সর্বশেষ

মতামত

পশ্চিমা বিশ্বের মাথাব্যাথা : হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট মুভমেন্ট

মাসুদুল হাসান রনি
মাসুদুল হাসান রনি

সোমবার, ২০ অক্টোবর, ২০২৫ ৮:০৪ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে অতিমাত্রায় মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে অতি ডানপন্থীদের উত্থান। হোয়াইট সুপ্রীমিস্ট মুভমেন্ট ( শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী আন্দোলন) অভিবাসী ও অভিবাসন প্রত্যাশীদের জন্যও উদ্বেগের কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলির নজর বেড়েছে এই শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী আন্দোলন - এর ওপর। নিরাপত্তা বাহিনী 'সক্রিয় ক্লাবগুলি' পর্যবেক্ষণ করছে, যারা সীমান্ত পেরিয়ে তাদের চরমপন্থী মতাদর্শ ছড়িয়ে দিচ্ছে।

এর থেকে পরিত্রান খুঁজছে পশ্চিমারা। গোয়েন্দা নজরদারি ছাড়াও তারা মনে করছে, এই ধরনের মতাদর্শের ভিত্তি এবং এর ক্ষতিকারক প্রভাব সম্পর্কে মানুষকে শিক্ষিত করা গুরুত্বপূর্ণ। একই সাথে ভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং সমাজে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরির চেষ্টা করা প্রয়োজন। যদি কেউ ঘৃণা বা বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হন, তাহলে আইনি সহায়তা নেওয়া উচিত। অন্যদিকে, এমন নীতি ও রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থন করা উচিত যারা সমতা ও ন্যায়বিচারের পক্ষে কাজ করেন। অনেকে মনে করেন, এই পদক্ষেপগুলি সমাজের মানুষকে বৈষম্যের বিপদ বুঝতে এবং জাতিগত বৈষম্য মোকাবিলায় কাজ করতে অনুপ্রাণিত করতে পারে।

এই আন্দোলন সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে গিয়ে একটু পিছনের ইতিহাস দেখলে বোঝা যায়, শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী আন্দোলনের উৎস কোনো একটি নির্দিষ্ট সময় বা স্থানে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর শেকড় ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণার গভীরে প্রোথিত। উনিশ শতকের দিকে এই ধারণা একটি সুসংগঠিত মতাদর্শ হিসেবে আকার নেয়। বিশেষত: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথার অর্থনৈতিক শোষণকে বৈধতা দিতে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা ব্যবহার করা হতো।

 

এরপরই উপনিবেশ ও সাম্রাজ্যবাদের সম্প্রসারণের যুগে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো আফ্রিকা, এশিয়া এবং আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও টিকিয়ে রাখার জন্য জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের তত্ত্বকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। কিন্ত উনিশ শতকে বিভিন্ন দার্শনিক ও লেখক, যেমন ফরাসি লেখক আর্থার দে গোবিনো, জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাকে বিজ্ঞানের মোড়কে উপস্থাপনের চেষ্টা করেন। এই তত্ত্বগুলো এখন বাতিল বলে গণ্য হলেও, তখন তা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদকে শক্তিশালী করেছিল।

উনিশ শতকে বিভিন্ন দার্শনিক ও লেখক, যেমন ফরাসি লেখক আর্থার দে গোবিনো, জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাকে বিজ্ঞানের মোড়কে উপস্থাপনের চেষ্টা করেন। এই তত্ত্বগুলো এখন বাতিল বলে গণ্য হলেও, তখন তা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদকে শক্তিশালী করেছিল।

প্রথম দিকে এই বিদ্বেষ সুসংগঠিত ছিল না। কিন্ত মার্কিন গৃহযুদ্ধের পর ১৮৬৫ সালে পরাজিত দক্ষিণাঞ্চলের কিছু প্রাক্তন সৈন্য দ্বারা কু ক্লাক্স ক্লান (KKK) প্রতিষ্ঠিত হয়। সদ্যমুক্ত কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার খর্ব করতে এই দলটি সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদের আশ্রয় নেয়। যা সংগঠিত রূপে সংঘটিত হয়েছিল।

১৯১৫ সালের দিকে কু ক্লাক্স ক্লানের দ্বিতীয় রূপটি আরও বড় পরিসরে আত্মপ্রকাশ করে, যা কেবল কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে নয়, বরং ক্যাথলিক ও ইহুদিদের বিরুদ্ধেও ঘৃণা ছড়ায়।

বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় বিশেষত: পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে কৃষ্ণাঙ্গদের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সময়কালে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী আন্দোলন পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

এই আন্দোলনের উৎস এবং বিস্তার কেবল একটি ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে এর উদ্ভব ও প্রকাশ ঘটেছে।

আর্ন্তজাতিক অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং প্রভাবশালী দৈনিক দ্যা গার্ডিয়ান এর পর্যালোচনা করা সরকারি নথি অনুসারে, নব্য-ফ্যাসিবাদী লড়াই ক্লাবগুলি, যা নব্য-নাৎসিবাদের বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রস্থলে পরিনত হয়েছে। পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলির নজরে পড়েছে এবং তারা তাদেরকে ক্রমবর্ধমান জাতীয় নিরাপত্তা হুমকি বলে মনে করছে।

সক্রিয় ক্লাব বা সংগঠনগুলো অ্যাডলফ হিটলারের শিক্ষা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে উগ্র ডানপন্থী সক্রিয়তার ধারা প্রচারকারী। মার্শাল আর্ট গ্যাং এর ছদ্মাবরণে ক্লাব সদস্যরা সীমান্ত পেরিয়ে চলাচল করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু সরকারি নিরাপত্তা পরিষেবাগুলি তাদের উপর নজর রাখছে, একই ধরণের সংস্থাগুলি যারা ইসলামিক স্টেটের মতো নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠনগুলির উপর নজরদারি করার জন্য পরিচিত, তা দেখায় যে সক্রিয় ক্লাবগুলি কীভাবে ক্রমবর্ধমান এবং দ্রুত বর্ধনশীল হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গোয়েন্দা সংস্থাগুলি তাদের দেশে বিদ্যমান চরমপন্থী নেটওয়ার্কগুলি সম্পর্কে সচেতন থাকতে চায়, কাউন্টার এক্সট্রিমিজম প্রজেক্টের সন্ত্রাসবাদ বিশ্লেষক জোশুয়া ফিশার-বার্চ সক্রিয় ক্লাবগুলি সম্পর্কে গার্ডিয়ানকে জানান, বর্তমান বা ভবিষ্যতের সহিংসতার জন্য তাদের সম্ভাবনা এবং অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিকভাবে অন্যান্য আন্দোলন এবং ব্যক্তিদের সাথে তাদের কী সংযোগ থাকতে পারে সেই বিষয় সর্তক পর্যবেক্ষণ জরুরি ।

ইতিমধ্যেই, সেই আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের প্রমাণ প্রকাশিত হয়েছে।

পশ্চিমা দেশগুলো শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী আন্দোলন মোকাবিলায় বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন, যার মধ্যে রয়েছে নতুন আইন প্রণয়ন, অনলাইন প্রচারণার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং সচেতনতা বাড়ানো। তবে এই আন্দোলন দমনে পশ্চিমা দেশগুলো কিছু গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখিও হচ্ছে।

এই কারণে ইউরোপ, আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদকে অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। এর ফলে কর্তৃপক্ষ অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে এবং তাদের কার্যক্রম বন্ধ করতে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে পারছে। উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকা ও ইউরোপের কিছু দেশে এই ধরনের অপরাধে জড়িতদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ আনা হচ্ছে।

অপরাধ দমনে বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যে ইন্টারনেটে নজরদারি বাড়িয়েছে। কারণ, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো এই চরমপন্থী মতাদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার অন্যতম প্রধান মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

তাই সরকার ও প্রযুক্তি সংস্থাগুলো অনলাইনে ঘৃণা ও উসকানিমূলক বিষয়বস্তু প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে রয়েছে: চরমপন্থী ভিডিও ও পোস্ট মুছে ফেলা। ব্যবহারকারীদের উসকানিমূলক কনটেন্ট থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো নতুন কৌশল প্রয়োগ করছে।

সম্প্রীতি ও সমতার সমাজ এবং রাস্ট্র গঠনে যে কোন বর্ণ বৈষম্য হুমকি। সরকারগুলো রাস্ট্র ও সমাজের স্থিতিশীলতা ও শান্তির জন্য শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের আদর্শ এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনগণকে শিক্ষিত করার উদ্যোগী হয়েছে। সমাজে বহুত্ববাদ, সাম্য ও অন্তর্ভুক্তির গুরুত্ব তুলে ধরা হচ্ছে। এর ফলে চরমপন্থী মতাদর্শের বিরুদ্ধে একটি সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে উঠছে।

কিছু ইউরোপীয় দেশে বিশেষ করে জার্মানিতে কিছু কর্মসূচি নেয়া হয়েছে, যা চরমপন্থী গোষ্ঠী থেকে বেরিয়ে আসতে চাওয়া ব্যক্তিদের সাহায্য করে। এই কর্মসূচিগুলো তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করছে।

সাম্প্রতিক সময়ে অতি ডানপন্থার উত্থানে নড়েচড়ে বসেছে পশ্চিমা দেশগুলো। শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ মোকাবিলায় নিজেরা একে অপরকে আন্তর্জাতিকভাবে সহযোগিতা করছে। এ বিষয়ে তথ্য আদান-প্রদান এবং যৌথ কৌশল প্রণয়নের জন্য সম্মেলন ও আলোচনা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

দেশে দেশে চরমপন্থার প্রতিরোধের চেষ্টা সত্ত্বেও, এই আন্দোলন মোকাবিলায় কিছু প্রধান বাধা রয়েছে। অভিবাসন-বিরোধী ও জাতিগত বিভাজনমূলক বক্তব্য অনেক সময় রাজনৈতিক মূলধারায় প্রবেশ করছে। কিছু রাজনীতিবিদ ছদ্মবেশী (dog-whistle) বা প্রকাশ্যভাবে এমন ভাষা ব্যবহার করছেন, যা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের মতবাদকে আরও শক্তিশালী করে তুলছে, যা খুবই দু:খজনক।

দিন দিন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণগুলো এই আন্দোলনকে আরও জটিল করে তুলছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অতি ডানপন্থা রুখতে এক্ষুনি গভ: টু গভ: আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক জোরদার করা জরুরি। তাই এর মোকাবিলায় আইন প্রয়োগের পাশাপাশি একটি বহুমুখী ও সামগ্রিক কৌশল প্রয়োজন।


লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।

( দ্যা গার্ডিয়ানে প্রকাশিত বেন মাকুচ এর the far right অবলম্বণে লেখা)

১২৩ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন