লালন: মনুষ্যত্বের সাধক, সময়ের আয়নায় এক চিরন্তন দার্শনিক

শনিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৫ ৪:৩৭ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাংলার মাটি ও মানুষের ইতিহাসে এক বিস্ময়কর নাম- ফকির লালন শাহ। ধর্ম, জাত, বর্ণ, লিঙ্গ কিংবা সমাজব্যবস্থার সমস্ত বিভাজনরেখা অতিক্রম করে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন 'মানুষ' নামের এক সর্বজনীন সত্তার সামনে।
তাঁর গানের বাণীতে যে মানবতাবোধ, যে দর্শন, যে মুক্ত চিন্তার বীজ নিহিত, তা আজও আমাদের সময়ের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় পথনির্দেশ। তাঁর তিরোধান দিবস সময়কালে আমরা ফিরে দেখি লালনের আখড়াবাড়ি, তাঁর ভাবজগত, দর্শন, ইতিহাস এবং সময়ের প্রেক্ষাপটে তাঁর চিরজীবী প্রয়োজনীয়তাকে।
কুষ্টিয়ার আখড়াবাড়ি: সাধনার প্রাণকেন্দ্রঃ
কুষ্টিয়া জেলার ছেঁউড়িয়ায় অবস্থিত লালনের আখড়াবাড়ি এক তীর্থস্থান। সেই সাথে এটি বাংলার আধ্যাত্মিক চিন্তার এক প্রতীকী কেন্দ্র। এখানে এখনো প্রতিদিন ভক্তবৃন্দ লালনের গান গেয়ে তাঁর ভাবধারাকে ধারণ করেন। আখড়ার মূল মন্দিরটি মাটির ঘর, যার চারপাশে রয়েছে বাউলদের আশ্রম, পাঠশালা এবং সাধনার জায়গা।
আখড়াবাড়ির মূল বার্তা- 'ধর্ম নয়, মানুষই সাধনার কেন্দ্রবিন্দু।' এখানকার উৎসবগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো দোলপূর্ণিমা এবং লালনের তিরোধান দিবস। প্রতি বছর বাংলা চৈত্র মাসে লাখো মানুষ ছেঁউড়িয়ায় আসেন তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে, যেখানে দেশ-বিদেশের বাউল ও সাধকেরা মিলিত হন মানবতার এক মহামেলায়।
সূত্র: লালন একাডেমি, কুষ্টিয়া; বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন।
লালনের জীবন ও ইতিহাস: রহস্য ও বাস্তবতার মেলবন্ধনঃ
লালনের জন্ম সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য নেই। অধিকাংশ গবেষক মনে করেন, তিনি ১৭৭৪ সালের দিকে কুষ্টিয়া অঞ্চলে জন্মেছিলেন এবং ১৮৯০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর শৈশব সম্পর্কে জানা যায়- একবার তিনি তীর্থযাত্রায় গিয়েছিলেন এবং ফেরার পথে গুটিবসন্তে আক্রান্ত হন। মৃত্যুর মুখে তাঁকে স্থানীয় এক মুসলমান পরিবার আশ্রয় দেয় ও সেবা করে। এই মানবিক ঘটনার ফলেই লালনের মনে ধর্মীয় বিভাজন ভেঙে যায়।
লালন পরে নিজেকে কোনো ধর্মের মধ্যে আবদ্ধ রাখেননি। তিনি নিজেকে পরিচয় দিতেন- 'আমি মানুষ'। এ পরিচয়ই তাঁর চিন্তার মর্মবাণী।
সূত্র: ড. আনিসুজ্জামান, লালন সাঁই: জীবন ও দর্শন; আবদুল মান্নান সৈয়দ, লালনের লোকধর্ম ও বাউল দর্শন।
লালন দর্শনের মূলে মনুষ্যত্ব ও মুক্তিঃ
লালনের দর্শনের কেন্দ্রে রয়েছে মানুষের মুক্তি-কোনো ধর্মীয় বিধান নয়, আত্মবোধের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা। তাঁর ভাষায়,'সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।' তাঁর গানে বারবার উঠে এসেছে আত্মা ও দেহ, ঈশ্বর ও মানবের অভিন্নতা-'মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।' লালনের কাছে ঈশ্বর কোনো মন্দির, মসজিদ বা ধর্মগ্রন্থে আবদ্ধ নন; তিনি 'মানুষের দেহে'- 'দেহতত্ত্ব' তাঁর দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাঁর মতে, মানুষ নিজের ভেতরের অন্ধকার দূর করতে পারলেই মুক্তি পায়। এই মুক্তিই তাঁর 'ফকিরি' ভাবজগতের লক্ষ্য।
লালন ও সমাজ: সাম্যের ভাষায় প্রতিবাদঃ
লালনের সময়কার সমাজ ছিল জাতপাত ও ধর্মীয় বিভাজনে জর্জরিত। তিনি এসবের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন গানকে অস্ত্র করে। 'জাত গেলো জাত গেলো বলে, একি আজব কারখানা/সত্য মিথ্যা যেথায় বেতালা, সেইখানে ধর্ম খানা।'
এই গানের ভেতরে লুকিয়ে আছে সমাজের প্রতি তাঁর প্রতিবাদী সুর- যেখানে মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখা না গেলে, সব ধর্ম, সব বিধান অর্থহীন হয়ে পড়ে। লালন ছিলেন একাধারে সমাজ সংস্কারক ও চিন্তাশিল্পী। তিনি নারীর সমানাধিকারে বিশ্বাস করতেন, যা উনিশ শতকের প্রেক্ষাপটে ছিল যুগান্তকারী চিন্তা। তাঁর গান 'নারীর ভেতর পুরুষ আর পুরুষের ভেতর নারী'- আজকের লিঙ্গসমতার দার্শনিক ভিত্তিও স্থাপন করে।
সূত্র: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে সংরক্ষিত বাউল সাহিত্যের পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ।
গানের মাধ্যমে দার্শনিক প্রকাশঃ
লালনের গান কেবল লোকসংগীত নয়; এগুলো জ্ঞানতত্ত্ব, দর্শন ও সমাজ বিশ্লেষণের ভাষা। তাঁর রচিত প্রায় পাঁচশত গান পাওয়া গেছে, যেগুলোর মূল বিষয় আত্মজিজ্ঞাসা, মানবপ্রেম ও ঈশ্বর-অনুসন্ধান। লালনের গানে যে আত্মানুসন্ধানী বোধ, তা আধুনিক দর্শনের সঙ্গেও তুলনীয়। যেমন তিনি বলেন- 'আত্মার মাঝে পরমাত্মা, খুঁজলে তায় পাবে।' এই দর্শন পশ্চিমের সক্রেটিসের 'Know thyself' উক্তির মতোই মানবচেতনার অন্তঃসন্ধানে আহ্বান করে।
লালন ও রবীন্দ্রনাথ: ভাবধারার সেতুবন্ধনঃ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনের গানে মুগ্ধ হয়েছিলেন। ১৯০৫ সালে তিনি কুষ্টিয়া সফরে গিয়ে লালনের শিষ্যদের গান শোনেন এবং পরে 'বাংলার বাউল' প্রবন্ধে লালনকে বর্ণনা করেন 'বাংলার অন্তরের সাধক' হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ লালনের মানবধর্মকে 'বিশ্বমানবতার মূলচিন্তা' হিসেবে দেখেছিলেন। তাঁর গানে যেমন 'যেজন প্রেমের ভাব জানে না, তার জীবনে ব্যর্থতা,' তেমনি রবীন্দ্রনাথের 'প্রেমই শ্রেষ্ঠ ধ্যান'- এই দুই ভাব একই স্রোতের দুই তীর।
সূত্র: রবীন্দ্র রচনাবলী, খণ্ড ২৫; বাংলার বাউল প্রবন্ধ।
বর্তমান প্রজন্ম ও লালন দর্শনের পুনরাবিষ্কার
আজকের প্রযুক্তি-নির্ভর, বিভাজিত ও সংকীর্ণ সময়েও লালন আমাদের শেখান মানুষকে মানুষ হিসেবে ভালোবাসতে। ধর্মীয় সহনশীলতা, সামাজিক সহাবস্থান, মানবিক ন্যায়বোধ- সবই তাঁর দর্শনের মূলে অবস্থান করে।
আজকের তরুণ প্রজন্ম যখন মৌলিক পরিচয়ের সংকটে ভুগছে, তখন লালনের এই বাণী- 'খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়'- আমাদের শেখায় আত্মপরিচয়ের সন্ধান। কুষ্টিয়ার আখড়ায় এখন তরুণ বাউলরা লালনের গানের নতুন সুরে মানবতার কথা গেয়ে চলেছেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে লালন উৎসব আয়োজন, একাডেমি প্রতিষ্ঠা ও গবেষণা কেন্দ্র গড়ে উঠেছে- যা প্রশংসনীয়। তবে বাণিজ্যিকীকরণের প্রবণতা তাঁর ভাবধারাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, এ বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি।
সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা: ধর্মান্ধতার যুগে লালন দর্শনের আহ্বানঃ
আজ যখন পৃথিবী ধর্মীয় উগ্রতা, ঘৃণা ও বিভেদের আগুনে জ্বলছে, তখন লালনের দর্শনই হতে পারে শান্তি ও সাম্যের একমাত্র পথ। তিনি আমাদের আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন- 'সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে,
লালন কয় জাতির কি রূপ দেখলাম না এই নজরে।' এই গান এক অনন্ত প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায় আমাদের- মানুষ কি এখনও মানুষ হতে পেরেছে? লালন ছিলেন রাষ্ট্রের বাইরের, কিন্তু তাঁর দর্শন আজ রাষ্ট্রনীতির ভেতরেও থাকা উচিত-মানবিকতা, সহনশীলতা ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে।
লালন শাহ আমাদের শেখান মানুষকে ভালোবাসা মানে ঈশ্বরকে ভালোবাসা। তিনি যে মানবধর্মের বীজ বপন করেছিলেন, তা আজও বিকশিত হচ্ছে বাউল গানে, মানুষের চেতনায় এবং বাংলার মাটিতে। তাঁর তিরোধান দিবসকালে আমরা যদি অন্তত এইটুকু বুঝতে পারি- ধর্মের বিভেদে কোনো বিচ্ছিন্নতা নয়, মানুষই চূড়ান্ত বিবেচ্য, তাহলে কুষ্টিয়ায় লালনের আখড়াবাড়িটিও দিনেদিনে হয়ে উঠবে সমগ্র বিশ্ববাসীর আত্মার তীর্থস্থান।
তথ্যসূত্রঃ
১. ড. আনিসুজ্জামান, লালন সাঁই: জীবন ও দর্শন, বাংলা একাডেমি, ২০০২।
২. আবদুল মান্নান সৈয়দ, লালনের লোকধর্ম ও বাউল দর্শন, অয়ন প্রকাশনী, ১৯৯৬।
৩. লালন একাডেমি, কুষ্টিয়া, বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২৪।
৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলার বাউল, রবীন্দ্র রচনাবলী, খণ্ড ২৫।
৫. বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন, সোনারগাঁও, ২০২৩।
লেখকঃ কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
২০৯ বার পড়া হয়েছে