সর্বশেষ

মতামত

তৃণমূল ও জাতীয় গণমাধ্যমে নয়া দিগন্তের ছোঁয়া এবং প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা

স্বাধীন চৌধুরী
স্বাধীন চৌধুরী

বৃহস্পতিবার , ১৬ অক্টোবর, ২০২৫ ২:৫৪ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
বাংলাদেশের সাংবাদিকতা এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে- একদিকে মাঠে কাজ করা তৃণমূল সংবাদকর্মীরা, অন্যদিকে ঢাকাকেন্দ্রিক জাতীয় গণমাধ্যম।

তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় প্রসার, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তীর্থ এবং শক্তির কেন্দ্রায়নের ফলে আমাদের মিডিয়া পরিমণ্ডল একদিকে বিশাল সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে; অন্যদিকে জটিল চ্যালেঞ্জও বাড়িয়েছে। এই নিবন্ধে তৃণমূল সাংবাদিকতার বাস্তবতা, জাতীয় গণমাধ্যমের ভূমিকা, প্রযুক্তির সুযোগ-ঝুঁকি এবং পথনির্দেশক নীতি ও প্রস্তাব তুলে ধরছি- দেশের গণমাধ্যমকে সত্য, স্বচ্ছতা ও মানবিকতার ভিত্তিতে গড়া প্রয়োজন।

১। তথ্যপ্রযুক্তির বাস্তব চিত্রঃ দ্রুত প্রসার ও সংখ্যাগত যথার্থতা:
গত দুই বছরে দেশের ডিজিটাল প্রবেশমাত্রা নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৭৭.৭ মিলিয়ন, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৪.৫%। এই পরিসংখ্যান ডিজিটাল ব্যবহার ও অনলাইন আচরণের বিস্তৃত চিত্র তুলে ধরে।

 

তদুপরি, বাসাবাড়ি পর্যায়ে ইন্টারনেট-সংযোগও দ্রুত বাড়ছে- BBS-এর সাম্প্রতিক সার্ভে-তে দেখা যায়, জেলায়-জেলায়, শহর-গ্রামের বাড়িতে ইন্টারনেট থাকা এখন কোনো ব্যতিক্রম নয়; অনেক তাজা রিপোর্টে হাউসহোল্ড লেভেলে ইন্টারনেট ব্যবহার প্রায় অর্ধেকের ওপরে উঠে এসেছে। এই বাস্তবতা স্থানীয় নিউজ কভারেজকে দ্রুত জাতীয় পাঠকের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ করে দিয়েছে।
এই সংখ্যাগুলি সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের সামগ্রিক রূপান্তরের বীজ- তথ্য এখন দ্রুত প্রকাশ পায় এবং ছড়িয়ে পড়ে; পাঠক-দর্শক সরাসরি অংশগ্রহণ করে খবরের আলোচনায়। তবে একই সঙ্গে গুজব, ভুল তথ্য ও ইকো-চেম্বারের জন্মও বেড়েছে, যা সহজ সরল সংবাদচর্চাকে জটিল করেছে।

২। তৃণমূল সাংবাদিকতাঃ অব্যক্ত কষ্ট, অপরিসীম গুরুত্ব:

তৃণমূল সাংবাদিকতায় আমরা বুঝি, সেইসব সাংবাদিককে যাঁরা জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যন্ত মাঠে বসে খবর সংগ্রহ করেন- দুর্যোগের রাত, স্থানীয় দুর্নীতি, কৃষকের শাষণ কিংবা গ্রামীণ জনজীবনের ক্ষতচিহ্ন তুলে আনেন। তাদের কাহিনী অনেক সময়ই জাতীয় মিডিয়ার শিরোনাম হয়ে ওঠে- অনেক কষ্টের ফলশ্রুতিতে সমাজের দুর্বলতাগুলো খবর হয়ে প্রকাশ পায়।
তবে সাংবাদিকের জীবন বাস্তবতা কঠিন। অনেকে ঠিকঠাক বেতন পান না; বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সম্মানী, বিজ্ঞাপন-ভিত্তিক আয়ের উৎসে তাদের নির্ভর করতে হয়; নিরাপত্তা-প্রশিক্ষণের অভাব, আইনি সুরক্ষার ঘাটতি- সব মিলিয়ে সাংবাদিকতার মান ও স্বাধীনতা ঝুঁকির মুখে পড়ে। এগুলো হচ্ছে ন্যূনতম কর্মপরিবেশগত চাহিদা, যা পূরণ না হওয়ার কারণে আমাদের গণমাধ্যম কাঠামো দুর্বলতার মধ্যে রয়েছে।
স্থানীয় সাংবাদিকদের জন্য পেশাগত প্রশিক্ষণ, ডিজিটাল নিরাপত্তা ও অনুসন্ধানী টুলসের প্রশিক্ষণ অত্যাবশ্যক- কারণ স্থানীয় বিশেষ খবর কখনো কখনো রাষ্ট্রীয় নীতি বদলে দিতে পারে।

৩। ঢাকাকেন্দ্রিক জাতীয় গণমাধ্যমঃ শক্তি, কর্তৃত্ব ও ফাঁক:

ঢাকার বড় নিউজ হাউসগুলোতে পেশাদার স্টাফ, প্রযুক্তি ও বিশ্লেষণের শক্ত সাপোর্ট রয়েছে। জাতীয় রাজনীতি, অর্থনীতি বা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ব্যাপক বিশ্লেষণ এখানে তৈরি হয়- যা নীতিনির্ধারণে প্রভাব ফেলে। একই সময়, তাদের সামর্থ্য আর দৃষ্টিভঙ্গি দেশব্যাপী সমস্যা চিহ্নিত করতে সক্ষম হলেও, কেন্দ্রীয় কেন্দ্রিকতার জন্যে প্রান্তীয় কণ্ঠস্বর প্রায়ই উপেক্ষিত থাকে।
ঢাকা-কেন্দ্রিক সংবাদ কাঠামোতে জেলা-উপজেলার কাহিনী দ্রুত স্থান পায় না, অথবা আসে টুকরো-টুকরোভাবে- ফলে জাতীয় চিত্রে 'দূরত্ব' তৈরি হয়; নাগরিক জীবনের গভীর বাস্তবতা পুরোপুরি প্রতিফলিত হয় না। জাতীয় মিডিয়ার বিকেন্দ্রীকরণ এখানে অতি প্রয়োজনীয়। আঞ্চলিক ডেস্ক, স্থায়ী প্রতিনিধি ও স্থানীয় অনুসন্ধানী টিম বাড়ালে জাতীয় চিত্র সমৃদ্ধ হবে।

৪। নিরাপত্তা, আইন ও স্বাধীনতাঃ বিধান ও উদ্বেগ:

বিগত কিছু সময়কাল সংবাদকর্মীদের সুরক্ষা ও কাজের স্বাধীনতা নিয়ে সরকারি ঘোষণা ও খসড়া আইনগত পদক্ষেপ লক্ষ্য করা গেছে- সাংবাদিক সুরক্ষা সংক্রান্ত খসড়া বিধান নিয়ে আলোচনা তীব্র হচ্ছে। একই সময়ে সাংবাদিকদের অ্যাক্রেডিটেশন বাতিল, হয়রানি বা মামলার খবরও এসেছে, যা স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপর ছায়া ফেলেছে। এই দুই ধারাকেই একসঙ্গে বোঝার মধ্য দিয়ে সুষম নীতি গঠন জরুরি।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ ও স্থানীয় সাংবাদিক সংগঠনগুলোও অনলাইন ও অফলাইনে হয়রানির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে- সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তব প্রয়োজনেই সুনির্দিষ্ট, কার্যকর ও ন্যায়সঙ্গত কার্যবিধি জরুরী।

৫। প্রযুক্তিঃ শক্তি নাকি ঝুঁকি? (স্টারলিংক ও বিকল্প সংযোগ):

ডিজিটাল প্রেক্ষাপটে দ্রুততর ও স্থিতিশীল ইন্টারনেটের চাহিদা বেড়েছে- সাম্প্রতিক কালে স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা বিশ্বব্যাপী প্রসার পেতে শুরু করেছে, যা অস্থায়ী নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্নতা মোকাবেলায় সহায়ক। তবে প্রযুক্তিই যথেষ্ট হবে না- এটি সাংবাদিকতার পেশাগত মান, ফ্যাক্ট-চেকিং রুটিন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তার সঙ্গে মিলিয়ে ব্যবহার করতে হবে।

৬। গুজব ও মিথ্যাচারের মোকাবিলাঃ ফ্যাক্ট-চেকিং ও ডেটা সাংবাদিকতা:

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে দ্রুত ছড়ানো ভুল তথ্য মোকাবিলায় মিডিয়ার অভ্যন্তরীণ ফ্যাক্ট-চেক ইউনিট, স্বাধীন ফ্যাক্ট-চেকিং সংগঠন এবং ডেটা-জার্নালিজমকে শক্তিশালী করতে হবে। একই সাথে পাঠক-প্রশিক্ষণও জরুরি। ডিজিটাল সাক্ষরতা বাড়ালে গুজবের দৌরাত্ম কমানো যাবে। জাতীয় মিডিয়া, সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম ও নাগরিক সংগঠন একসাথে কাজ করলে তথ্যবাহিত ব্যবস্থাকে দায়িত্বশীল করা সম্ভব।

৭। সাজেশনঃ চারটি তাৎপর্যপূর্ণ উদ্যোগ (তালিকাভিত্তিক প্রয়োগযোগ্য পথ):

(ক). তৃণমূল সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সুরক্ষা: জেলা-উপজেলা পর্যায়ে নিয়মিত কর্মশালা- অনুসন্ধানী পদ্ধতি, ডেটা-জার্নালিজম, ডিজিটাল নিরাপত্তা ও নৈতিক সাংবাদিকতা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। সাংবাদিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি ও পেনশন-সুবিধা নিশ্চিত করতে বেসরকারি-সরকারি পর্যায়ে মিলেমিশে স্কিম চালু করা।

(খ). জাতীয় মিডিয়ার বিকেন্দ্রীকরণ: প্রতিটি বিভাগের জন্য আঞ্চলিক ডেস্ক প্রতিষ্ঠা, স্থানীয় প্রতিনিধি-নেটওয়ার্ক ও স্থানীয় সাংবাদিকতাকে অনুদান/গ্রান্ট দিয়ে উৎসাহিত করা। বড় সংবাদমাধ্যমগুলোর সঙ্গে স্থানীয় কন্টেন্ট-শেয়ারিং মেকানিজম গড়ে তোলা।

(গ). আইনগত সুরক্ষা ও নৈতিক কাঠামো: সাংবাদিক সুরক্ষা আইনের দ্রুত বাস্তবায়ন- যেখানে হয়রানি, শারীরিক আক্রমণ ও অবৈধ কারচুপির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা রাখতে হবে; একযোগে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বা প্রশাসনিকভাবে ব্যবহৃত আইনগত ব্যবস্থার অপব্যবহার রোধের জন্য গ্যারান্টি রাখতে হবে।

(ঘ). টেকনোলজি ও ফ্যাক্ট-চেকিং প্ল্যাটফর্ম: মিডিয়া-হাউস এবং স্বাধীন ফ্যাক্ট-চেক সংস্থাগুলোকে টেকনিক্যাল ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা; ডেটা-রিচ রিপোর্ট তৈরি ও ওপেন-ডেটা পলিসি বাস্তবায়ন করে সংবাদকে আরও নির্ভুল ও যাচাইযোগ্য করা।

উপসংহারঃ নতুন দিগন্তে আমাদের পথচলা

বাংলাদেশের সাংবাদিকতা এখন আর শুধুই পেশা নয়- এটি একটি রাজনৈতিক-সামাজিক দায়বদ্ধতা। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সেতুবন্ধন গড়ে তুলতে পারলে আমাদের গণতন্ত্র শক্ত হবে। তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের হাতে যে সম্ভাবনা তুলে দিয়েছে তা ব্যবহার করে আমরা দেশব্যাপী সততা, স্বচ্ছতা ও মানবিকতার ভিত্তিতে সংবাদ পরিবেশন প্রতিষ্ঠা করতে পারি- কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন প্রস্তুতি, প্রশিক্ষণ, আইনগত সুরক্ষা ও নৈতিক পুনর্গঠন।
এই পথ কঠিন, আবার যথাযথ মর্যাদারও। যদি আমরা একযোগে কাজ করি- স্থানীয় সাংবাদিককে দায়িত্বশীলতার মাধ্যমে কাজ করার জন্য যথেষ্ট সুযোগ ও ক্ষমতা দিই এবং জাতীয় মিডিয়াকে দায়িত্বশীল করি, প্রযুক্তিকে সত্য-প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তুলি- তবে সাংবাদিকতার নতুন দিগন্ত অবধারিত উন্মোচিত হবে। বাংলাদেশের গণমাধ্যম তখনই শক্তিশালী হবে যখন তৃণমূল পর্যায়ের খবর প্রকাশের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা যাবে এবং

যখন সংবাদ-ন্যায্যতার যথার্থ আলো তৃণমূলে আলো ছড়িয়ে পড়বে।

তথ্যসূত্রঃ
(১). ইউনেস্কো ও ইউএনডিপি-এর যৌথ প্রতিবেদন
২০২৫ সালের ৩ জুলাই, ইউনেস্কো ও ইউএনডিপি বাংলাদেশে একটি মুক্ত, স্বাধীন ও বহুমুখী গণমাধ্যম গঠনের লক্ষ্যে একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও নৈতিকতা রক্ষার জন্য জরুরি সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছে।
(২). বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের বক্তব্য: ২০২৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি এ কে এম আব্দুল হাকিম সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, অনেক সাংবাদিক চাকরির নিরাপত্তা ছাড়াই কাজ করছেন, যা সাংবাদিকতার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বাধা সৃষ্টি করছে।
(৩). মিডিয়া রিফর্ম কমিশনের সুপারিশ:
২০২৫ সালের ২২ মার্চ, মিডিয়া রিফর্ম কমিশন বড় ও মাঝারি আকারের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করার সুপারিশ করেছে। এর মাধ্যমে গণমাধ্যমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
(৪). স্থানীয় গণমাধ্যমের শক্তি ও চ্যালেঞ্জ:
২০২৪ সালের ২৭ মে, এশিয়া ফাউন্ডেশন একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে, স্থানীয় সাংবাদিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও স্থানীয় গণমাধ্যমের শক্তিশালীকরণে আরও বিনিয়োগ প্রয়োজন। এটি গণতান্ত্রিক সংস্কার ও জনসেবা উন্নয়নে সহায়ক হবে।
(৫). বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ
২০২৫ সালের ২ জুন, ইউনেস্কো একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে, সাংবাদিকদের ক্ষমতায়ন, সুরক্ষা ও স্বাধীন মতপ্রকাশ নিশ্চিত না হলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হবে। এটি গণতন্ত্রের জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।


লেখকঃ কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

১৩৭ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন