১৬ বছরের একনায়কতন্ত্র: গুম-খুনে জর্জরিত শেখ হাসিনার পতনের রাজনৈতিক পাঠ
বৃহস্পতিবার , ৩০ অক্টোবর, ২০২৫ ২:২৩ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত নাম শেখ হাসিনা। ২০০৯ থেকে ২০২৪, পনেরো বছরেরও অধিক সময়জুড়ে তিনি কেবল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীই ছিলেন না, এক অর্থে রাষ্ট্রযন্ত্র, প্রশাসন, আইন ও বিচারব্যবস্থার ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেছিলেন।
গণতন্ত্রের ঢাল নিয়ে নির্মম নিপীড়ন, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো “চিন্তার পুলিশি”, নির্বাচনের নাটকীয় ব্যবস্থাপনায় টানা স্বৈরশাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন – এভাবেই বাংলাদেশে ইতিহাস রচিত হয়েছে এক দুঃস্বপ্নের অধ্যায়।
নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও প্রশাসনিক অপরাধ
হাসিনার সরকার প্রশাসনিক অপরাধ, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের আক্ষরিক অর্থেই উদাহরণ রচনা করেছে – যেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রাধান্য, ছাত্রলীগ-যুবলীগের কুখ্যাত ভূমিকা ও আমলাদের নিরঙ্কুশ অনুগত্য ছিল যন্ত্রের মতো। গুম-খুনের পাশবিক সংস্কৃতি শুধু বিরোধীদল নয়, সাধারণ নাগরিক, এমনকি নিজ দলের ভিন্নমতাবলম্বীদেরও ছাড়েনি। র্যাব ও পুলিশের বিরুদ্ধে যে পরিমাণ বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে, ইতিহাসে তা নজিরবিহীন।
নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র ও জনগণের কণ্ঠরোধ
স্বৈরতন্ত্রের আরেক বড় সূচক ছিল নির্বাচনের নামে ভোটারবিহীন নির্বাচন—বারবার অভিযোগ এসেছে, বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মী গ্রেফতার, মারধর, মামলা; ইভিএম কারসাজি, নির্বাচনী কমিশনের পক্ষপাতিত্ব। সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, এমনকি সাধারণ নাগরিক পর্যন্ত নিরাপদে মত প্রকাশ করতে পারেননি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সাইবার পুলিশ, এবং মতপ্রকাশমুক্তির বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাবে রাষ্ট্র হয়ে ওঠে নাগরিক নির্যাতনের যন্ত্র। মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ, ব্যান-লিস্ট, তদন্ত বিহীন সাংবাদিক নিখোঁজ – এক পরিপূর্ণ পুলিশি রাষ্ট্র।
জুলাই অভ্যুত্থান, গণহত্যা ও দ্রুত দাফন
২০২৪-এর জুলাই মাসে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দমনকালে বিরল নির্মমতার নজির দেখা যায়। নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে, সরকারি বাহিনীর সহিংসতায় অন্তত ১৪০০ জন জনগণ নিহত হন। প্রশাসনিক নির্দেশে লাশের ময়নাতদন্ত না করে রাতের মধ্যেই দ্রুত দাফন করার চাপ দেওয়া হয়—নিহতদের পরিবার ভয়ে চুপ থাকেন, অনেকেই প্রতিবাদ করতে সাহস পাননি। রাষ্ট্র নিজেই হয়ে ওঠে মৃত্যুঞ্জয়ী, অথচ প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিসভা প্রচার করেন, ‘‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অব্যাহত রয়েছে’’।
ভারতীয় প্রেসক্রিপশন ও কূটনৈতিক ক্রীড়ানুশীলন
বহু বিশ্লেষকের মতে, হাসিনার রাজনৈতিক স্থায়িত্বের অন্যতম কারণ ছিল ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীর অকুণ্ঠ সমর্থন। সীমান্ত চুক্তি, ট্রানজিট, জ্বালানি, নিরাপত্তাসহ বহু ইস্যুতে হাসিনা সরকার ভারতের চাহিদা মেনে দেশের স্বার্থকে পেছনে ফেলে আপস করেছে—যা বিপরীতে বিরোধী দল ও জনগণের মধ্যে ক্ষোভের আগুন তুলেছে। ভারতীয় কূটনীতি অনেকখানি হাসিনার রাজনৈতিক আশ্রয় হিসেবে কাজ করলেও, শেষ পর্যন্ত গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেননি।
অভিযোগ, অস্বীকার ও দায় এড়ানো: আন্তর্জাতিক মঞ্চে হাসিনার ভাষ্য
ভারতে পালিয়ে গিয়ে রয়টার্স ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে হাসিনা প্রশাসনিক হত্যাকাণ্ড, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম-খুনসহ সকল অপরাধের দায় স্পষ্টভাবে অস্বীকার করেছেন। তার ভাষ্য, ‘‘নিরাপত্তা বাহিনীর নির্দেশে নয়’’, ‘‘আমি মদদ দেইনি’’, ‘‘সবই রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র’’ বা ‘‘বৈদেশিক চক্রান্ত’’—কখনও তিনি বাস্তব অপরাধের স্বীকারোক্তি দেননি, দায় পর্যন্ত গ্রহণ করেননি। এমনকি নিখোঁজদের পরিবারের আবেদন, ১৪০০ সাধারণ নাগরিকের হত্যায় সমবেদনা বা অনুসন্ধানের কথা কখনও বলেননি—বরং দোষ চাপিয়েছেন ‘‘অন্য শক্তি’’ কিংবা বিদেশগামীদের ওপর।
পর্দার আড়ালে রাষ্ট্র পরিচালনা: ইতিহাসের পুতুল সরকার
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলেন, নিজের অধীনে চলা রাষ্ট্রের ঘটনায় সরকারের প্রধান দায়িত্ব অস্বীকার মানে কার্যত ‘‘পুতুল সরকার’’ হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হওয়া। “সবকিছু জানেন না, সবই ষড়যন্ত্র”—এই বিশ্বাসযোগ্যহীন ভাষ্য উৎসাহ দেয় রাষ্ট্রযন্ত্রের অমার্জনীয় দোষচারিতাকে, দেশে বাড়ে আইনহীনতা ও প্রশাসনিক জবাবদিহিহীনতা, এবং দুশ্চিন্তা গেঁথে যায় জনমানুষের হৃদয়ে।
গণআন্দোলনে পতন ও উত্তরাধুনিক চ্যালেঞ্জ
জুলাই অভ্যুত্থান ও ক্ষমতাচ্যুতি—প্রমাণ করেছে, নিষ্ঠুরতা, জরুরি অবস্থা, সরকারের প্রতি আমলাদের আনুগত্য—সবকিছুর উর্ধ্বে জেগে উঠে জনতা। শেষ পর্যন্ত সাম্রাজ্যের চালকের আসনে থেকেও কেউ পারেননি জনগণের বিক্ষোভ ও গণজাগরণকে চিরদিন দাবিয়ে রাখতে। বিশ্লেষকেরা বলেন, হাসিনার পতন শুধু একজন ব্যক্তির বা পরিবারের পতন নয়; বরং তা নৈতিক ও প্রশাসনিক পতনের সর্বোচ্চ নিদর্শন, যেখানে এক স্বৈরাচার পতনের ভয়াবহ বার্তা রেখে যান।
মাঝপথে ‘ম্যানেজড’ সাক্ষাৎকার ও গণমাধ্যমের সীমাবদ্ধতা
হাসিনার পালানোর পর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমতেও কঠিন জবাব আদায় হয়নি। রয়টার্সের সাক্ষাৎকারে ছিল শুধুমাত্র তাঁর সুবিধাজনক আত্মরক্ষামূলক ভাষ্য, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে কার্যত মৌনতা পালন করেছে—এটাই সমসাময়িক শক্তিনিরপেক্ষ সাংবাদিকতার সীমাবদ্ধতার বাস্তব রূপ।
সমাপ্তি ও নতুন শাসনের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ
শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসন, প্রশাসনিক অপরাধের মতলবি সংস্কৃতি, জনতার রক্তাক্ত দাবি, ভারতীয় সমর্থন—সবকিছু মিলিয়ে ঐতিহাসিক এক অধ্যায়ের ইতি। তার শাসন-উত্তর বাংলাদেশের সামনে এখনো রয়েছে গুম-খুনের ক্ষত, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ভয় এবং পুরোনো দিনের শিক্ষা—ক্ষমতা যখন জনগণের নয়, তখন বিপর্যয় অনিবার্য।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
১২১ বার পড়া হয়েছে