সর্বশেষ

জাতীয়

কুমিল্লা নাকি নোয়াখালী: বিভাগ ঘোষণার দাবিকে ঘিরে দুই জেলার মধ্যে উত্তেজনা

মনজুর এহসান চৌধুরী
মনজুর এহসান চৌধুরী

রবিবার, ১২ অক্টোবর, ২০২৫ ১১:৪৪ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
বাংলাদেশের প্রশাসনিক পুনর্গঠন নিয়ে আলোচনায় বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত দুটি নাম—কুমিল্লা ও নোয়াখালী। উভয় জেলার মানুষই দীর্ঘদিন ধরে আলাদা বিভাগ গঠনের দাবি জানিয়ে আসছে।

একদিকে কুমিল্লা তার অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক গুরুত্বের যুক্তি তুলে ধরছে, অন্যদিকে নোয়াখালী তার ঐতিহাসিক, উপকূলীয় ও জনমিতিক বাস্তবতার ভিত্তিতে নিজস্ব দাবিকে জোরদার করছে।

ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট
ঐতিহাসিকভাবে কুমিল্লা অঞ্চল ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের এক অংশ এবং পরে পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক আন্দোলনের অন্যতম জন্মস্থান।

বিপরীতে, নোয়াখালী (প্রাচীন “ভুলুয়া”) সমৃদ্ধ উপকূলীয় জেলা, যা ১৭শ শতকে প্রশাসনিক কাঠামো পেয়েছিল এবং মুক্তিযুদ্ধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিক থেকে কুমিল্লা পরিচিত লালমাই-ময়নামতি, রসমালাই, ও নজরুলের গানের শহর হিসেবে; অন্যদিকে নোয়াখালী বাংলাদেশের উপকূল সংস্কৃতি, পানের বরজ, ও প্রবাসী জীবনের প্রতীক।

অর্থনীতি ও অবকাঠামো
কুমিল্লা শিল্প, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ও বাণিজ্যে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশের প্রধান কেন্দ্র। এখানে একটি Export Processing Zone (EPZ) রয়েছে, যেখানে প্রায় এক লাখ মানুষ কর্মরত। শহরে রিয়েল এস্টেট, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত দ্রুত বিকাশমান।

অন্যদিকে নোয়াখালী মূলত কৃষি ও মৎস্যভিত্তিক অর্থনীতি নির্ভরশীল হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে Noakhali Economic Zone ও চিংড়ি রপ্তানি শিল্প এ জেলার অর্থনীতিকে এগিয়ে নিচ্ছে। রেমিটেন্স প্রবাহেও নোয়াখালী বাংলাদেশে শীর্ষ স্থান দখল করে আছে।

শিক্ষা ও সমাজ
কুমিল্লায় শিক্ষার হার প্রায় ৮৭%, যা জাতীয় গড়ের চেয়ে অনেক বেশি। জেলা শহরে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ভিক্টোরিয়া কলেজ, এবং একাধিক মেডিকেল ইন্সটিটিউট রয়েছে।

কুমিল্লায় শিক্ষার হার প্রায় ৮৭%, যা জাতীয় গড়ের চেয়ে অনেক বেশি। জেলা শহরে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ভিক্টোরিয়া কলেজ, এবং একাধিক মেডিকেল ইন্সটিটিউট রয়েছে।

জনসংখ্যা ও নগর উন্নয়ন
পরিসংখ্যান অনুযায়ী কুমিল্লার জনসংখ্যা প্রায় ৬.৪ মিলিয়ন এবং শহরকেন্দ্র ও উপশহরের উন্নয়ন দ্রুততর হচ্ছে। নোয়াখালীর জনসংখ্যা প্রায় ৩.৩ মিলিয়ন, যার মধ্যে প্রবাসী আয়ের প্রভাব স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।

রাজনৈতিক প্রভাব
রাজনৈতিকভাবে কুমিল্লা প্রভাবশালী জেলা। এটি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলের কেন্দ্রবিন্দু, এবং এখানে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি রয়েছে।

অপরদিকে, নোয়াখালী বিএনপি ও জামায়াত নেতৃত্বের ঘাঁটি, যেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জন্ম জেলা হিসেবে রাজনৈতিক প্রভাব গভীর।

সামাজিক বৈশিষ্ট্য
সামাজিকভাবে কুমিল্লার মানুষকে পরিশ্রমী ও শান্ত ভাবা হয়, এবং নোয়াখালীর মানুষকে উদ্যোক্তা ও কৌশলী (strategic) হিসেবে দেখা হয়। অতিথিপরায়ণতার দিক থেকেও দুটি জেলার মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই, যদিও কুমিল্লা তার ঐতিহ্যবাহী রন্ধন সংস্কৃতির মাধ্যমে পরিচিত।

বর্তমান উত্তেজনা ও বিভাগ দাবি
সম্প্রতি নোয়াখালীতে বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও প্রবাসীদের একাত্মতা নিয়ে বিভাগ দাবির আন্দোলন জোরদার হয়েছে। তারা স্পষ্টভাবে জানিয়েছে—“নোয়াখালীকে কুমিল্লার সাথে না, আলাদা বিভাগ হিসেবে” দেখতে চায়।

অন্যদিকে, সরকারের সংস্কার কমিশন ইতিমধ্যে কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে আলাদা বিভাগ করার সুপারিশ করেছে, যার ফলে উত্তাপ বেড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, নতুন বিভাগটির নাম হবে “ময়নামতি বিভাগ”।

তুলনামূলক বিশ্লেষণ
কুমিল্লা বনাম নোয়াখালী
অর্থনীতি:
• কুমিল্লা: শিল্প, EPZ, রেমিটেন্স, ব্যবসা-বাণিজ্য।
• নোয়াখালী: কৃষি, মৎস্য, চিংড়ি, রেমিটেন্স, মাছ ও পানের বরজ নির্ভর।
শিক্ষার হার:
• কুমিল্লা: আনুমানিক ৮৭% (সর্বশেষ তথ্য)।
• নোয়াখালী: আনুমানিক ৭৫%।
রাজনৈতিক প্রভাব:
• কুমিল্লা: জাতীয় অঙ্গনে দুই শীর্ষ দল, সামরিক ঘাঁটি, সংসদ সদস্য বেশি।
• নোয়াখালী: বিএনপি–জামায়াত ঘাঁটি, আন্দোলনশীল ও ঐতিহাসিক নেতৃত্ব।
সংস্কৃতি ও সামাজিকতা:
• কুমিল্লা: ঐতিহ্যবাহী রান্না, রসমালাই, ময়নামতি, নজরুল চর্চা।
• নোয়াখালী: উপকূলীয় সংস্কৃতি, প্রবাসী যোগাযোগ, পানের বরজ।
জনসংখ্যা:
• কুমিল্লা: অনুমানিক ৬.৪ মিলিয়ন।
• নোয়াখালী: অনুমানিক ৩.৩ মিলিয়ন।
বিভাগ দাবি ও প্রশাসন:
• কুমিল্লা: সরকারি কমিশনের সুপারিশপ্রাপ্ত, দীর্ঘকালীন দাবি।
• নোয়াখালী: দেশ-বিদেশে আন্দোলন প্রবল, উপকূলীয় গুরুত্বপূর্ণ দাবি।

কুমিল্লা শিল্প, প্রশাসন, শিক্ষা ও ইতিহাসে এগিয়ে; নোয়াখালী কৃষি, মৎস্য, প্রবাসী আয় ও আন্দোলনে জোরালো। প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের ঘূর্ণিতে দুই জেলার বিভাগ দাবি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বের উন্নয়নে নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে।

শেষ কথা
কুমিল্লা ও নোয়াখালী—দুই জেলারই ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে। তবে প্রশাসনিক কার্যকারিতা ও প্রস্তুতির ক্ষেত্রে কুমিল্লা বিভাগের ঘোষণা এখন সবচেয়ে সম্ভাবনাময়। অন্যদিকে, নোয়াখালী উপকূলীয় জেলা হিসেবে উন্নয়নের বঞ্চনা ও জনগণের দাবি বাস্তবায়নের সুযোগও রেখে দিয়েছে।
দেশের প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের প্রেক্ষাপটে, কুমিল্লা বিভাগ গঠন বাস্তবসম্মত হলেও, নোয়াখালী বিভাগ জনগণের ন্যায্য স্বপ্ন—দুটির সমন্বয়ে সরকারের উচিত দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের উন্নয়নকৌশল প্রণয়ন করা।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট।

১১২ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
জাতীয় নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন