আবু ইসহাক: জীবনসন্ধানী শিল্পী এবং বাস্তবের বিশ্বস্ত দলিল
বুধবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২৫ ৯:২৫ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
আবু ইসহাক বাংলা সাহিত্যের সেই বিরল শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম, যিনি নির্মোহ দৃষ্টিতে ইতিহাসের কঠিনতম পর্ব—দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পঞ্চাশের মন্বন্তর এবং দেশভাগের অব্যবহিত পরবর্তী সামাজিক অস্থিরতা—তাঁদের সাহিত্যের ক্যানভাসে তুলে ধরেছেন।
তাঁকে ‘জীবনসন্ধানী’ লেখক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, কারণ তাঁর রচনায় পাওয়া যায় শিকড়সন্ধানী এক গভীর জিজ্ঞাসা, যেখানে নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষের সংগ্রাম, ক্ষুধা, কুসংস্কার এবং মানবিকতার ক্ষয় ও পুনরুত্থান প্রধান উপজীব্য। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে তিনি শুধুমাত্র একজন ঔপন্যাসিক নন, তিনি বিশেষত উনিশ শ চল্লিশের দশকের গ্রামীণ বাংলার সামাজিক বাস্তবের একজন বিশ্বস্ত ঐতিহাসিক। তাঁর সাহিত্যকর্ম মানবজীবনের মৌলিক চাহিদা ও অস্তিত্বের সংকটকে এমনভাবে মূর্ত করেছে যে, তা যুগপৎ শিল্প এবং সামাজিক ডকুমেন্ট হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে।
আবু ইসহাকের সাহিত্য-যাত্রার শুরু হয়েছিল এমন এক সময়ে, যখন বাংলার সাধারণ জীবন বিশ্বযুদ্ধের ফলস্বরূপ ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। ১৯৪৩ সালের মন্বন্তর, যা ইতিহাসে পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে পরিচিত, লক্ষ লক্ষ মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল। শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রা ছাপিয়ে ইসহাকের চোখে পড়েছিল সেই অসংগঠিত, মূক জনতাকে, যারা ভাগ্য ও বিধাতার দোহাই দিয়ে ক্রমশ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছিল। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর লেখনীতে এঁকেছেন দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষের প্রতিকৃতি, যেখানে কুসংস্কার এবং সামাজিক মোড়লদের সম্মিলিত শোষণ নিম্নবর্গের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছিল। তাঁর আখ্যান মূলত মানবতা ও প্রতিকূলতার মাঝে টিকে থাকার এক মহাকাব্যিক লড়াই। এই সংগ্রামকে তিনি কোনো ভাবালুতা বা রাজনৈতিক ইশতেহার ছাড়াই উপস্থাপন করেছেন, যা তাঁর সাহিত্যকে দিয়েছে এক চিরন্তন আবেদন। এই নির্মোহ দৃষ্টির কারণেই তাঁর সাহিত্যকর্ম সামাজিক বাস্তবতার একটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হিসেবে চিহ্নিত।
আবু ইসহাকের সাহিত্য-কীর্তির চূড়ায় অবস্থান করছে তাঁর অমর উপন্যাস ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ । এই উপন্যাসটি বাংলাদেশের গ্রামীণ জনজীবনের দারিদ্র্য, কুসংস্কার এবং ঐতিহ্যবাহী শোষণের এক কঠোর ও সত্যনিষ্ঠ প্রতিচ্ছবি। মন্বন্তরের সময়কালে বাংলার গ্রাম সমাজের যে ভয়াল চিত্র, তা যেন জয়গুনের জীবনের মাধ্যমে জীবন্ত হয়ে ওঠে। জয়গুন, একজন বিধবা নারী, স্বামী পরিত্যক্ত এবং চূড়ান্ত দারিদ্র্যের শিকার; তাঁর সংগ্রাম শুধুমাত্র ক্ষুধার বিরুদ্ধে নয়, বরং পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, ধর্মান্ধতা এবং মোড়লদের অবিচারমূলক ফতোয়ার বিরুদ্ধেও। উপন্যাসের পটভূমিতে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ যেমন সুস্পষ্ট, তেমনই ফুটে উঠেছে গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর জটিল বিন্যাস—যেখানে মোল্লা এবং মোড়ল শ্রেণী ধর্মের দোহাই দিয়ে দরিদ্র নারীদের ওপর নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখে। ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ নামটির মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক গভীর প্রতীকী অর্থ। গ্রামের মানুষের কাছে এটি অভিশাপের চিহ্ন, যার ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়, ঠিক যেমন জয়গুনের জীবনে দুঃখের ছায়া কখনোই সরে না। এটি শুধুমাত্র একটি গল্প নয়, এটি ঐতিহাসিক সামাজিক কাঠামো বিশ্লেষণ করার একটি বিশ্বস্ত দলিল। এই উপন্যাসে আবু ইসহাক দেখিয়েছেন, কীভাবে অর্থনৈতিক শোষণকে ধর্মীয় এবং সামাজিক কুসংস্কারের মাধ্যমে বৈধতা দেওয়া হয়। জয়গুনের একাকীত্ব, তাঁর সন্তানদের প্রতি তাঁর নিঃশর্ত ভালোবাসা এবং শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার জন্য তাঁর মরিয়া প্রচেষ্টা—এই সবই উপন্যাসটিকে এক মর্মস্পর্শী উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এই উপন্যাসের গুরুত্ব এতটাই গভীর ছিল যে, ১৯৭৯ সালে এটি চলচ্চিত্র হিসেবে নির্মিত হয় এবং তা আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভে সমর্থ হয়, যা প্রমাণ করে যে স্থানীয় সামাজিক বাস্তবতা ছাপিয়ে এই আখ্যানের আবেদন ছিল বৈশ্বিক।
আবু ইসহাকের রচনার মৌলিকত্ব নিহিত রয়েছে তাঁর চরিত্র চিত্রণে। তিনি শুধুমাত্র ঘটনাপ্রবাহের জন্ম দেননি, বরং এমন চরিত্রদের সৃষ্টি করেছেন যাদের যন্ত্রণা ও প্রতিরোধ পাঠকের মনকে নাড়া দেয়। জয়গুন চরিত্রটি বাংলা সাহিত্যে নারী সংগ্রামের এক প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি একদিকে যেমন সমাজের চাপ মেনে নিতে বাধ্য হন, অন্যদিকে তেমনি নিজের মানবিক মূল্যবোধ এবং সন্তানদের রক্ষার তাগিদে প্রথা ও নিয়মের বিরুদ্ধে নিঃশব্দে বিদ্রোহ করেন। লেখকের এই ‘ঐতিহ্য-বিরোধী দার্শনিকতা’ তাঁর অন্যান্য রচনাতেও সুষ্পষ্ট। তিনি প্রথাগত কাঠামোকে প্রশ্ন করেছেন, যেখানে মানবিকতার চেয়ে সামাজিক বা ধর্মীয় নিয়ম বড় হয়ে ওঠে। ইসহাকের চোখে, মানুষের মূল্যবোধ এবং প্রেমই চূড়ান্ত সত্য, যা যেকোনো ধর্মীয় গোঁড়ামি বা অর্থনৈতিক শোষণকে অতিক্রম করার শক্তি রাখে। তাঁর সাহিত্যকর্ম তাই নিছকই বাস্তবতার বর্ণনা নয়, বরং মানবিক মূল্যবোধের পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক নিরন্তর চেষ্টা।
‘সূর্য দীঘল বাড়ী’র বাইরেও আবু ইসহাকের সাহিত্যিক প্রতিভার স্বাক্ষর মেলে তাঁর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলিতে। ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ উপন্যাসটি ভূগোল এবং মানুষের জীবনের ওপর প্রকৃতির প্রভাবের এক অসাধারণ আখ্যান। পদ্মা নদীর চরাঞ্চলের জীবন, যেখানে মানুষ প্রকৃতির রুদ্র রূপের সাথে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে, তা এই উপন্যাসের মূল বিষয়। চরের মানুষের জীবন যেন পলিমাটির মতোই অস্থায়ী—প্রকৃতির দান এবং ধ্বংসের মাঝে তাদের জীবন ও জীবিকা দোলায়মান। এই উপন্যাসে স্থান পেয়েছে এক ভিন্ন ধরনের সংগ্রাম, যা গ্রামীণ জীবনের স্থিতিশীল সংগ্রাম থেকে আলাদা—এটি জীবনধারণের জন্য প্রকৃতির বিরুদ্ধে এক আদিম যুদ্ধ। ইসহাক এখানে দেখিয়েছেন, কীভাবে কঠিন ভৌগোলিক পরিবেশ মানুষের চরিত্র এবং সংস্কৃতিকে গড়ে তোলে। এই ধরনের আঞ্চলিক উপন্যাসের ধারায় এটি একটি মূল্যবান সংযোজন। যদিও তাঁর প্রথম দিকের রচনাগুলিতে মন্বন্তর এবং দাঙ্গার প্রত্যক্ষ প্রভাব বেশি ছিল, তাঁর পরবর্তী কাজগুলিতে তিনি বাংলাদেশের ভৌগোলিক বৈচিত্র্য এবং সেখানে বসবাসকারী মানুষের স্থিতিস্থাপকতাকে তুলে ধরেন।
আবু ইসহাক যে শুধু সামাজিক বাস্তবতার গণ্ডিতেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন তা নয়, তাঁর লেখনীর পরিধি ছিল ব্যাপক। গোয়েন্দা কাহিনি ভিত্তিক উপন্যাস ‘জাল’ তাঁর সাহিত্যিক বৈচিত্র্যের প্রমাণ দেয়। যদিও তিনি মূলত জীবনসন্ধানী ঔপন্যাসিক হিসেবে পরিচিত, ‘জাল’ প্রমাণ করে যে তিনি প্রচলিত ধারার বাইরেও সফলভাবে বিচরণ করতে পারতেন। তবে তাঁর সাহিত্যিক গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি নিহিত রয়েছে তাঁর ছোটগল্পগুলিতে। তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘মহাপতঙ্গ’ বাংলা ছোটগল্পের জগতে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। ছোটগল্পের মাধ্যমেও তিনি নিম্নবিত্ত মানুষের ক্ষণস্থায়ী আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং তাদের জীবনের অপ্রত্যাশিত বিড়ম্বনাগুলি তীব্রভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। নাটক রচনায় তাঁর অবদানও অনস্বীকার্য—‘জয়ধ্বনি’ তাঁর নাট্যপ্রতিভার দ্যোতক। এই বহুমুখী প্রতিভা প্রমাণ করে যে, আবু ইসহাক কেবলমাত্র একজন নির্দিষ্ট ঘরানার লেখক ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন সামগ্রিক জীবন ও সমাজের প্রতি সদা সতর্ক এক শিল্পী।
তাঁর লেখার শৈলী ছিল অত্যন্ত সাবলীল, প্রত্যক্ষ এবং অলঙ্কারবর্জিত। তিনি ভাষার আড়ম্বর এড়িয়ে গেছেন, কারণ তিনি জানতেন যে, চরম দারিদ্র্য এবং মানব অস্তিত্বের সংকট বর্ণনা করার জন্য সরল, তীক্ষ্ণ ভাষারই প্রয়োজন। তাঁর আখ্যানে আঞ্চলিক ভাষার সার্থক ব্যবহার চরিত্রগুলিকে আরও জীবন্ত করে তুলেছে। আবু ইসহাক বিশ্বাস করতেন, সাহিত্যকে সমাজের আয়না হতে হবে, তাই তাঁর বর্ণনাভঙ্গি ছিল ফটো-সাংবাদিকের মতো নির্ভুল এবং বাস্তবসম্মত। এই শৈলীই তাঁকে সমকালীন অন্যদের থেকে আলাদা করেছে এবং তাঁকে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের ইতিহাসে একটি স্বতন্ত্র স্থান দিয়েছে। তিনি এমনভাবে গল্প বলেছেন, যা পাঠকের মনে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলে। তাঁর লেখা বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে এক নতুন গল্পকথনের দিক স্থাপন করেছে, যেখানে সাধারণ মানুষের সংগ্রামকে কেন্দ্রীয় মহিমা দেওয়া হয়েছে।
আবু ইসহাকের সাহিত্যিক জীবন শুরু হয়েছিল সাহিত্য সাধনার প্রবল আগ্রহ নিয়ে, এবং স্বীকৃতিও এসেছিল তাঁর কাজের মধ্য দিয়েই। তাঁর জীবনের শেষ দিকে, তিনি খুলনার খালিশপুর এলাকায় যে বাসস্থান নির্মাণ করেছিলেন, তার নাম দিয়েছিলেন ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’—যা তাঁর উপন্যাসের প্রতি এবং সেই উপন্যাসে বর্ণিত শোষিত মানুষের প্রতি তাঁর চিরন্তন আবেগকে প্রতিফলিত করে।
আবু ইসহাক ছিলেন বাংলা সাহিত্যের সেই জীবনশিল্পী, যিনি বিশ্বযুদ্ধোত্তর এবং মন্বন্তর-পীড়িত বাংলার সামাজিক বাস্তবতাকে সাহিত্যে চিরস্থায়ী রূপ দিয়ে গেছেন। তিনি শুধু দরিদ্রের জীবনকথা শোনাননি, বরং দেখিয়েছেন কীভাবে প্রতিকূলতার মধ্যেও মানুষ মানবিক মূল্যবোধ এবং অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সংগ্রাম করে। তাঁর সাহিত্য একটি নীরব কণ্ঠস্বর, যা ইতিহাসের নির্মম সত্যকে তুলে ধরে এবং সমাজকে তার দুর্বলতা সম্পর্কে সতর্ক করে। ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’র জয়গুন থেকে শুরু করে ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’-এর চরের মানুষ—আবু ইসহাকের সৃষ্ট প্রতিটি চরিত্রই নিম্নবর্গীয় সংগ্রামের প্রতীক। তাঁর সাহিত্য শুধুমাত্র বাংলাদেশের অতীতের একটি চিত্র নয়, বরং এটি সেই মানবিক মূল্যবোধের চিরন্তন অনুসন্ধান, যা যেকোনো সময়কালের জন্য সমানভাবে সত্য।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট এবং সহকারী অধ্যাপক (বাংলা), এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, আশুলিয়া, ঢাকা।
১১৭ বার পড়া হয়েছে