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্যিক অভিযাত্রার প্রথম শিখর হলো তাঁর প্রথম উপন্যাস 'ঘুণপোকা' (১৯৬৭)। এই উপন্যাসটি ষাটের দশকের কলকাতা শহরের বেকারত্ব, হতাশা এবং আত্ম-বিচ্ছিন্নতার পটভূমিতে রচিত এক অস্তিত্ববাদী দলিল। 

​'ঘুণপোকা'-র কেন্দ্রীয় চরিত্র শ্যাম, ত্রিশোর্ধ্ব এক বেকার যুবক। তার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এক তীব্র আত্মসম্মানবোধ। এই আত্মসম্মানের কারণেই সে অফিসের বসের অপমান সহ্য করতে না পেরে চাকরি ছেড়ে দেয় । এই সিদ্ধান্তের পর, সে নগরজীবনে এক গভীর একাকীত্ব ও আত্ম-বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়। 

শ্যামের এই আত্ম-বিচ্ছিন্নতা কেবল আর্থিক দৈন্যের ফল নয়, বরং তা চেতনার নৈরাজ্য এবং অস্তিত্বের অর্থহীনতা অনুধাবনের প্রতীক। তার জীবনে কোনো স্থির লক্ষ্য নেই, আছে কেবল এক অস্থিরতা, এক অব্যক্ত শূন্যতা। 

​লেখক স্বয়ং যুবক শ্যামকে চিত্রিত করেছেন- "শীর্ণকায়, ছোট করে ছাঁটা চুল, ঘোর অন্যমনস্ক এবং দিশাহীন চোখ" রূপে । এই বর্ণনা কেবল তার শারীরিক অবস্থাই তুলে ধরে না, এটি তার ভেতরের নৈরাশ্য ও গন্তব্যহীনতার দৃশ্যরূপ। শ্যামের এই চরিত্রটি ফরাসি অস্তিত্ববাদীদের 'Alienation' বা বিচ্ছিন্নতাবোধের সমতুল্য। সে সামাজিক স্বীকৃতি বা প্রতিষ্ঠানের লোভ না করে নৈতিক আদর্শ বজায় রাখতে চায়, কিন্তু এর চরম মূল্য হিসেবে তাকে বেছে নিতে হয় চরম অসহায়ত্ব। তার মধ্যে কাজ করে এক ধরণের নিষ্ক্রিয় নেতিবাদ (Passive Nihilism), যেখানে জীবনের উদ্দেশ্যহীনতা উপলব্ধি করে সে কর্মবিমুখ হয়ে পড়ে। বস্তুত, শ্যাম চরিত্রটি স্বাধীনতা-উত্তর বাঙালি মধ্যবিত্তের সেই সংকটকে তুলে ধরে, যেখানে মূল্যবোধ বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টা ব্যক্তিকে অস্তিত্বের শূন্যতার দিকে ঠেলে দেয়। 

​'ঘুণপোকা'-এর সৃষ্টি প্রক্রিয়াও শ্যামের মনস্তত্ত্বের প্রতিফলন ঘটায়। লেখক স্বীকার করেছেন, এই উপন্যাস লেখার সময় তিনি নিজেও একটি মানসিক সংকটে ছিলেন। লেখালেখি ছিল "সম্পূর্ণ পরিকল্পনাহীন" , ঠিক যেমন শ্যামের জীবন চলছিল কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া। এই পরিকল্পনাহীনতা একটি শিল্পরূপ তৈরি করেছে, যা সাহিত্যিক কাঠামো এবং বিষয়বস্তুর মধ্যে এক গভীর সম্পর্ক তৈরি করে। লেখক যখন ভাবতেন, "লিখে কিছু হয় না," তখন লেখা ছাড়া তাঁর অন্য কোনো পন্থাও ছিল না —এটিই যেন শ্যামের জীবনের দ্বিধা-দ্বন্দ্বের প্রতিচ্ছবি। উপন্যাসের এই স্থায়িত্ব এবং এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এক তরুণের আত্মহত্যার ঘটনা প্রমাণ করে যে শ্যামের সংকট নিছক কাল্পনিক ছিল না, বরং তা ছিল তৎকালীন সমাজের গুরুতর মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতের প্রতীক। 

​শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তাঁর পরবর্তী রচনাগুলিতে জীবনের জটিল মনস্তত্ত্ব নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি গভীর সহমর্মিতা বজায় রেখেও  মানুষের মনের অন্ধকার দিক, দ্বন্দ্ব এবং অবক্ষয়দীর্ণ দৈনন্দিনতা নিয়ে নির্মোহভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁর সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত উপন্যাস 'মানবজমিন'-এ সম্পর্কের ক্ষণস্থায়ীত্ব, লোভ, ত্যাগ, পাপ ও পুণ্যের এক জটিল রসায়ন বর্ণিত হয়েছে। তিনি যেন মানব-চরিত্রের ভেতরের সেই আদিম 'জমিন'-এর খোঁজ করেন, যেখানে সকল ভালো-মন্দের বীজ লুকানো থাকে। 

​শীর্ষেন্দুর মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধানের এক ব্যতিক্রমী এবং বহুল জনপ্রিয় রূপ হলো তাঁর সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্র শবর দাশগুপ্ত। শবর চিরাচরিত গোয়েন্দা চরিত্রের ছক থেকে বেরিয়ে এসে এক সংবেদনশীল মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি কেবল অপরাধের রহস্যভেদ করেন না, বরং অপরাধীর মনস্তত্ত্ব ও তার মানবিক দিকটি বোঝার চেষ্টা করেন । শবর দাশগুপ্তকে চিত্রিত করা হয়েছে—'বিষণ্ণ, ভাবুক, স্মৃতিমেদুর, নরম, কিন্তু ভেতরে খাঁটি ইস্পাত' রূপে। এই চরিত্রায়ন তাঁকে অপরাধের কঠোর বাস্তবতা এবং মানবিক দুর্বলতার মাঝে এক জটিল সেতু তৈরি করতে সাহায্য করে। শবর মূলত 'ফিলোসফিক্যাল ডিটেকটিভ'। তাঁর রহস্য কাহিনিগুলি কেবল 'চোর-পুলিশের খেলার থেকে অনেক বড়ো, অনেক ব্যাপ্ত' হয়ে ওঠে  এবং এক দার্শনিক মাত্রা লাভ করে। 

 

রহস্য উন্মোচনের পর পাঠকের মনে এক ধরণের গভীর দুঃখ ও সহানুভূতি ছেয়ে যায় , কারণ শবর দেখান যে অপরাধ প্রায়শই মানব-মনের অনিবার্য দুর্বলতার ফল, কোনো যান্ত্রিক ধাঁধার সমাধান নয়। 

​যদি শ্যামকে অস্তিত্বের সংকটে ভোগা নিষ্ক্রিয় চরিত্র হিসেবে দেখা হয়, তবে শবর সেই একই অস্তিত্ববাদী দর্শনের (একাকী, বিষণ্ণ, চিন্তাশীল) সক্রিয় রূপ। শ্যাম সমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল; শবরও (একাকী, বিষণ্ণ) আত্ম-বিচ্ছিন্নতার শিকার। তবে তিনি সমাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে না নিয়ে, বরং অপরাধের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমাজের অন্ধকার দূর করার চেষ্টা করেন। শবর তাঁর প্রথম দিকের কাহিনি ‘ঋণ’-এ বিশুদ্ধ সংলাপভিত্তিক আখ্যান কাঠামো ব্যবহার করেন , যা চরিত্রদের পারস্পরিক মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন এবং চেতনার অভ্যন্তরীণ স্রোতকে সরাসরি উন্মোচন করতে অত্যন্ত কার্যকরী। শবর দাশগুপ্তের মধ্য দিয়ে শীর্ষেন্দু প্রমাণ করেছেন যে, অপরাধ সাহিত্যও জীবনের গভীরতম দার্শনিক প্রশ্নগুলির বাহন হতে পারে। 


অন্যদিকে ​'পার্থিব' উপন্যাসটি  শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্যিক দর্শন ও জীবনবোধের এক বিশাল ক্যানভাস। এটি তাঁর মনস্তাত্ত্বিক ও অস্তিত্ববাদী অনুসন্ধানের চূড়ান্ত পর্যায়, যেখানে জাগতিক বাস্তবতা পরাবাস্তব অনুসন্ধানের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। উপন্যাসটি 'জীবন ও জগতের এক অনন্য উপাখ্যান'। 

​'পার্থিব' উপন্যাসের বিশালত্ব এবং বহুমাত্রিকতা পাঠকের কাছে প্রথমত মনোযোগ আকর্ষণ করে। এটি বৃহদায়তন, যা শহর-গঞ্জ-গ্রামকে পরিব্যাপ্ত করে অজস্র মানুষের জীবনপ্রবাহকে ধারণ করে । উপন্যাসের কাঠামোটি বহু-স্তরীয় এবং অসংখ্য চরিত্রের জীবনের জটিল আন্তঃসম্পর্ক  সৃষ্টি করে। কাহিনি শুরু হয় বিষ্ণুপদ নামে এক বৃদ্ধের ভাঙা ঘরের দাওয়া থেকে, যা সনাতন গ্রামীণ জীবনের অবক্ষয়ের প্রতীক। 

​বিষ্ণুপদের তিন পুত্র কৃষ্ণজীবন, রামজীবন, বামাচরণ, কন্যা বীণাপাণি ও তার স্বামী নিমাই—একদিকে এই চরিত্ররা। অন্যদিকে, হেমাঙ্গ, চারুশীলা, চয়ন, ঝুমাদি, অনু-সহ অসংখ্য চরিত্র আধুনিক শহুরে জীবনের দ্বন্দ্ব, সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং আধ্যাত্মিক শূন্যতা নিয়ে কাজ করে। এই উপন্যাসে সনাতন ঐতিহ্যবাহী স্বাদেশিক প্রেক্ষাপটে আধুনিক সভ্যতার দ্বন্দ্বদীর্ণ চিত্রণ করা হয়েছে। অসংখ্য চরিত্রের ভিড়েও প্রতিটি চরিত্র স্বকীয়তা বজায় রাখে। লেখক যেন দেখিয়েছেন, জীবনের এই জটিল প্রবাহ এক 'অনিকেত পরিণতির আশ্চর্য মোহনা'। 


​'পার্থিব'-এর মূল সুর হলো জীবনের শাশ্বত জিজ্ঞাসা: "জীবন কেন? এই জীবনের অর্থ কী, কেনই বা তা শুধুমাত্র বেঁচে থাকা? নাকি এর গভীরে নিহিত আছে কোনও হিরন্ময় তাৎপর্য?"। উপন্যাসটি এই সনাতন প্রশ্নগুলিরই স্থির উত্তর-অন্বেষণ। এই অন্বেষণই চরিত্রদেরকে জাগতিক রূঢ়তা থেকে আধ্যাত্মিক উপলব্ধির দিকে চালিত করেছে। 

​এই উপন্যাসে জীবনের অন্তর্নিহিত গুরুত্ব ও তাৎপর্য, মহাবিশ্বের সাথে মানবের সম্পর্ক প্রভৃতি প্রশ্ন বারবার পাঠককে বিচলিত করে । জীবনের অর্থহীনতার বিপরীতে তিনি এই 'হিরন্ময় তাৎপর্য'-এর সন্ধান করেছেন। ​‘পার্থিব’-এ শীর্ষেন্দুর পরাবাস্তবতার ব্যবহার এক গভীর দার্শনিক উদ্দেশ্য সাধন করে। এই উপন্যাসের অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন চরিত্র আনন্দমোহন  কোনো আকস্মিক চমক সৃষ্টি করে না। বরং এই অলৌকিক উপাদানগুলি অতি সহজে জীবনের স্বাভাবিক অঙ্গ হয়ে ওঠে, যা চরিত্রদের জীবনের 'অদেখা নানান রূপ-বর্ণ-ছন্দ' উন্মোচন করে।
 
​আনন্দমোহনের মতো অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন চরিত্ররা বস্তুত জাগতিক মোহের বাইরে এক অভ্যন্তরীণ পথের নির্দেশক হিসেবে কাজ করে। লেখকের মতে, মানুষের মনে অন্ধকার দূর করার জন্যই বাইরে আলোর দরকার, আর সেই আলো আসে ভিতর থেকে। পরাবাস্তব উপাদানগুলি সেই 'ভিতরের আলো' সন্ধানের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে, যা জগৎকে কেবল যুক্তি ও বিজ্ঞানের নিয়মে আবদ্ধ না রেখে তার সূক্ষ্ম, আধ্যাত্মিক স্তরটিতে মুক্তি বা সান্ত্বনা খুঁজে বের করতে সাহায্য করে।
​কৃষ্ণজীবনের নতুন প্রবন্ধ লেখার মাধ্যমে উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটে, যেখানে তিনি অতীত-স্মৃতি, জীবন-জগতের নানা ভাবনায় মোহাচ্ছন্ন হয়ে সম্মোহিতের মতো লিখে চলেছেন—এটি কেবল সমাপ্তি নয়, বরং 'শেষ থেকেও মিলবে এক নতুন শুরুর সম্ভাবনা'-র এক দ্যোতনা। এই সমাপ্তি জীবনের চক্রাকার গতি, আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান এবং জীবনের ‘হিরন্ময় তাৎপর্য’-এর চিরন্তন প্রবাহকে নির্দেশ করে। 

​শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্যিক যাত্রা হলো অস্তিত্বের সমস্যা থেকে আধ্যাত্মিক সমাধানে উত্তরণের এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।'ঘুণপোকা'-এর শ্যাম তার উচ্চ আত্মসম্মানবোধের কারণে চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল এবং নিষ্ক্রিয় নেতিবাদে নিমজ্জিত হয়েছিল। সে যেন সমাজের চোখে এক ব্যর্থ মানুষ। অন্যদিকে, শবর দাশগুপ্ত সেই একই মানসিক চাপ ও বিচ্ছিন্নতা ধারণ করলেও তা প্রয়োগ করেছেন সমাজ ও অপরাধের গভীর ব্যবচ্ছেদে, যা নিষ্ক্রিয়তা থেকে সক্রিয়, সংবেদনশীল পর্যবেক্ষণে উত্তরণের প্রতীক। আর 'পার্থিব' মহাকাব্যটি এই দুই প্রান্তিকতার মধ্যে এক সেতুবন্ধন—যা জাগতিক জীবনের সমস্ত দ্বন্দ্বকে স্বীকার করে নিয়েও আধ্যাত্মিক মুক্তির পথ অনুসন্ধান করে। 

​শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্যের কালজয়ী মর্যাদার মূলে রয়েছে তাঁর অনন্য গদ্যশৈলী এবং মানবীয় অনুভূতিগুলিকে চিত্রিত করার বিশেষ ক্ষমতা। তাঁর গদ্যে শ্লেষ, বুদ্ধিদীপ্ততা, জীবনবোধ, মানবিকতাবোধ ও অস্তিত্ববাদের মায়াময় ইঙ্গিত রয়েছে। ​দুঃখ-যন্ত্রণা ও আর্তির লেখচিত্রণে তিনি এক ধরণের নির্মোহ নির্লিপ্তি  বজায় রাখেন, অথচ এর অন্তরালে লুকিয়ে থাকে চরিত্রদের প্রতি গভীর সহমর্মিতা এবং আত্মজনসুলভ একাত্মতা। তাঁর ভাষা কৃত্রিমতা থেকে মুক্ত এবং জীবন থেকে নেওয়া , তাই তাঁর রচনা পাঠকের কাছে 'জীবনের অঙ্গ হয়ে যায়', যেখানে পাঠককে আলাদা করে মিশিয়ে নিতে হয় না। 

​তাঁর সাহিত্যের এই শৈলীগত ঐক্য তাঁকে কেবল পরিণত পাঠকের কাছেই নয়, কিশোর সাহিত্যেও কিংবদন্তীর আসনে বসিয়েছে । তাঁর সৃষ্ট ভূতেরা সাধারণত নিরীহ, মানবিক এবং মজাদার। তারা ভয়ের চেয়ে বেশি বন্ধুত্বের আহ্বান জানায়, যা প্রমাণ করে যে লেখকের পরাবাস্তবতার মূল উদ্দেশ্য কখনও যুক্তিকে লঙ্ঘন করা নয়, বরং মানবিক মূল্যবোধ এবং জীবনের সহজ রসিকতা প্রতিষ্ঠা করা।

​ 
​শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্য আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যে এক গভীর ও অপরিহার্য স্থান দখল করে আছে। তাঁর রচনা প্রমাণ করে যে সরল, ঘরোয়া গদ্যের মাধ্যমেও মানব-অস্তিত্বের সবচেয়ে জটিল দার্শনিক এবং মনস্তাত্ত্বিক প্রশ্নগুলিকে গভীর ব্যঞ্জনার সঙ্গে উত্থাপন করা সম্ভব। দেশভাগ-উত্তর অস্থিরতা থেকে শুরু করে একবিংশ শতাব্দীর মানুষের অস্তিত্বের সংকট পর্যন্ত, তিনি সর্বদা সেই আদিম 'জমিন'-এর খোঁজ করেছেন, যা মানবিক সংঘাত ও আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসার উৎস।

​শ্যামের আত্ম-বিচ্ছিন্নতা থেকে শুরু করে পার্থিবের মহাজাগতিক অনুসন্ধান এবং শবরের সংবেদনশীল মনস্তাত্ত্বিক ব্যবচ্ছেদ—এই তিনটি ধারা একত্রে কাজ করে আধুনিক বাঙালি পাঠকের জন্য এক গভীর স্বস্তি সন্ধানের  পথ তৈরি করেছে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্ররা যেমন বাস্তবের রূঢ়তার শিকার হয়, তেমনই তারা মুক্তি বা অর্থের খোঁজে থাকে। ​তিনি জীবনকে দেখেছেন কখনো সোনালি ডানার চিলের মতো, কখনো তীক্ষ্ণচক্ষু ঈগলের মতো, কখনো বা কস্তুরীমৃগের মতো। তাঁর লেখনী যাত্রা করে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে এক উজ্জ্বল আলোকময় নব দিগন্তের নতুন পথের দিকে। তাঁর সাহিত্যের এই ত্রিবেণী-সংগমই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে এক বহমান নদী  এবং বাংলা সাহিত্যের এক কালজয়ী শিল্পীতে পরিণত করেছে।

লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট এবং সহকারী অধ্যাপক (বাংলা) এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, আশুলিয়া, ঢাকা। 

১৮৫ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
সাহিত্য নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন