যে জলে আগুন জ্বলে: দশকের দহন ও হেলাল হাফিজের কাব্যভাষা

মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৫ ৯:২৪ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাংলা কাব্যের ইতিহাসে সত্তরের দশক এক অগ্নিগর্ভ সময়, যা রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক ভাঙন এবং ব্যক্তিগত হতাশার এক জটিল আবর্তে নিমজ্জিত ছিল। এই দশকের আত্মজ দহনকে শিল্পসম্মত মূর্তিতে তুলে ধরার ক্ষেত্রে যে ক’জন কবির নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়, তাঁদের মধ্যে হেলাল হাফিজ অন্যতম।
তাঁর কাব্যগ্রন্থ "যে জলে আগুন জ্বলে" আধুনিক বাংলা কবিতার এক অনবদ্য সংযোজন, যা ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হলেও এর অধিকাংশ কবিতা সত্তরের দশকের রাজনৈতিক পটভূমি ও ব্যক্তিগত যন্ত্রণাবোধের ফসল। ৫৬টি কবিতার এই সংকলন প্রেম, যুদ্ধ, নৈতিকতা, বিবেক, সমাজের অন্ধকার দিক এবং মানবতার বিপন্নতার মতো চিরন্তন বিষয়গুলোকে এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে উন্মোচন করে। প্রথাগত কাব্যচর্চার বাইরে গিয়ে হেলাল হাফিজ তাঁর নিজস্ব কাব্যভাষা, চিত্রকল্প ও শব্দচয়ন দিয়ে পাঠকের মননে এক গভীর ছাপ ফেলে গেছেন।
হেলাল হাফিজের কবিতা কেবল সময়ের দলিল নয়, বরং তা মানব মনের জটিল অনুভূতি, প্রেম ও দেশপ্রেমের অপূর্ব সংমিশ্রণ। তাঁর কবিতা আবেগের তীব্রতা এবং বক্তব্যের স্পষ্টতার জন্য সুপরিচিত। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পর থেকেই পাঠক ও সমালোচক মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো কেবল সেই নির্দিষ্ট দশকের প্রতিচ্ছবি নয়, বরং তা মানব অস্তিত্বের শাশ্বত সংগ্রাম ও আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে। একারণেই কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের এত বছর পরেও এর প্রাসঙ্গিকতা বিন্দুমাত্র ম্লান হয়নি। দীর্ঘ বিরল কাব্যযাত্রার একমাত্র এই গ্রন্থটি কবিকে এনে দিয়েছে অমরত্বের সনদপত্র। এর প্রতিটি পঙক্তি যেন এক যুগ-যন্ত্রণা, এক সমষ্টিগত বেদনার প্রতিচ্ছবি। এই প্রবন্ধে আমরা কবির কালজয়ী এই সৃষ্টিকে দশকের দহনের প্রেক্ষাপটে এবং তাঁর অনন্য কাব্যভাষার নিরিখে বিশদভাবে পাঠ করার চেষ্টা করব।
"যে জলে আগুন জ্বলে" কাব্যগ্রন্থটি ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হলেও, এর জন্মমূল প্রোথিত ষাট ও সত্তরের দশকের গভীর অন্ধকারে। এই সময়টি ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অত্যন্ত উত্তাল ও সংঘাতপূর্ণ অধ্যায়। একটি জাতির জন্মলগ্নের সংগ্রাম, স্বাধীনতার স্বপ্ন, যুদ্ধ, বিজয় এবং তার অব্যবহিত পরের রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অবক্ষয় ও ব্যক্তিগত স্বপ্নভঙ্গের বেদনা—এই সবকিছুই হেলাল হাফিজের কবিতায় দহনে রূপান্তরিত হয়েছে।
ষাটের দশক থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। অর্থনৈতিক বৈষম্য, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এবং রাজনৈতিক বঞ্চনা সাধারণ মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ছাত্রসমাজ এই আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল। স্লোগান, মিছিল, প্রতিবাদ আর রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম এই দশকের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা ছিল। হেলাল হাফিজ নিজেই এই আন্দোলনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী এবং সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় বেড়ে ওঠা তাঁর তরুণ মনন এই আন্দোলন থেকে গভীর প্রেরণা লাভ করে। ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতায় তিনি যেন সেই সময়ের বিদ্রোহকেই কণ্ঠ দিয়েছেন: "এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার শ্রেষ্ঠ সময় / এখন যৌবন যার যুদ্ধ করার শ্রেষ্ঠ সময়।" এই পঙক্তিগুলো কেবল কবিতার অংশ হয়ে থাকেনি, তা হয়ে উঠেছিল একটি প্রজন্মের মন্ত্র, এক প্রতিবাদী চেতনার শাশ্বত স্লোগান।
এরপর আসে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম,ত্রিশ লক্ষ প্রাণের আত্মদান এবং দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত হারানোর মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। এই যুদ্ধ বাঙালির জীবনে এনেছিল এক বিশাল পরিবর্তন, এক নতুন আত্মপরিচয়। কিন্তু যুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতা ছিল আরও জটিল ও কঠিন। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ, ভঙ্গুর অর্থনীতি, লাখো শহীদের স্বপ্নপূরণের দায়বদ্ধতা এবং এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ —এই সব মিলে এক মিশ্র আবেগ ও অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়। হেলাল হাফিজের কবিতায় এই যুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং এর গভীর ক্ষত স্পষ্ট। "অস্ত্র" অথবা "নাম না জানা জনৈক মুক্তিযোদ্ধাকে" এর মতো কবিতায় তিনি যুদ্ধের ভয়াবহতা, আত্মত্যাগ এবং বীরত্বকে যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবহেলা, তাদের স্বপ্নভঙ্গ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া হতাশার চিত্রও ফুটিয়ে তুলেছেন।
সত্তরের দশকের শুরুতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শুরু হয় এক চরম অস্থিরতা। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর যে স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা ছিল, তা দ্রুতই ম্লান হতে শুরু করে। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা হীনতা ছিল এই দশকের শুরুর কালের প্রধান বৈশিষ্ট্য। অর্থনৈতিক সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করে এবং জনজীবনে এক অনিশ্চয়তা ও হতাশা গ্রাস করে। এই সময় রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি সাধারণ মানুষের এক ধরনের অবিশ্বাস ও অনাস্থা জন্ম নেয়। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে যারা স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছিল, তাদের অনেকেই নিজেদের প্রতারিত ও বঞ্চিত মনে করতে শুরু করে। হেলাল হাফিজের কবিতা এই যুগযন্ত্রণা, এই বঞ্চনা ও স্বপ্নভঙ্গেরই শিল্পসম্মত প্রকাশ।
কবি ব্যক্তিমানুষের চাওয়া-পাওয়া, বিশ্বাস-অবিশ্বাস এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে তার সম্পর্কের টানাপোড়েনকে তুলে ধরেছেন। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থের নামকরণের মধ্যেই সেই দহনের ইঙ্গিত নিহিত। যে জল জীবন দেয়, সেই জলেই যখন আগুন জ্বলে, তখন তা এক চরম বিপন্নতা এবং অস্বাভাবিকতার প্রতীক। এটি এমন এক সময়ের প্রতিচ্ছবি যখন স্বাভাবিকতা ব্যাহত, সাধারণ মানুষের স্বপ্নগুলো পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। "আমাকেও ডেকে নিও" কবিতায় তিনি যেন এক অস্থির সময়ের চিত্র অঙ্কন করেন যেখানে ব্যক্তিজীবনের আনন্দ ও বিচ্ছেদ সামাজিক অস্থিরতার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে।
এই দশকের দহন কেবল রাজনৈতিক নয়, তা ছিল নৈতিক এবং আত্মিকও। আদর্শের বিচ্যুতি, প্রতিশ্রুতির ভঙ্গ এবং মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় কবিকে গভীরভাবে ব্যথিত করেছিল। তাঁর কবিতায় তাই ব্যক্তিগত প্রেমও অনেক সময় সামাজিক ও রাজনৈতিক টানাপোড়েনের ছায়ায় আচ্ছন্ন। প্রেম এখানে কেবল দুই হৃদয়ের মিলন নয়, বরং দেশ ও জাতির প্রতি ভালোবাসা, ন্যায় ও সুন্দরের প্রতি অবিচল আস্থা। কিন্তু যখন এই বিশ্বাসগুলো প্রশ্নের মুখে পড়ে, তখন প্রেমও এক ধরনের বিষাদগ্রস্ততা ও হাহাকারে পরিণত হয়। এই সামগ্রিক পরিস্থিতিই "দশকের দহন" নামে হেলাল হাফিজের কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে, যা যুগযন্ত্রণার এক শিল্পসম্মত দলিল।
হেলাল হাফিজের "যে জলে আগুন জ্বলে" কাব্যগ্রন্থের মোট ৫৬টি কবিতা বিষয়বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হলেও, সেগুলোর গভীরে একটি কেন্দ্রীয় সুর প্রবাহিত – তা হলো একটি অস্থির দশকের দহন ও মানবিক বিপন্নতা। প্রেম, যুদ্ধ, নৈতিকতা, সামাজিক বঞ্চনা ও বিদ্রোহ—এই প্রধান অনুষঙ্গগুলো কবির নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও কাব্যভাষায় এক অনন্য মাত্রা লাভ করেছে।
হেলাল হাফিজের প্রেমের কবিতাগুলো কেবল রোমান্টিক আবেগের প্রকাশ নয়, বরং তা প্রায়শই রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সামাজিক ভাঙনের প্রেক্ষাপটে চিত্রিত। তাঁর প্রেম ব্যক্তিগত হলেও তার সীমানা ছাড়িয়ে সমষ্টিগত বেদনাকে স্পর্শ করে। প্রেমের মধ্যে এখানে এক ধরনের বিষাদ, বিরহ এবং অতৃপ্তির সুর বিদ্যমান। প্রেমিকের অপেক্ষা, প্রিয়জনের অনুপস্থিতি যেন এক বৃহত্তর দেশগত বঞ্চনার প্রতিচ্ছবি।
‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতায় প্রেম ও সংগ্রামের এক অবিচ্ছেদ্য মেলবন্ধন দেখা যায়। "যুদ্ধে যাবো, বলিনি কি? প্রেমিকের মতো আমি রণাঙ্গনে যাবো না তো?" এখানে প্রেমিকের মতোই দেশপ্রেমিক হয়ে ওঠে এবং প্রেমিকার অপেক্ষার মতো দেশও তার সন্তানদের জন্য অপেক্ষারত। ‘বন্যেরা যেমন’ কবিতায় ব্যক্তিজীবনের প্রেম ও বিরহ যেন এক নিভৃত যন্ত্রণাবোধ হিসেবে প্রকাশিত। প্রেমের সম্পর্ক এখানে যেন একটি আশ্রয়, একটি শান্তির নীড়, যা বাইরের জগতের অস্থিরতা থেকে মুক্তি দেয়, অথচ সেই মুক্তির মধ্যেও এক ধরনের চাপা অস্থিরতা লুপ্ত থাকে।
অনেক সময় হেলাল হাফিজের প্রেমিকার চিত্রকল্পে দেশ বা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়। প্রিয়জনের বিরহ যেন স্বাধীনতার অপূর্ণ প্রত্যাশা বা স্বাধিকারের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষার প্রতীক। ‘ফেরোনি’ কবিতায় যে ফিরে আসার আকুতি, তা কেবল প্রিয়তমার জন্য নয়, তা যেন এক হারানো সুসময়ের জন্য, এক প্রত্যাশিত স্থিতিশীলতার জন্য। এই প্রেমের কবিতাগুলো তাই কেবল ব্যক্তিগত অনুভূতিকে আশ্রয় করে না, বরং তা একটি প্রজন্মের সম্মিলিত হৃদয়ের হাহাকার ও আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ হেলাল হাফিজের কবিতার এক বিরাট অংশ জুড়ে আছে। তিনি কেবল যুদ্ধের বীরত্বগাথা বর্ণনা করেননি, বরং যুদ্ধোত্তর সময়ে জাতির মধ্যে যে নৈতিক অবক্ষয়, স্বপ্নভঙ্গ এবং বঞ্চনা দেখা দিয়েছিল, তাকেও গভীর সংবেদনশীলতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। তাঁর কবিতায় যুদ্ধ মানে কেবল অস্ত্র হাতে শত্রুর মোকাবিলা নয়, যুদ্ধ মানে আদর্শের জন্য সংগ্রাম, ন্যায়ের জন্য লড়াই।
‘যে জলে আগুন জ্বলে’ নামক কবিতাটিতেই যুদ্ধের পরোক্ষ প্রভাব এবং তার ধ্বংসাত্মক শক্তিকে প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। যে জল জীবন ধারণ করে, সেই জলেই আগুন জ্বলে উঠলে তা এক চরম অস্বাভাবিকতা এবং ধ্বংসের ইঙ্গিত দেয়। এই আগুন যেন যুদ্ধোত্তর সমাজের অস্থিরতা, নৈরাজ্য এবং মানুষের মধ্যে দহনের প্রতীক।
‘অস্ত্র’ কবিতায় যুদ্ধের সরঞ্জাম কেবল ধ্বংসের প্রতীক নয়, বরং তা প্রতিরোধের প্রতীকও বটে। তবে কবির মনের মধ্যে যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং তার পরবর্তী পরিণতির এক গভীর ছাপ স্পষ্ট। ‘নাম না জানা জনৈক মুক্তিযোদ্ধাকে’ কবিতায় যুদ্ধকালীন আত্মত্যাগ ও বীরত্বের বর্ণনা যেমন আছে, তেমনই যুদ্ধের পরে সেই বীরদের অবহেলা ও বিস্মৃতির আড়ালে চলে যাওয়ার বেদনাবোধও তীব্রভাবে প্রতিফলিত। এই কবিতাগুলোতে কবি স্বাধীনতার জন্য মানুষের অপরিসীম আত্মত্যাগকে সম্মান জানানোর পাশাপাশি স্বাধীনতার পরে সেই আত্মত্যাগের সার্থকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। যখন মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হন, তখন কবির মনে জন্ম নেয় গভীর যন্ত্রণা।
‘একটি পতাকা পেলে’ কবিতায় দেশের পতাকার মতো কাঙ্ক্ষিত বস্তুকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি, সেই পতাকাকে সমুন্নত রাখার নৈতিক দায়িত্বের কথাও উচ্চারিত হয়েছে। এই কবিতাগুলো যুদ্ধ ও তার পরবর্তী সময়ের একটি আবেগঘন ও বাস্তবসম্মত চিত্র তুলে ধরে, যা পাঠককে গভীরভাবে নাড়া দেয়।
হেলাল হাফিজের কবিতায় নৈতিক অবক্ষয়, বিবেকের দংশন এবং সামাজিক বঞ্চনার দিকটিও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে উঠে এসেছে। স্বাধীনতার পর যে নতুন সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখা হয়েছিল, সেই স্বপ্ন যখন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারে কলুষিত হতে দেখে, তখন কবির মন বিষাদে ভরে ওঠে। তিনি সমাজের সেই অন্ধকার দিকগুলো তুলে ধরতে দ্বিধা করেননি।
‘ইচ্ছে ছিলো’ কবিতায় ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের অপূর্ণতা এবং আদর্শচ্যুতি এক গভীর হতাশার জন্ম দেয়। কবির ইচ্ছেগুলো যেন সমাজের প্রতিশ্রুতির মতোই ভেঙে যায়, যা এক সমষ্টিগত বঞ্চনার প্রতীক। ‘দুঃসময়ে আমার বিনীত নিবেদন’ কবিতায় কবি যেন এক অস্থির সময়ে দাঁড়িয়ে দেশ ও জাতির কাছে তাঁর বিনীত আবেদন তুলে ধরেন – এই আবেদন হলো মানবিক মূল্যবোধের পুনরুদ্ধার, নীতি ও আদর্শের প্রতি অবিচল থাকা। এটি কেবল ব্যক্তিগত আবেদন নয়, বরং তা সমাজের বিবেক হয়ে কথা বলা।
তিনি যেন এক নীরব দ্রষ্টা, যিনি সমাজের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অনৈতিকতা ও ভণ্ডামিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছেন। তাঁর কবিতা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক মৃদু প্রতিবাদ, এক নীরব প্রশ্ন। এই প্রশ্নগুলো পাঠককে আত্মানুসন্ধান ও সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। যখন সমাজ তার মৌলিক মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত হয়, তখন কবি সেই বিচ্যুতির কারণ ও তার পরিণতি নিয়ে গভীর চিন্তা করেন।
হেলাল হাফিজের কবিতায় সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন, তাদের দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটন এবং নিরাপত্তাহীনতার চিত্র অত্যন্ত জীবন্ত। তিনি সমাজের প্রান্তিক মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং তাদের হাহাকারকে নিজের কণ্ঠে ধারণ করেছেন। তাঁর কবিতা সেইসব কণ্ঠহীন মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে।
‘অবিরাম’ কবিতায় জীবনের অবিরাম ছুটে চলা, তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা হতাশা ও ক্লান্তি যেন সাধারণ মানুষের প্রতিচ্ছবি। জীবন এখানে এক অন্তহীন সংগ্রাম, যেখানে বিশ্রাম বা মুক্তি দুর্লভ। ‘আজ থেকে স্বাধীনতা’ কবিতায় স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। স্বাধীনতা কি কেবল একটি ভূখণ্ড অর্জন? নাকি তা মানুষের জীবনে প্রকৃত মুক্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য এনে দেয়? কবি এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন এবং দেখিয়েছেন, সাধারণ মানুষের জীবনে যখন অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক ন্যায়বিচার অনুপস্থিত, তখন স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়ে।
‘যে ঘরে আগুন জ্বলে যায়’ কবিতায় ব্যক্তিগত জীবনের বিপন্নতা এবং সামাজিক অস্থিরতার এক নিদারুণ চিত্র ফুটে ওঠে। ঘর এখানে কেবল একটি বাসস্থান নয়, তা যেন ব্যক্তিজীবনের আশ্রয়, কিন্তু সেই আশ্রয়ও যখন নিরাপত্তাহীনতার মুখে পড়ে, তখন তা এক গভীর যন্ত্রণাবোধের জন্ম দেয়। এই কবিতাগুলো সমাজের অন্ধকার দিকগুলো, যেমন—দারিদ্র্য, বঞ্চনা, অবিচার এবং সাধারণ মানুষের অসহায়ত্বকে মূর্ত করে তোলে। হেলাল হাফিজ অত্যন্ত সংবেদনশীলতার সাথে এই চিত্রগুলো অঙ্কন করেছেন, যা পাঠককে তাদের চারপাশের সমাজের বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন করে তোলে।
হেলাল হাফিজের কবিতায় যদিও হতাশা, বিষাদ এবং বঞ্চনার সুর প্রবল, তবুও কোথাও কোথাও আশার এক ক্ষীণ আলোকরেখা দেখা যায়, যা মানবাত্মার দৃঢ়তা ও অবিচলতার প্রতীক। এই আশা যেন সকল প্রতিকূলতা সত্ত্বেও টিকে থাকার এক দৃঢ় প্রত্যয়।
‘এখনো আমার কালো রাত’ অথবা ‘যে ঘরে আগুন জ্বলে যায়’ এর মতো কবিতাগুলোতে হতাশার এক গভীর অন্ধকার থাকলেও, তার মধ্যেও কোথাও যেন প্রতিরোধের এক স্পর্ধা লুকিয়ে আছে। কবি যেন বলতে চান, অন্ধকার যতই গভীর হোক না কেন, ভোরের আগমন অবধারিত। এই প্রত্যাশা মানবিকতার প্রতি কবির এক গভীর বিশ্বাসের নির্দেশক। তাঁর কবিতায় যেমন যন্ত্রণা ও বঞ্চনার চিত্র আছে, তেমনি মানবসত্তার টিকে থাকার এক দৃঢ় প্রত্যয়ও আছে। এই দ্বিধাদ্বন্দ্বই তাঁর কবিতাকে আরও বাস্তবসম্মত ও হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছে।
সামগ্রিকভাবে, "যে জলে আগুন জ্বলে" কাব্যগ্রন্থটি সত্তরের দশকের বাংলাদেশের এক জটিল ও বহুস্তরীয় চিত্র তুলে ধরেছে। এটি কেবল একটি ঐতিহাসিক দলিল নয়, বরং এটি মানব মনের শাশ্বত সংগ্রাম, প্রেম, বঞ্চনা এবং আশার এক কাব্যিক রূপ। হেলাল হাফিজ এই বিষয়বস্তুগুলোকে তাঁর নিজস্ব কাব্যভাষায় এমনভাবে মূর্ত করেছেন, যা বাংলা কবিতার ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
হেলাল হাফিজের কাব্যভাষার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো তার সরলতা এবং সহজবোধ্যতা। তিনি জটিল অলংকার বা দুর্বোধ্য শব্দচয়ন পরিহার করে সাধারণ মানুষের মুখের ভাষাকেই কবিতার বাহন করেছেন, কিন্তু এই সরলতাই তার ভাষার গভীরতা ও আবেদনকে বিন্দুমাত্র ম্লান করেনি, বরং তা আরও বেগবান করেছে। "যে জলে আগুন জ্বলে" কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতায় এই অনন্য কাব্যভাষার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায়।
হেলাল হাফিজের কবিতার ভাষা একেবারেই আটপৌরে, কথ্যরীতি-ঘনিষ্ঠ। তিনি ভাষার পাণ্ডিত্য বা কৃত্রিমতা পরিহার করেছেন। তাঁর শব্দচয়নে কোনো আরোপিত জটিলতা নেই, যা তাঁর কবিতাকে আপামর জনসাধারণের কাছে সহজলভ্য করে তুলেছে। এই সরলতার কারণেই তাঁর কবিতা দ্রুত জনমানসে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে এবং মুখে মুখে ফিরতে শুরু করেছে। "এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার শ্রেষ্ঠ সময়" অথবা "তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা" —এই ধরনের পঙক্তিগুলো তার কাব্যভাষার দারুণ উদাহরণ। এই বাক্য নির্মাণে কোনো জটিলতা নেই, অথচ এর অন্তর্নিহিত শক্তি ও আবেদন অসামান্য।
এই সরলতা তাঁর কাব্যকে নিছক বিনোদনমূলক করে তোলেনি, বরং তাকে করে তুলেছে প্রতিবাদী ও জনমুখী। সাধারণ মানুষ নিজেদের আবেগ, হতাশা এবং স্বপ্নকে তাঁর কবিতার মধ্যে খুঁজে পায়। এটি ভাষার এক নতুন ব্যবহার, যেখানে দৈনন্দিন ভাষা হয়ে উঠেছে শিল্প ও প্রতিবাদের মাধ্যম। এটি এমন এক শিল্প যা শিক্ষিত পাঠক থেকে শুরু করে সাধারণ রিকশাওয়ালা, সকলেরই মন ছুঁয়ে যায়।
হেলাল হাফিজের কবিতায় এক ধরনের স্বতঃস্ফূর্ত গীতিময়তা ও সাংগীতিকতা বিদ্যমান। তাঁর পঙক্তিগুলো প্রায়শই ছন্দের এক স্বাভাবিক গতি অনুসরণ করে, যা তাদের পাঠে বা আবৃত্তিতে এক বিশেষ সুরের সৃষ্টি করে। এর ফলে তাঁর অনেক কবিতাই গান হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে, অথবা আবৃত্তিকারদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। এই গীতিময়তা তাঁর কবিতাকে আরও স্মরণে রাখতে সাহায্য করে।
উদাহরণস্বরূপ, "নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়" অথবা "একটি পতাকা পেলে" কবিতাগুলো আবৃত্তির ক্ষেত্রে যে বিশেষ দ্যোতনা সৃষ্টি করে, তা কেবল বক্তব্যের গভীরতার জন্য নয়, বরং তার অন্তর্নিহিত ছান্দিক বিন্যাসের কারণে। শব্দচয়ন ও বাক্য গঠনের মধ্যে এক ধরনের ছন্দোবদ্ধতা রয়েছে যা পাঠকের মনে এক স্থায়ী প্রভাব ফেলে। এই সাংগীতিকতা তার কবিতার আবেদনকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে এবং তা হৃদয় থেকে হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করেছে।
হেলাল হাফিজের কাব্যভাষায় সহজবোধ্যতার পাশাপাশি গভীর চিত্রকল্প ও প্রতীকী ব্যঞ্জনাও লক্ষ্যণীয়। তিনি চেনা বস্তুকে নতুন রূপে উপস্থাপন করে বিমূর্ত ধারণাকে মূর্ত করে তোলেন। তাঁর উপমা ও চিত্রকল্পগুলো অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী এবং তাৎপর্যপূর্ণ। কাব্যগ্রন্থের নামকরণ "যে জলে আগুন জ্বলে"ই এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। জল শান্তির প্রতীক, কিন্তু সেই জলেই যখন আগুন জ্বলে, তখন তা এক চরম অস্বাভাবিকতা, দহন ও বিপন্নতার প্রতীক হয়ে ওঠে।
"ক্ষতি কি আগুন যদি জল হয়, জল যদি আগুন হয়" —এই ধরনের চিত্রকল্পগুলো কেবল সাধারণ উক্তি নয়, বরং তা এক গভীর দার্শনিক জিজ্ঞাসা এবং সমকালীন অস্থিরতার প্রতীক। "অন্ধকার যত দীর্ঘ হোক, ভোর হবে।" এই সরল বাক্যটিও এক গভীর আশাবাদ এবং প্রতিরোধের প্রতীক। তিনি রূপক ও উপমা ব্যবহার করেন বাস্তবতাকে তীক্ষ্ণভাবে তুলে ধরতে। তাঁর চিত্রকল্পগুলো সাধারণ জীবন থেকে উৎসারিত, যা পাঠককে সহজেই আকৃষ্ট করে।
হেলাল হাফিজ তাঁর কবিতায় সমকালীন সমাজের কঠিন বাস্তবতাকে তুলে ধরতে দ্বিধা করেননি। তিনি সরাসরি আঘাত হানেন সমাজের ভণ্ডামি, দুর্নীতি এবং নৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে। তাঁর ভাষায় এক ধরনের তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ এবং ক্ষুরধার সমালোচনা বিদ্যমান, যা পাঠককে ভাবিয়ে তোলে। এই ব্যঙ্গ তিনি সরাসরি না করে সাবলীলভাবে প্রকাশ করেন, যা আরও মর্মস্পর্শী হয়ে ওঠে।
"ইচ্ছে ছিলো তোমাকে ভালোবাসবো" কবিতায় রোমান্টিক আশার বিপরীতে যে নির্মম বাস্তবতা উঠে আসে, তা সমাজের প্রতি কবির এক নীরব কটাক্ষ। তিনি যে সমাজে নৈতিকতার অবক্ষয় দেখেছেন, সেই অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে তাঁর কবিতা এক ধরনের প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদ কখনো উচ্চকিত নয়, বরং তা এক গভীর বেদনাবোধ থেকে উৎসারিত, যা পাঠককে আরও গভীরভাবে ছুঁয়ে যায়।
হেলাল হাফিজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো শব্দের মিতব্যায়িতা। তিনি অল্প কথায় গভীর ও ব্যাপক অর্থ প্রকাশে পারদর্শী। প্রতিটি শব্দ যেন তাঁর কবিতায় বিশেষ ওজন বহন করে। অপ্রয়োজনীয় শব্দ বা বাক্য তাঁর কবিতায় স্থান পায় না। "তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, আর কতকাল ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?" —এই একটি পঙক্তির মধ্যেই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম, রক্তক্ষরণ এবং হতাশার গভীরতা ফুটে ওঠে।
এই মিতব্যায়িতা তাঁর কবিতাকে আরও ধারালো ও স্মরণীয় করে তোলে। পাঠক সহজেই তাঁর কবিতার লাইনগুলো মনে রাখতে পারে এবং এর গভীরে প্রবেশ করতে পারে। তাঁর শব্দগুলো প্রায়শই প্রতীকী ব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ, যা সীমিত পরিসরে অসীম অর্থের দ্যোতনা সৃষ্টি করে। এই তীক্ষ্ণতা এবং শব্দের নিপুণ ব্যবহার হেলাল হাফিজকে তাঁর সমসাময়িক কবিদের থেকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে।
হেলাল হাফিজের কাব্যভাষায় প্রায়শই এক ধরনের কথোপকথনের ঢং লক্ষ্য করা যায়। তিনি যেন পাঠকের সঙ্গে সরাসরি কথা বলছেন, নিজের মনের ভাব একান্ত আন্তরিকতার সাথে প্রকাশ করছেন। এই আন্তরিকতা পাঠককে কবির কাছাকাছি নিয়ে আসে এবং তাঁদের মধ্যে এক গভীর সংযোগ স্থাপন করে।
"আমাকেও ডেকে নিও" কবিতায় যেন ব্যক্তিগত এক অনুরোধের মধ্য দিয়ে দেশপ্রেমের এক গভীর আহ্বান ধ্বনিত হয়। এই ধরনের প্রকাশভঙ্গি তাঁর কবিতাকে আরও বিশ্বাসযোগ্য ও মানবিক করে তোলে। তাঁর কবিতা কেবল শিল্পের জন্য শিল্প নয়, বরং তা জীবন ও মানুষের সঙ্গে গভীর সম্পর্কযুক্ত।
সামগ্রিকভাবে, হেলাল হাফিজের কাব্যভাষা তার সরলতা, গীতিময়তা, প্রতীকী ব্যঞ্জনা, তীক্ষ্ণতা এবং আন্তরিকতার জন্য আধুনিক বাংলা কাব্যে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। তিনি সাধারণ ভাষাকে অসামান্য শিল্পে রূপান্তরিত করেছেন, যা কেবল সেই দশকের দহনকেই নয়, বরং মানব অস্তিত্বের শাশ্বত সত্যগুলোকেও তুলে ধরেছে। তাঁর ভাষা একাধারে প্রতিবাদের, প্রেমের, বেদনার এবং আশার ভাষা।
হেলাল হাফিজের "যে জলে আগুন জ্বলে" কাব্যগ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যে এক অবিস্মরণীয় প্রভাব ফেলেছে। ১৯৮৬ সালে প্রকাশের পর থেকেই এটি পাঠক এবং সমালোচক মহলে ব্যাপক সাড়া জাগায় এবং আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে এটি একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। এর প্রভাব কেবল সাহিত্যের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং তা বাঙালি জনমানসে এক গভীর সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অনুরণন সৃষ্টি করেছে।
কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের পর থেকে এর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হয়। এটি কেবল কাব্যপ্রেমীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং সাধারণ পাঠকের কাছেও পৌঁছে যায়। এর কারণ হলো কবির সহজবোধ্য ভাষা, সরাসরি বক্তব্য এবং সমকালীন মানুষের আবেগ ও হতাশার সফল রূপায়ণ। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম হেলাল হাফিজের কবিতায় নিজেদের কণ্ঠস্বর খুঁজে পায়। তাঁর কবিতাগুলো প্রেম, দ্রোহ, দেশপ্রেম এবং ব্যক্তিগত যন্ত্রণার এক নিখুঁত মিশ্রণ, যা যেকোনো প্রজন্মের মানুষকে স্পর্শ করে। "নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়", "তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা", "অস্ত্র", "ইচ্ছে ছিলো" —এর মতো কবিতাগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে, মিছিলে স্লোগান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং ব্যক্তিগত স্মৃতিকাতরতার অংশ হয়ে উঠেছে। এই কবিতাগুলোর জনপ্রিয়তা সময়ের সাথে সাথে বিন্দুমাত্র হ্রাস পায়নি, বরং তা আরও গভীর হয়েছে।
হেলাল হাফিজের কাব্যভাষা বাংলা কবিতায় এক নতুন ধারার সূচনা করেছে। তিনি প্রমাণ করেছেন যে, জটিল অলংকার ও কৃত্রিমতা পরিহার করেও গভীর ভাব ও দর্শনকে প্রকাশ করা সম্ভব। তাঁর সরল, সাবলীল এবং কথ্যরীতি-ঘনিষ্ঠ ভাষা কবিতার দুর্বোধ্যতা ভেঙে দিয়েছে এবং তাকে অধিকতর জনমুখী করেছে। তাঁর পথ ধরে বহু তরুণ কবি অনুপ্রাণিত হয়েছেন সহজবোধ্য ও আবেগঘন কাব্যচর্চায়। তিনি দেখিয়েছেন, কবিতার মূল কাজ হলো মানুষের হৃদয়ে পৌঁছানো, এবং এজন্য শব্দের কারুকাজের চেয়ে ভাবের গভীরতা ও আন্তরিকতাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
"যে জলে আগুন জ্বলে" কাব্যগ্রন্থটি সত্তরের দশকের বাংলাদেশের এক ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে বিবেচিত। এই বইয়ে বর্ণিত প্রেম, যুদ্ধ, নৈতিক অবক্ষয় এবং স্বপ্নভঙ্গের বেদনা কেবল হেলাল হাফিজের ব্যক্তিগত অনুভূতি নয়, বরং তা ছিল একটি জাতির সম্মিলিত অভিজ্ঞতা। কাব্যগ্রন্থটি সেই অস্থির সময়কে শিল্পসম্মতভাবে ধারণ করে রেখেছে, যা ভবিষ্যতের গবেষক ও পাঠকদের জন্য এক মূল্যবান উৎস। এটি একটি প্রজন্মের দহনকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছে যা ইতিহাসের শুষ্ক পাঠের বাইরে গিয়ে আবেগময় উপলব্ধির সুযোগ করে দেয়।
সমালোচকরা হেলাল হাফিজের কবিতায় যুগচেতনা, কাব্যভাষা এবং শব্দের মিতব্যায়িতার প্রশংসা করেছেন। তারা তাঁর কবিতায় রোমান্টিকতা ও বাস্তবতার এক অপূর্ব সমন্বয় খুঁজে পেয়েছেন। যদিও তাঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা একটি, তবুও তাঁর কাব্যিক প্রভাব এবং মান নিয়ে কোনো সংশয় নেই। তিনি অল্প লিখেও বাংলা কবিতার ইতিহাসে তার আসন পাকাপোক্ত করেছেন। তাঁর কবিতা নিয়ে অনেক গবেষণাপত্র, প্রবন্ধ ও আলোচনা হয়েছে, যা তাঁর কাজের গুরুত্বের প্রমাণ দেয়।
হেলাল হাফিজের অনেক কবিতা গান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং নাটকে বা চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত সংলাপ হিসেবেও তা পরিচিতি লাভ করেছে। এই সাংস্কৃতিক ব্যাপ্তি তাঁর কবিতার আবেদনকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তাঁর কবিতাগুলো সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে মিশে গেছে, যা একজন কবির জন্য বিরল সম্মান।
হেলাল হাফিজের উত্তরাধিকার কেবল একটি কাব্যগ্রন্থের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা তাঁর জীবনযাত্রা, তাঁর নীরবতা এবং তাঁর কাব্যিক সততার মধ্যেও নিহিত। তিনি অল্প কিন্তু গভীর অর্থবহ লেখার মাধ্যমে বাংলা কবিতার জগতে এক কিংবদন্তী হয়ে উঠেছেন। তাঁর কাব্যভাষা এবং বিষয়বস্তু আজও নতুন প্রজন্মের কবিদের অনুপ্রাণিত করে চলেছে, যা প্রমাণ করে যে, "যে জলে আগুন জ্বলে" শুধু একটি কাব্যগ্রন্থ নয়, বরং এটি একটি জীবিত সত্তা, যা চিরকাল বাঙালি হৃদয়ে দহন ও আশার আগুন জ্বেলে যাবে।
হেলাল হাফিজের "যে জলে আগুন জ্বলে" কাব্যগ্রন্থটি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক দীপ্তময় সংযোজন, যা প্রকাশের তিন দশকেরও অধিক সময় পরেও তার প্রাসঙ্গিকতা ও আবেদন অক্ষুণ্ণ রেখেছে। এই কাব্যগ্রন্থটি কেবল ৫৬টি কবিতার এক সংকলন নয়, বরং এটি সত্তরের দশকের বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক দহনের এক শিল্পসম্মত দর্পণ। প্রেম, যুদ্ধ, নৈতিক অবক্ষয়, সামাজিক বঞ্চনা এবং ব্যক্তিগত স্বপ্নভঙ্গের মতো বিষয়গুলো এই গ্রন্থকে এক ঐতিহাসিক ও আবেগঘন দলিল হিসেবে উপস্থাপন করেছে।
কবির স্বতন্ত্র কাব্যভাষা তাঁকে বাংলা কবিতার ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান দিয়েছে। তাঁর সরল, সাবলীল এবং কথ্যরীতি-ঘনিষ্ঠ ভাষা সাধারণ মানুষের হৃদয়ে সহজে প্রবেশ করেছে। একইসাথে, তাঁর ব্যবহৃত চিত্রকল্প, প্রতীকী ব্যঞ্জনা, শব্দের মিতব্যায়িতা এবং তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ কবিতার গভীরে বহুস্তরীয় অর্থ প্রদান করেছে। হেলাল হাফিজ প্রমাণ করেছেন যে, কবিতার আবেদন তৈরি করতে জটিলতার প্রয়োজন নেই, বরং হৃদয়ের স্পন্দন এবং সোজাসাপটা শব্দই সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হতে পারে।
"যে জলে আগুন জ্বলে" কাব্যগ্রন্থের নামকরণের মধ্যেই এক গভীর প্রতীকী ব্যঞ্জনা নিহিত। যে জল জীবন দেয়, সেই জলেই যখন আগুন জ্বলে, তখন তা এক চরম বিপন্নতা এবং অস্বাভাবিকতার প্রতীক হয়ে ওঠে। এটি সেই অস্থির সময়ের প্রতিচ্ছবি যখন একটি সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন ও বাস্তবতা পরস্পরবিরোধী হয়ে ওঠে। এই অগ্নিদগ্ধ সময়ের সাক্ষী হিসেবে হেলাল হাফিজের কবিতাগুলো যুগযন্ত্রণার এক অমূল্য দলিল, যা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে আলোড়িত করে চলেছে।
হেলাল হাফিজের কাব্যচর্চা সংখ্যায় সীমাবদ্ধ হলেও, গুণগত দিক থেকে তা অসামান্য। তিনি অল্প লিখেও বাংলা কবিতার ইতিহাসে এক কিংবদন্তী হয়ে উঠেছেন। তাঁর কবিতাগুলো কেবল এক নির্দিষ্ট সময়ের প্রতিচ্ছবি নয়, বরং তা মানব অস্তিত্বের শাশ্বত সংগ্রাম, আশা এবং হতাশার এক চিরন্তন রূপ। তাঁর ভাষা, তাঁর দর্শন এবং তাঁর আন্তরিকতা ভবিষ্যতেও বাংলা কবিতার নবীন এবং প্রবীণ উভয় ধারাকেই অনুপ্রাণিত করতে থাকবে। "যে জলে আগুন জ্বলে" তাই কেবল একটি বই নয়, এটি এক প্রজন্ম, এক জাতির দহন ও আশার প্রতীক।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট এবং সহকারী অধ্যাপক (বাংলা) এশিয়ান উনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, আশুলিয়া, ঢাকা।
২১৪ বার পড়া হয়েছে