সর্বশেষ

সাহিত্য

নজরুল: দ্রোহের আগুনে, প্রেমের ফাগুনে

গাউসুর রহমান
গাউসুর রহমান

শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২৫ ৬:২১ অপরাহ্ন

শেয়ার করুন:
কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) বাংলা সাহিত্যের এক বিস্ময়কর প্রতিভা, যিনি তাঁর স্বল্পকালীন সাহিত্য জীবনে বিদ্রোহ ও প্রেমের এক অনবদ্য মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন।

পরাধীন ভারতবর্ষে তাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল এক ক্রান্তিকালে, যখন একদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ দেশ, অন্যদিকে সমাজের গভীরে প্রোথিত ছিল জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণের বিভেদ, নারী-পুরুষের বৈষম্য আর অর্থনৈতিক শোষণ। এমন এক অস্থির সময়ে নজরুল শুধুমাত্র একজন কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেননি, তিনি হয়ে উঠেছিলেন শোষিত-বঞ্চিত মানুষের কণ্ঠস্বর, বিপ্লবের মশাল হাতে এক নির্ভীক সেনানী। কিন্তু এই দ্রোহের অগ্নির মধ্যেই প্রস্ফুটিত হয়েছিল তাঁর অন্তরের গভীর প্রেমবোধ, যা তাঁকে একইসাথে 'বিদ্রোহী কবি' এবং 'প্রেমের কবি'র বিরল উপাধিতে ভূষিত করেছে।

নজরুলের সাহিত্যকর্মের গভীরে প্রবেশ করলে দেখা যায়, তাঁর দ্রোহ কোনো বিচ্ছিন্ন আবেগ ছিল না; বরং তা ছিল গভীর এক প্রেমবোধের প্রতিচ্ছবি – মানুষ, মানবতা, স্বদেশ, এবং সর্বজনীন মুক্তির প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা। তাঁর প্রেমও ছিল না কেবল ব্যক্তিগত বা নিছক রোম্যান্টিকতার গণ্ডিতে আবদ্ধ; তা ছিল সমাজ, প্রকৃতি, ঈশ্বর এবং সমস্ত সৃষ্টির প্রতি এক বিশাল উন্মুক্ত হৃদয়। এই প্রবন্ধে আমরা নজরুলের সাহিত্যকর্মে দ্রোহ ও প্রেমের দুটি প্রধান ধারাকে পৃথকভাবে বিশ্লেষণ করব এবং দেখাব কীভাবে এই দুটি বৈশিষ্ট্য তাঁর অনন্য কাব্যপ্রতিভায় একীভূত হয়ে তাঁকে বাংলা সাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। বিভিন্ন কবিতা, গান ও প্রবন্ধ থেকে প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি এই বিশ্লেষণের প্রধান অবলম্বন হবে।
 
নানা বিশ্লেষক নজরুলের এই দ্বৈত সত্তাকে বিভিন্নভাবে দেখেছেন। গোলাম মুরশিদ তাঁর 'বিদ্রোহী রণক্লান্ত নজরুল-জীবনী'তে নজরুলের বিপ্লবী জীবনকে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন, আবার অমিত দেবীর 'বিদ্রোহী কবি নজরুল' এবং পারভীন আক্তার জেমীর 'নজরুল সাহিত্যে বিপ্লবী চেতনা' তাঁর দ্রোহী সত্তার উপর আলোকপাত করেছে। অন্যদিকে, তাঁর প্রেমময় সত্তা নিয়েও বহু আলোচনা হয়েছে, যদিও দ্রোহের তুলনায় হয়তো একটু কমই। এই প্রবন্ধের লক্ষ্য হলো, দুটি বিষয়কেই সমান গুরুত্ব দিয়ে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও প্রভাব বিশ্লেষণ করা।


নজরুলের সাহিত্যিক বিকাশের প্রেক্ষাপট অনুধাবন করতে হলে বিশ শতকের প্রথম দিকের ভারতবর্ষের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা থাকা আবশ্যক। এই সময়টা ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের চরম নিপীড়নের কাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ড, অসহযোগ আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলন – এসব ঘটনা জনজীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। দেশপ্রেমিক তরুণদের মনে জেগেছিল স্বাধীনতার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, আর শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মনে পুঞ্জীভূত হয়েছিল বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ।


এই সময় বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বর্ণযুগ চলছিল, যিনি তাঁর শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীর মাধ্যমে এক নতুন সাংস্কৃতিক জাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের জীবনযন্ত্রণা, পরাধীনতার গ্লানি ও বৈষম্যের তীব্র দহন রবীন্দ্রনাথের শান্ত-সমাহিত সুরের বাইরে এক ভিন্ন কণ্ঠস্বরের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করাচ্ছিল। ঠিক এমন এক মুহূর্তে, ১৯২০-এর দশকে, ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হন কাজী নজরুল ইসলাম।

নজরুলের ব্যক্তিগত জীবনও তাঁর সাহিত্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। দারিদ্র্যের কশাঘাত, রুটির দোকানে কাজ, মক্তবে শিক্ষকতা, লেটোর দলের অভিজ্ঞতা, সৈনিক জীবন – এসবই তাঁকে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। সৈনিক জীবনে তিনি পারস্য সাহিত্য ও সঙ্গীতের সাথে পরিচিত হন, যা তাঁর কাব্য ও সঙ্গীতে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে কাটানো দিনগুলো তাঁর মধ্যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা আরও দৃঢ় করে। সৈনিক জীবন থেকে ফিরে এসে তিনি সরাসরি যুক্ত হন স্বাধীনতা আন্দোলনে। 'বিজলী' পত্রিকায় 'বিদ্রোহী' কবিতা প্রকাশের পর তিনি রাতারাতি খ্যাতি লাভ করেন এবং তাঁর কলম হয়ে ওঠে পরাধীন জাতির মুক্তির হাতিয়ার।

মণি উদ্দিন খান তাঁর 'যুগসৃষ্টিকারী নজরুল' গ্রন্থে নজরুলের এই যুগান্তকারী প্রভাব সম্পর্কে লিখেছেন, "নজরুল ইসলামের আবির্ভাব বাংলা সাহিত্যের এক নতুন পর্বের সূচনা করে। তিনি কেবল একজন কবি ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন যুগসৃষ্টিকারী ব্যক্তিত্ব, যিনি তাঁর দ্রোহ আর প্রেম দিয়ে এক নতুন কালের ডাক দিয়েছিলেন।" (খান, মণি উদ্দিন, 'যুগসৃষ্টিকারী নজরুল')। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় তাঁর 'আমার বন্ধু নজরুল' গ্রন্থে নজরুলের ব্যক্তিগত জীবনের সংগ্রাম ও তাঁর বিপ্লবী চেতনা বিকাশে পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন।


নজরুলের সাহিত্যকর্মের এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে দ্রোহের প্রখর অভিব্যক্তি। এই দ্রোহ ছিল বহুমুখী – রাজনৈতিক পরাধীনতার বিরুদ্ধে, সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে এবং সর্বপ্রকার অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে। তাঁর দ্রোহ ছিল ধ্বংসের জন্য নয়, বরং নতুন সৃষ্টির জন্য, শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য।

নজরুলের দ্রোহের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রকাশ ঘটে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁর লেখনীতে। তিনি সরাসরি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন, পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার আহ্বান জানান। তাঁর বিখ্যাত কবিতা 'বিদ্রোহী' এই দ্রোহের এক জ্বলন্ত ইশতেহার। ১৯২২ সালে প্রকাশিত এই কবিতা তৎকালীন সমাজে এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এর প্রতিটি

পঙক্তি ছিল যেন পরাধীন জাতির বক্ষে মুক্তির স্পৃহা জাগিয়ে তোলার মন্ত্র: "আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সূত বিশ্ববিধাত্রীর! বল বীর – বল উন্নত মম শির! শির নেহারি’ আমারি, নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!"

 এই কবিতায় নজরুল নিজের সত্তাকে মহাবিশ্বের সকল শক্তির প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি নিজেকে ধূমকেতু, ঈশান, সাইক্লোন, বিধির বাঁধনহারা, চঞ্চলা বিধবার সদ্যোতৈলাক্ত শাড়ি, অশান্ত, রুদ্র আখ্যা দিয়ে পরাধীনতার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিদ্রোহের ঘোষণা করেছেন। একইসাথে তিনি অত্যাচারীর বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত এবং সকল শৃঙ্খল ভাঙতে অঙ্গীকারবদ্ধ: "আমি চির-বিদ্রোহী বীর, আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!"

অমিত দেবীর 'বিদ্রোহী কবি নজরুল' গ্রন্থে এই কবিতার বিপ্লবী তাৎপর্য বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে 'বিদ্রোহী' কবিতাটি তৎকালীন যুবসমাজকে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল। (দেবী, অমিত, 'বিদ্রোহী কবি নজরুল')।

'প্রলয়োল্লাস' কবিতাতেও নজরুলের দ্রোহী সত্তার আরও এক রূপ দেখা যায়। এখানে তিনি ধ্বংসের মধ্যে দেখেছেন নতুন সৃষ্টির সম্ভাবনা। পুরাতন জরাজীর্ণ সমাজকে ধ্বংস করে এক নতুন শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছেন তিনি:"তোরা সব জয়ধ্বনি কর! তোরা সব জয়ধ্বনি কর! ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড়। তোরা সব জয়ধ্বনি কর!"

এই কবিতাগুলোতে নজরুল এক ভয়ঙ্কর সুন্দর রূপ ধারণ করেন, যেখানে ধ্বংসাত্মক শক্তিগুলো নতুন সমাজ গঠনের উপায় হয়ে দাঁড়ায়। "কালভয়ঙ্করের বেশে এবার ঐ আসে সুন্দর!" — এই পঙক্তিগুলো তাঁর বিশ্বাসকে প্রকাশ করে যে, বিনাশের মধ্য দিয়েই সৃষ্টি সম্ভব।

'কান্ডারী হুঁশিয়ার' কবিতায় তিনি জাতির কাণ্ডারিদের (নেতাদের) সতর্ক করে দিয়েছেন, স্বদেশকে পরাধীনতার অন্ধকার থেকে মুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন: "দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে যাত্রীরা হুশিয়ার! ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান, আসি’ অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কি প্রাণ?"

পারভীন আক্তার জেমী তাঁর 'নজরুল সাহিত্যে বিপ্লবী চেতনা' গ্রন্থে আলোচনা করেছেন কীভাবে নজরুল তাঁর কবিতায় বিপ্লবের বহুমাত্রিক চিত্র তুলে ধরেছেন, যা কেবল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী নয়, বরং সকল প্রকার শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক সামগ্রিক জাগরণের আহ্বান। (জেমী, পারভীন আক্তার, 'নজরুল সাহিত্যে বিপ্লবী চেতনা')।

নজরুল কেবল কবিতা নয়, তাঁর প্রবন্ধ ও চিঠিপত্রেও দ্রোহের আগুন ছড়িয়ে দিয়েছেন। ১৯২৩ সালে 'ধূমকেতু' পত্রিকায় প্রকাশিত 'রাজবন্দীর জবানবন্দী'তে তিনি ব্রিটিশ আদালতের সামনে দাঁড়িয়ে যে নির্ভীক বক্তব্য দিয়েছিলেন, তা ছিল এক চরম দ্রোহের দলিল। সেখানে তিনি নিজেকে একজন কবি ও সত্যদ্রষ্টা হিসেবে উপস্থাপন করে ব্রিটিশ বিচার ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন।

নজরুলের দ্রোহ শুধুমাত্র রাজনৈতিক পরাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল না, বরং তা ছিল সমাজের গভীরে প্রোথিত অমানবিক বৈষম্য, কুসংস্কার ও ধর্মের নামে ভণ্ডামির বিরুদ্ধে। তিনি তথাকথিত উচ্চশ্রেণী ও নিম্নশ্রেণীর বিভেদ, জাত-পাতের অচলায়তন এবং নারী ও পুরুষের অসম অবস্থানের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।

'মানুষ' (১৯২২) কবিতাটি তাঁর সামাজিক দ্রোহের এক বলিষ্ঠ উদাহরণ। এই কবিতায় তিনি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের ঊর্ধ্বে মানবিকতাকে স্থান দিয়েছেন: "গাহি সাম্যের গান— মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান। নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি, সব দেশে সব কালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।"

 এই কবিতাটিতে নজরুল জোর দিয়ে বলেছেন যে, মন্দির, মসজিদ, গির্জা বা গোরস্থান – কোনো ধর্মস্থানই মানুষের চেয়ে বড় নয়। ক্ষুধার্ত মানুষকে অবজ্ঞা করে ঈশ্বরের আরাধনা করা তাঁর কাছে অর্থহীন: "হায় রে ভজনালয়, তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়! মানুষেরে তুমি ক্ষুদ্র করিয়া রেখেছ, হে ভণ্ড, তাই তো আমার ব্যথিত প্রাণ কাঁদে, হে মোর আনন্দ!"

 'সাম্যবাদী' (১৯২৫) কবিতায় নজরুল একটি শোষণহীন, বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখেছেন। এখানে তিনি সকল বিভেদকে বিলীন করে সকল মানুষকে এক ছাতার তলায় আসার আহ্বান জানিয়েছেন: "গাহি সাম্যের গান! যেথা মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান। গাহি সাম্যের গান! যেথা এসে এক হয়ে গেছে সকল দেশের সকল মানুষ, সকল জাতি।"

 তিনি জাত-পাতের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল, রাজা-প্রজা, ধনী-গরিব – সকল মানুষের সমান অধিকারের কথা ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন: "নহে আছুত, নহে চণ্ডাল, নহে কাহারে ক্ষুদ্র জ্ঞান।"

 নারী-পুরুষের সম-অধিকারের পক্ষে নজরুল ছিলেন এক অগ্রণী কণ্ঠস্বর। 'নারী' (১৯২২) কবিতায় তিনি নারীর প্রতি সমাজের অন্যায় ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন:
"বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। পৃথিবীতে যত রণ, যত খুন, যত মিথ্যাচার, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।"


তিনি পুরুষের জয়কে নারীর ত্যাগের ফল হিসেবে দেখিয়েছেন এবং নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। নারী ও পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যে সভ্যতা গড়ে উঠেছে, তা তিনি সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করেছেন। এই বিদ্রোহী কণ্ঠস্বর কেবল শোষণমুক্তির নয়, বরং লিঙ্গ-বৈষম্যমুক্ত সমাজেরও ইঙ্গিত দেয়।

 নজরুলের দ্রোহ শুধু তাঁর বক্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা তাঁর ভাষা ও শৈলীতেও এক বিপ্লবী পরিবর্তন এনেছিল। তিনি প্রচলিত রীতির বাইরে গিয়ে এক নতুন ধরনের কাব্যভাষা তৈরি করেন, যা ছিল ওজস্বী, তেজস্বী এবং প্রাণবন্ত। তিনি সংস্কৃতবহুল শব্দাবলীর পাশাপাশি আরবি, ফারসি, উর্দু শব্দ নির্ভয়ে ব্যবহার করেছেন, যা তাঁর কবিতাকে এক অনন্য স্বকীয়তা দান করেছে। 'বিদ্রোহী' কবিতার "মহা-বিদ্রোহী রণক্লান্ত, আমি সেই দিন হব শান্ত," পঙক্তিতে 'রণক্লান্ত' শব্দটি ফারসি প্রভাবের উদাহরণ। তাঁর ভাষা ছিল জনমানুষের কাছাকাছি, যা তাকে গণমুখী কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

 তাঁর ছন্দের ব্যবহার ছিল ব্যতিক্রমী। প্রচলিত মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত, অক্ষরবৃত্তের বাইরে গিয়ে তিনি এক নতুন, দ্রোহী ছন্দ তৈরি করেন, যা পাঠককে এক অন্যরকম গতি ও শক্তি অনুভব করায়। তাঁর কবিতায় ঘনঘন অনুপ্রাসের ব্যবহার, দৃপ্ত শব্দের প্রয়োগ এবং বৈপ্লবিক চিত্রকল্পের সৃষ্টি তাঁর দ্রোহকে আরও তীক্ষ্ণ করে তুলেছে।

 মজিদ মাহমুদ তাঁর 'নজরুল তৃতীয় বিশ্বের মুখপত্র' গ্রন্থে দেখিয়েছেন কীভাবে নজরুল তাঁর দ্রোহী লেখনীর মাধ্যমে কেবল ভারতবর্ষের নয়, বরং বিশ্বের অন্যান্য অনুন্নত ও শোষিত জাতিগোষ্ঠীর মুখপত্রে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁর সাম্যবাদী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা তাকে আন্তর্জাতিক পরিসরেও এক বিপ্লবী কবির মর্যাদা এনে দিয়েছে। (মাহমুদ, মজিদ, 'নজরুল তৃতীয় বিশ্বের মুখপত্র')।

 নজরুলের দ্রোহের প্রখরতার পাশাপাশি তাঁর কাব্যে প্রেমের এক স্নিগ্ধ ও গভীর ধারাও প্রবাহিত হয়েছে। এই প্রেম ছিল বহুমুখী—রোম্যান্টিক প্রেম, ঐশ্বরিক প্রেম, মানবিক প্রেম এবং প্রকৃতিপ্রেম। নজরুলের প্রেম নিছকই পার্থিব কামনা বাসনা দ্বারা সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা ছিল এক উদার ও আত্মিক ভালোবাসার প্রকাশ, যা তাঁর দ্রোহী সত্তার পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছে।

 নজরুলের রোম্যান্টিক গান ও কবিতা বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। তিনি প্রেমকে এক বিচিত্র রূপে প্রকাশ করেছেন, যেখানে আবেগ, আকাঙ্ক্ষা, বিরহ এবং অতৃপ্তি একাকার হয়ে গেছে। তাঁর প্রেম ছিল সাহসী, অকুণ্ঠ এবং কখনও কখনও প্রচলিত সামাজিক ধারণার প্রতি চ্যালেঞ্জস্বরূপ। তাঁর অসংখ্য গানে রোম্যান্টিক প্রেমের তীব্রতা ও গভীরতা প্রকাশ পেয়েছে। যেমন: "মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী, দেব খোঁপায় তারার ফুল। কানে দোলাব তৃতীয়া তিথির চৈতী চাঁদের দুল।"

 এই গানে প্রিয়তমাকে কল্পনার রাজ্যে নিয়ে গিয়ে প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ উপাদানে সাজানোর এক অপূর্ব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। এখানে প্রেমিকের আকুলতা ও প্রিয়তমার প্রতি গভীর মুগ্ধতা প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর প্রেম ছিল যেমন গভীর, তেমনই স্বপ্নিল।

 তবে নজরুলের প্রেমে শুধু আনন্দই ছিল না, ছিল বিরহের তীব্র বেদনাও। অপ্রাপ্তির সুর তাঁর অনেক গানেই প্রতিধ্বনিত হয়েছে, যা তাঁর রোম্যান্টিক কাব্যকে এক বিশেষ গভীরতা দান করেছে। 'বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে' গানটি সেই বিরহ ও অপ্রাপ্তির এক চমৎকার উদাহরণ: "বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে, ঝরা বন গোলাপের বিলাপ শুনে।"

 এই গানে বসন্তের আগমন, ফুলের প্রস্ফুটন, পাখির গান – সব কিছুর মধ্যে এক বিষাদের সুর বেজে ওঠে, কারণ সেখানে প্রিয়তমার উপস্থিতি নেই। বিরহ এখানে প্রেমকে আরও তীব্র করে তোলে। আরেকটি গানে তিনি বলেন: "চেয়ো না শুনিতে আমার সে গান, যে গানে আমার ব্যথা লুকানো।"

 এটি যেন সেই প্রেমিকের আত্মনবেদন, যে জানে তার গান অপরের মনে আনন্দ দিতে পারে, কিন্তু সে গানের গভীরে লুকিয়ে থাকে তার নিজেরই অপূর্ণতা ও দুঃখ। এই অপ্রাপ্তি বা বিরহ নজরুলের প্রেমকে আরও মানবিক ও স্পর্শকাতর করে তুলেছে।

 নজরুলের রোম্যান্টিক প্রেমে এক ধরনের বিদ্রোহও লক্ষ্য করা যায়। তাঁর সময়ে বাঙালি সমাজে নারী-পুরুষের সম্পর্ক ও প্রেমের প্রকাশ ছিল অনেকটাই রক্ষণশীলতার মোড়কে ঢাকা। কিন্তু নজরুল সেই ঘেরাটোপ ভেঙে প্রেমের এক স্বাধীন ও উদাত্ত প্রকাশ ঘটিয়েছেন, যা ছিল তৎকালীন সমাজে এক সাহসী পদক্ষেপ। তাঁর গানগুলো প্রেমিকের আত্মনিবেদনের এক নতুন ভাষা তৈরি করেছে।

নজরুলের প্রেম শুধু ব্যক্তিগত বা পার্থিব সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, তা এক গভীর আধ্যাত্মিক স্তরেও বিস্তৃত হয়েছিল। তিনি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল সৃষ্টির প্রতি এবং সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার প্রতি এক অসীম ভালোবাসা অনুভব করতেন। এই আধ্যাত্মিক প্রেম তাঁর ধর্মীয় গানগুলিতে বিশেষভাবে প্রকাশিত। তিনি একদিকে যেমন ইসলামি হামদ, নাত ও গজল রচনা করেছেন, তেমনই অন্যদিকে প্রচুর শ্যামাসঙ্গীত ও ভজনও লিখেছেন।

 নজরুলের হামদ ও নাতগুলো স্রষ্টা ও হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি তাঁর গভীর ভক্তি ও ভালোবাসার নিদর্শন। তাঁর গজলগুলো বাংলা সঙ্গীতে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করেছে। উদাহরণস্বরূপ:
"আল্লাহ আমার প্রভু, আমার নাহি নাহি ভয়। আমার পথে নাহি কণ্টক, আছে শুধু ফুলময়।"

 এই হামদে স্রষ্টার প্রতি এক শিশুর সারল্যের মতো বিশ্বাস ও নির্ভীক আত্মনিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। তেমনি, হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি তাঁর ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে:"ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ, এলো রে দুনিয়ায়। আয় রে সাগর, আকাশ, বাতাস, দেখবি যদি আয়।"

 রমজানের ঈদকে ঘিরে তাঁর কালজয়ী গান: "ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ। তুই আপনারে আজ বিলিয়ে দে, দেখ তোর খোদার দীদ।"

 এই গানগুলো কেবল ধর্মীয় নয়, বরং মানবিক প্রেম ও মিলনেরও প্রতীক, যেখানে তিনি সমাজের সবাইকে এক আনন্দের ভাগীদার হতে আহ্বান জানিয়েছেন।
ইসলাম ধর্মাবলম্বী হয়েও নজরুল যে অগাধ নিষ্ঠা ও ভক্তিভরে শ্যামাসঙ্গীত ও ভজন রচনা করেছেন, তা তাঁর সর্বজনীন প্রেম ও আধ্যাত্মিকতার এক বিরল দৃষ্টান্ত। যেমন: "আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন। মায়ের রূপের ঝলক লেগে ওরে মোর ত্রিভুবন।"

 এই শ্যামাসঙ্গীতে তিনি দেবী কালীর প্রতি তাঁর গভীর ভক্তি প্রকাশ করেছেন। তেমনি, শিবের প্রতি তাঁর আকুলতা প্রকাশ পেয়েছে এমন গানে: "মহাশ্মশানের মাঝে তুমি বসে আছ মহাযোগী, ওগো ডমরু বাজাও, ডমরু বাজাও, ওগো মহাযোগী।"

 এই ধরনের সৃষ্টি তাঁর ধর্ম-নিরপেক্ষ এবং সর্বজনীন প্রেমবোধের এক উজ্জ্বল স্বাক্ষর। গোপালচন্দ্র রায় তাঁর 'রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল' গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের সর্বজনীনতার সাথে নজরুলের এই সর্বধর্ম সমন্বয়ের ধারণার তুলনামূলক আলোচনা করেছেন, যেখানে নজরুল তাঁর নিজস্ব ঢঙে প্রেম এবং আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে ধর্মীয় বিভেদ ঘুচিয়েছেন। (রায়, গোপালচন্দ্র, 'রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল')।


নজরুলের এই উদার প্রেমবোধ শুধুমাত্র ধর্মীয় অঙ্গনে নয়, বরং সমগ্র মানবজাতি এবং প্রকৃতির প্রতিও বিস্তৃত ছিল। 'মানুষ' ও 'সাম্যবাদী' কবিতায় তাঁর যে মানবিক প্রেম প্রকাশ পেয়েছে, তা দ্রোহেরই অন্য পিঠ। তিনি মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকেই সমাজের বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। তাঁর বিদ্রোহ ছিল এক ভালোবাসা থেকে উৎসারিত, যেখানে তিনি মানুষের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর ছিলেন।

 প্রকৃতির প্রতিও নজরুলের এক গভীর টান ছিল। তাঁর গানে ও কবিতায় প্রকৃতি এক জীবন্ত সত্তা হয়ে আবির্ভূত হয়েছে। চাঁদ, তারা, ফুল, পাখি, নদী, পাহাড় – সবকিছুই তাঁর প্রেমে এক ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। যেমন: "শুকনো পাতার নূপুর পায়ে নাচিছে ঘুর্ণি বায়। জল তরঙ্গ গেয়ে যায় গান বিজন নদীর কায়।"

 এই প্রকৃতির প্রতি প্রেম তাঁর সংবেদনশীল ও কোমল মনের পরিচায়ক, যা তাঁর দ্রোহী সত্তার পাশাপাশি তাঁর মানবীয় অনুভূতিগুলোকে আরও বিকশিত ও পূর্ণাঙ্গ করে তোলে।
নজরুলের সাহিত্যকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দ্রোহ এবং প্রেম দুটি পৃথক ধারা হলেও তারা কখনোই বিচ্ছিন্ন থাকেনি; বরং একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছে। তাঁর দ্রোহের মূলে ছিল গভীর এক প্রেমবোধ, আর তাঁর প্রেম অনেক সময় দ্রোহের শক্তি সঞ্চার করেছে। এই দুইয়ের অপূর্ব সংমিশ্রণই নজরুলকে এক অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে।

 গোলাম মুরশিদ তাঁর 'বিদ্রোহী রণক্লান্ত নজরুল-জীবনী'তে নজরুলের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা উল্লেখ করে দেখিয়েছেন, কীভাবে তাঁর মানবিক ভালোবাসা ও সংবেদনশীলতা তাঁকে বিদ্রোহের পথে চালিত করেছে। শোষণ, বঞ্চনা ও পরাধীনতার প্রতি তাঁর তীব্র ঘৃণা জন্ম নিত মানুষের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা থেকেই। (মুরশিদ, গোলাম, 'বিদ্রোহী রণক্লান্ত নজরুল-জীবনী')।


নজরুলের দ্রোহ ছিল নিছকই বিধ্বংসী নয়, বরং তা ছিল ইতিবাচক এবং সৃজনশীল। এই দ্রোহের মূল উৎস ছিল মানুষ ও মানবতাবাদের প্রতি তাঁর গভীর প্রেম। যখন তিনি দেখেছেন মানুষ শোষিত হচ্ছে, বঞ্চিত হচ্ছে, অপমানিত হচ্ছে, তখন তাঁর প্রেমিক মন ব্যথিত হয়েছে এবং এই বেদনা থেকেই জন্ম নিয়েছে বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ।

 'কান্ডারী হুঁশিয়ার' কবিতায় তিনি জাতির কাণ্ডারিদের সতর্ক করেছেন এই মর্মে যে, অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। এই 'প্রাণ'গুলির প্রতি গভীর প্রেম ও শ্রদ্ধাবোধই তাঁকে জাতিকে রক্ষা করার জন্য সতর্কবাণী উচ্চারণ করতে বাধ্য করেছে। এই প্রেম না থাকলে কেবল ক্ষোভ থেকে এমন মহৎ দ্রোহের সৃষ্টি সম্ভব ছিল না।

 'মানুষ' ও 'সাম্যবাদী' কবিতায় তাঁর যে সার্বজনীন মানবপ্রেম প্রকাশ পেয়েছে, তা থেকেই তিনি জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণের বিভেদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। তিনি যখন বলেন, "গাহি সাম্যের গান—মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান," তখন এই পঙক্তিগুলো থেকে তাঁর গভীর মানবিকতার সুর স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই মানবিকতাই তাঁকে সকল মানুষের সমান অধিকার ও মর্যাদার জন্য লড়তে উদ্বুদ্ধ করেছে।

 অনেক সময় নজরুলের দ্রোহী কবিতা ও গানগুলোও এক ধরনের গভীর প্রেমের প্রকাশ ঘটায়। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাঁর 'বিদ্রোহী' বা 'প্রলয়োল্লাস' কবিতায় দেখা যায়, তা আসলে স্বদেশের প্রতি, স্বজাতির প্রতি এক গভীর ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ। তিনি দেশকে ভালোবাসতেন, তাই তিনি দেশের পরাধীনতা মেনে নিতে পারেননি এবং তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিলেন কলমের মাধ্যমে।

 যখন তিনি সমাজের কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লেখেন, তখন তার মূলে থাকে সুস্থ, সুন্দর এক সমাজ গড়ার স্বপ্ন—যে সমাজে সবাই সাম্য ও মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ থাকবে। এটিও এক ধরনের ভালোবাসারই প্রকাশ, যা এক উন্নত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে। যেমন, নারীদের প্রতি সম্মান ও সম-অধিকারের যে দাবি তিনি জানিয়েছেন, তা নারীজাতির প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসারই প্রতিফলন।

 নজরুলের ভাষা ও ছন্দ ব্যবহারের মধ্যেও দ্রোহ ও প্রেমের এই সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। তাঁর গানে যেমন কোমল, স্নিগ্ধ ও সুরময় শব্দাবলী ব্যবহার হয়েছে, তেমনই তাঁর দ্রোহী কবিতায় ব্যবহার হয়েছে রুদ্র, তেজস্বী ও ওজস্বী শব্দ। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, একটি গানেও প্রেম ও দ্রোহের সুর একীভূত হয়ে আছে।

 প্রান্তোষ চট্টোপাধ্যায় তাঁর 'কাজী নজরুল' গ্রন্থে নজরুলের এই দ্বিমুখী প্রতিভার প্রশংসা করে বলেছেন, "নজরুল তাঁর কবিতায় একাধারে যেমন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়েছেন, তেমনই প্রেমিকের হৃদয়ের কোমলতম অনুভূতিগুলোকেও অপূর্ব দক্ষতায় মূর্ত করে তুলেছেন। তাঁর দ্রোহ আর প্রেম যেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।" (চট্টোপাধ্যায়, প্রান্তোষ, 'কাজী নজরুল')।

 কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের এক চিরভাস্বর জ্যোতিষ্ক, যার জীবনে ও সাহিত্যে দ্রোহ ও প্রেম এক অবিচ্ছেদ্য সত্তা হিসেবে বিদ্যমান। তাঁর 'বিদ্রোহী' কবিতা যেমন পরাধীন জাতির হৃদয়ে স্বাধীনতার আগুন জ্বেলেছিল, তেমনই তাঁর প্রেম ও ভক্তিমূলক গান শত সহস্র হৃদয়কে করেছে বিমোহিত। তিনি একইসাথে শৃঙ্খল ভাঙার কবি এবং ভালোবাসার পূজারী।

 নজরুলের দ্রোহ ছিল সর্বব্যাপী – ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে এবং মানবতাবিরোধী সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে। এই দ্রোহের মূলে ছিল মানুষের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং এক সুন্দর, শোষণহীন পৃথিবীর স্বপ্ন। তিনি শুধু ধ্বংসের কথা বলেননি, বরং ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে নতুন সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখেছেন।

 অন্যদিকে, তাঁর প্রেম ছিল বহুমুখী – রোম্যান্টিক প্রেম, ঐশ্বরিক প্রেম, এবং মানবিক প্রেম। তিনি পার্থিব ভালোবাসার সৌন্দর্যে যেমন মুগ্ধ হয়েছেন, তেমনই সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার প্রতি সকল ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে গভীর ভক্তি নিবেদন করেছেন। নারী-পুরুষের সমতা থেকে শুরু করে প্রকৃতির প্রতি তাঁর ভালোবাসা – সবই তাঁর উদার ও সংবেদনশীল হৃদয়ের পরিচয় বহন করে।


নজরুলের সাহিত্য এই বার্তা দেয় যে, দ্রোহ ও প্রেম পরষ্পরবিরোধী নয়, বরং একে অপরের পরিপূরক। তাঁর দ্রোহ এক গভীর প্রেম থেকে উৎসারিত, আর তাঁর প্রেম প্রায়শই বিদ্রোহের পথ খুলে দেয়। এই দুই মহাসমুদ্রের মিলন ঘটিয়ে নজরুল বাংলা সাহিত্যকে এক নতুন পথ দেখিয়েছেন, যা তাঁকে কালজয়ী ও চিরস্মরণীয় করে রেখেছে। তাঁর সহজ-সরল অথচ হৃদয়গ্রাহী ভাষা এবং সঙ্গীতের প্রতি অগাধ জ্ঞান তাঁর সাহিত্যকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে এবং তাঁকে 'গণমানুষের কবি' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

 আজও নজরুল তাঁর দ্রোহ ও প্রেম নিয়ে আমাদের মাঝে সমান প্রাসঙ্গিক। তাঁর সাম্য ও মৈত্রীর বাণী, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান, এবং ভালোবাসার মাহাত্ম্য আধুনিক সমাজেও দিকনির্দেশনা প্রদান করে। দ্রোহ ও প্রেমের এই অনবদ্য মিশ্রণেই কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের 'বিদ্রোহী কবি' এবং 'প্রেমের কবি' হিসেবে চিরকাল বেঁচে থাকবেন।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।

১৬৩ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
সাহিত্য নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন