অক্টোবর মাসে বাংলাদেশজুড়ে অগ্নিকাণ্ড: নাশকতার সন্দেহ ও ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা

রবিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৫ ৩:১০ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
অক্টোবর ২০২৫ মাসে বাংলাদেশজুড়ে একের পর এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড দেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক শঙ্কার জন্ম দিয়েছে।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, কক্সবাজারসহ অন্তত সাতটি বড় শহরে সিরিজ অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানি, আর্থিক ক্ষতি ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে গভীর প্রশ্ন উঠে এসেছে। বিপর্যয়গুলো শুধু দুর্ঘটনাজনিত নয়, বরং পরিকল্পিত নাশকতার সন্দেহও দানা বাঁধছে দেশে-বিদেশে।
শহরভিত্তিক বড় অগ্নিকাণ্ড
এই মাসের শুরু থেকে সারা দেশে মোট উল্লেখযোগ্য সাতটি বড় অগ্নিকাণ্ডের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকা মহানগরীতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ–এ ১৮ অক্টোবরের আগুন সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা, যেখানে ৩৭টি ফায়ার ইউনিট, সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী সমন্বয়ে সাত ঘণ্টার অভিযান চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এতে অসংখ্য যান্ত্রিক ও কার্গো মালপত্র ধ্বংস হয়, আহত হন ২৫ জন আনসার সদস্য।
ঢাকার মিরপুরে ১৪ অক্টোবর রাতে গার্মেন্ট কারখানা ও কেমিক্যাল গুদামে আগুনে অন্তত ১৬ জন শ্রমিক নিহত হন।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ-তে মেঘনা গ্রুপের চিনি কারখানায় বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে ব্যাপক আগুন ধরে যায়, যদিও কোন প্রাণহানী ঘটেনি। দোকানপাট, মালামাল ও স্থাপনা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
চট্টগ্রাম ইপিজেড এলাকার টেক্সটাইল কারখানায় ১৫ অক্টোবর ১৭ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস অগ্নিকাণ্ড চলে, যাতে শতাধিক শ্রমিক ও স্টাফ দ্রুত স্থানত্যাগ করে, এবং ভবনের বড় অংশ ধ্বংস হয় । একই বিভাগে ফটিকছড়ি বাজারেও বাজারের আট দোকান পুড়ে যায়।
খুলনা, গাজীপুর, এবং সর্বশেষ আলোচিত কক্সবাজারে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনে কম্পিউটার ল্যাবে অগ্নিকাণ্ড ঘটে, যেখানে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অল্পের জন্য জীবন রক্ষা পায়।
নাশকতার সন্দেহ ও তদন্ত
ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশে শিল্প-কারখানার অগ্নিকাণ্ডগুলো বিদ্যুৎ, কেমিক্যাল দুর্ঘটনা ও নিরাপত্তা ঘাটতির কারণে বেশি ঘটে। কিন্তু এবারের ধারাবাহিক ঘটনাসমূহের “টার্গেট” এবং একে অপরের কাছাকাছি সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ জনমনে নাশকতার আশঙ্কা উস্কে দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সবক’টি ঘটনার তদন্ত চলছে—যদি নাশকতা বা চক্রান্তের প্রমাণ পাওয়া যায়, দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
শাহজালাল বিমানবন্দরের অগ্নিকাণ্ডে তদন্ত কমিটির প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, একাধিক স্থানে একই সময়ে আগুন লাগা, রাসায়নিক মজুদের অসংগতি ইত্যাদি “স্বাভাবিক দুর্ঘটনার” সঙ্গে যায় না । রাজনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ ও বিরোধী দলের নেতারাও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, “এমন সার্বিক ঘটনা রাজনৈতিক চক্রান্তের অংশ হতে পারে”।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কয়েকজন নেতা বলেছেন, দেশের বিভিন্ন কৌশলগত স্থাপনায় বারবার আগুন লাগা “চক্রান্তমূলক অন্তর্ঘাতের অংশ হতে পারে”। অপরদিকে সরকারি সূত্র দাবি করেছে, “পলাতক রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও বহিরাগত অর্থনৈতিক স্বার্থগোষ্ঠী হয়তো পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে”।
এইসব সন্দেহের মধ্যেও সরকারি ও স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চূড়ান্ত তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত একে নিছক দুর্ঘটনা বা নাশকতা হিসেবে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়।
দুর্বল ব্যবস্থাপনার মূল কারণসমূহ
সাম্প্রতিক আশঙ্কাজনক অগ্নিকাণ্ডগুলো বিশ্লেষণ করলেই মৌলিক দুর্বলতাগুলোর ছোটোখাটো একগুচ্ছ মিল খুঁজে পাওয়া যায়—যেগুলো যুগের পর যুগ বাংলাদেশকে ঝুঁকির মুখে রেখেছে।
পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ বৈদ্যুতিক লাইন: অধিকাংশ পুরনো ভবন ও কারখানাতে রক্ষণাবেক্ষণহীন বৈদ্যুতিক নেটওয়ার্ক; আধুনিক ফায়ার ডিটেকশন ও কারেন্ট ট্রিপিং সিস্টেম নেই।
অগ্নি-নিরাপত্তা প্ল্যান ও সরঞ্জামের অভাব: অধিকাংশ বাণিজ্যিক ও শিল্প ভবনে গৌণ বা মেয়াদোত্তীর্ণ অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র; নেই কার্যকর জরুরি বহির্গমন বা হাইড্র্যান্ট ব্যবস্থা।
কেমিক্যাল মজুদের খোলা বিশৃঙ্খলা: অনুমোদনহীন কেমিক্যাল ও দাহ্য দ্রব্যাদি একই সাথে সংরক্ষণ, যেমন মিরপুর ও শাহজালাল বিমানবন্দরে দেখা গেছে।
জরুরি সাড়া ও সমন্বয়হীনতা: যানজট, সংকীর্ণ রাস্তা, জলাধার ও পানির উৎসের অপ্রতুলতা; স্থানীয় প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব।
ব্যবস্থাপনা ও আইন প্রয়োগের দুর্বলতা: নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলো রাজনৈতিক/অর্থনৈতিক চাপে সুষ্ঠু নজরদারী ও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে পারে না।
অবিকল্পিত নগরায়ন ও জনসচেতনতার ঘাটতি: ব্যবসা-বাণিজ্য-আবাসিক এলাকা গাদাগাদি; অগ্নি নিরাপত্তার গুরুত্ব ও প্রশিক্ষণ নিয়ে জনসাধারণের চরম উদাসীনতা।
শেষ কথা
বিশেষজ্ঞ, প্রশাসন ও সমাজ সবাই মিলে বিশ্বাস করেন, অক্টোবরে ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ডগুলো বাংলাদেশের অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থায় যুগান্তকারী সংস্কার না হলে দেশের শিল্প, ব্যবসা ও জনজীবনে আরও বহু বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। চূড়ান্ত তদন্তের পর যদি নাশকতার যোগসূত্র মেলে, তবে দেশের জন্য এটি আরও বড় সংকেত—প্রশাসনকে কেবল দুর্ঘটনা নির্ভর অজুহাতে সীমাবদ্ধ না থেকে নিরাপত্তা ও সুশাসনের দিকেই নজর বাড়াতে হবে।
এখনই কঠোর আইন, দুর্নীতিমুক্ত তদারকি, অডিটিং, আধুনিক ফায়ার টেকনোলজি বাস্তবায়ন ও সচেতনতাই পারে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রক্ষা করতে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
১৩৬ বার পড়া হয়েছে