লালন: মানবতার চিরন্তন জ্যোতি

রবিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৫ ৩:২০ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাংলার আধ্যাত্মিক জগতের অনন্য সাধক ফকির লালন সাঁই শুধুমাত্র একজন গীতিকবি বা দার্শনিক ছিলেন না; তিনি ছিলেন মানবতার এক উজ্জ্বল প্রতীক।
কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় তাঁর তিরোধান দিবসকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর যে অনুষ্ঠান পালিত হয়, তা এখন মানবপ্রেম, সাম্যের ভাবনা এবং বিরোধহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার এক অনন্য সমাবেশে রূপ নিয়েছে। এ বছর লালনের ১৩৫তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠিত তিনদিনব্যাপী এই উৎসবে দেশ-বিদেশের অসংখ্য ভক্ত, গবেষক ও দর্শনার্থী অংশ নিয়েছেন।
স্মরণ অনুষ্ঠানের আবহ
১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর (১ কার্তিক) ছেঁউড়িয়ায় লালন সাঁই দেহত্যাগ করেন। এই দিনকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর কার্তিক মাসে পালিত হয় তিরোধান দিবস ও মেলা। ভোরের কীর্তন, সন্ধ্যার আখড়া গান ও সারারাতের ধুন-সাধনায় মুখর থাকে ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়ি। চৈত্র মাসে এখানেই পালিত হয় লালনের আবির্ভাব তিথি বা দোলপূর্ণিমা মেলা। এই দুই উৎসবই বাংলাদেশে বাউল সংস্কৃতির প্রাণস্বরূপ।
লালনের জীবন ও দার্শনিক পথ
বিশ্বাসযোগ্য তথ্য অনুযায়ী লালনের জন্ম ১৭৭৪ সালে ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুন্ডু উপজেলার হরিশপুর গ্রামে। তরুণ অবস্থায় তীর্থযাত্রায় গিয়ে বসন্তরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুপথযাত্রী অবস্থায় এক হিন্দু-কারিগর দম্পতির আশ্রয়ে ফিরে জীবন পান। সুস্থ হয়ে নিজের সমাজে ফিরে এলে ‘অন্য ধর্মের গৃহে’ আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগে সমাজচ্যুত হন। এই ঘটনাই তাঁকে ধর্ম ও বর্ণবৈষম্যের প্রতি ঘৃণা আর মানবতার প্রতি অগাধ ভালোবাসার পথে নিয়ে যায়।
পরে তিনি সিরাজ সাঁইয়ের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। সিরাজের নির্দেশনায় লালন আত্মানুশীলন ও দেহতত্ত্ব সাধনার মধ্য দিয়ে ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবির’ দর্শনকে উপলব্ধি করেন। তাঁর কাছে মানুষের আত্মা ছিল ঈশ্বরের প্রতিরূপ—যেখানে সত্য ও প্রেমের সংমিশ্রণ ঘটে।
ছেঁউড়িয়া আখড়াবাড়ি
ছেঁউড়িয়ায় লালন প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর সাধনার কেন্দ্র ‘আখড়াবাড়ি’। এখানেই কীর্তন, ধ্যান, আলোচনা চলত রাতভর। আখড়াবাড়ি ছিল মুক্তচিন্তা, সত্যসন্ধান ও মানবধর্মচর্চার কেন্দ্রস্থল। মৃত্যুর পর এখানেই তাঁর সমাধি এবং এই স্থানই আজ বাংলাদেশের এক প্রাচীন আধ্যাত্মিক তীর্থ।
মানবতাবাদী দর্শন
লালনের মূল দর্শন মানবতাবাদ। তিনি বলেছিলেন—মানুষের মধ্যেই আছে সৃষ্টিকর্তা; মানুষকে না চিনে ঈশ্বরকে চেনা যায় না। তাঁর গানে বারবার উঠে এসেছে বর্ণ-ধর্মের উর্ধ্বে “মানুষই ধর্ম” এই মর্মবাণী। নারী-পুরুষ সমতা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসা তাঁর দর্শনের শেকড়।
লালনের গান ও প্রভাব
লালনের গান—‘সব লোকের মত আমি নই’, ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’, ‘গুরুর ভজনা’, ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’—প্রতিটি সংগীতেই নিহিত আছে দার্শনিক গভীরতা। এসব গানে আত্মপরিচয়ের খোঁজ, মানবজীবনের রহস্য এবং মরমী মুক্তির বার্তা একসূত্রে মিশে গেছে। গবেষকদের ধারণা মতে তাঁর লিখিত গানের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার, সংরক্ষিত আছে ছয় শতাধিক।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনের গানের অনন্যতাকে স্বীকার করে বলেছিলেন এটি “বাঙালি সমাজ‑আত্মার পবিত্র স্বর”। তাঁর ভাবধারা শুধু বাউল জীবন নয়, পরবর্তী সমাজ‑রাজনীতি ও কবিতাতেও গভীর প্রভাব ফেলেছে।
জাতীয় স্বীকৃতি ও তাৎপর্য
বর্তমানে লালনের তিরোধান দিবস শুধু স্থানীয় নয়, এখন জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠান। ২০২৫ সালে বাংলাদেশ সরকার এটি ‘ক‑শ্রেণিভুক্ত জাতীয় দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। তিন দিনব্যাপী এ আয়োজনে থাকে ফকিরদের ধুন, আধ্যাত্মিক আলোচনা, বাউলগান ও দর্শনানুষ্ঠান। ভক্তরা দেশ‑বিদেশ থেকে এসে অংশ নেন এই মানবতার উৎসবে।
লালনের চেতনা আজও জাগ্রত
আজকের পৃথিবীতে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও সামাজিক বিভাজনের যুগে লালনের দর্শন আরও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। তাঁর বার্তা—“মানুষকেই ভালোবাসো, তাহলেই ঈশ্বরকে খুঁজে পাবে”—আজও মানবতার পথনির্দেশ।
সারসংক্ষেপ
ফকির লালন সাঁই কেবল একজন সাধক নয়, তিনি ছিলেন মানবধর্মের প্রবক্তা। তাঁর দর্শন প্রমাণ করে মানুষে মানুষে ভালোবাসাই চরম মুক্তি, এবং সত্যিকার জানা মানে নিজেকে জানা। তাঁর বাণীই আজও ছেঁউড়িয়ার বাতাসে ভেসে আসে—মানুষ হয়ে মানুষকে ভালোবাসাই ঈশ্বরের সাধনা।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
১৪৩ বার পড়া হয়েছে