নতুন লোগো ও উদারতাবাদী অভিযাত্রায় জামায়াতে ইসলামী: কট্টরতা থেকে রূপান্তর

সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ৬:৩১ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক আদর্শ ও পরিচয়ে বড় ধরনের পরিবর্তনের পথে হাঁটছে। দলের কট্টর ইসলামি ভাবমূর্তি থেকে উদার গণতান্ত্রিক বিশ্বাসের দিকে অগ্রসর হওয়ার এই রূপান্তর হচ্ছে নতুন লোগো ও দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে।
নতুন লোগো: প্রথম প্রকাশ
জামায়াতে ইসলামীর নতুন লোগোটি প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে আসে ২০২৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার বসুন্ধরায় জামায়াত আমিরের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে। এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন স্পেনের রাষ্ট্রদূত, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মিশনের প্রতিনিধিদল সহ কয়েকজন কূটনীতিক। বৈঠকের সময় দলের নেতা-মণ্ডলির পেছনের দেওয়ালে নতুন লোগোর নকশাটি দৃশ্যমান হয় এবং তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থিত সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও দেশের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। প্রস্তাবিত লোগোতে শুধু ইসলামি ধর্মীয় প্রতীক বাদ দেওয়া হয়নি, পরিবর্তে এসেছে বাংলাদেশের পতাকার ছাপ, বই, সূর্য, কলম ও দাঁড়িপাল্লার দণ্ড। এটি দলীয় ‘কট্টর ইসলামি’ ধারণা থেকে ধীরে ধীরে উদার ও আধুনিক ভাবমূর্তির দিকে অগ্রসরতার বার্তা বহন করছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত।
নতুন নকশার বিশ্লেষণ
এই নতুন লোগোতে ‘আল্লাহ’ লেখা আরবী, কোরআনের আয়াত এবং ইসলামী প্রতীকের চিহ্ন প্রত্যাহার করা হয়েছে। পরিবর্তে থাকছে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার আদল, বই, সূর্য, এবং কলম (যা দলীয় প্রতীকে দাঁড়িপাল্লার দণ্ডরূপে ব্যবহৃত)। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জামায়াতের এই পরিবর্তন মূলধারার রাজনীতিতে দলটিকে আরও গ্রহণযোগ্য, তরুণ-সমাজনিষ্ঠ ও আধুনিক ভাবমূর্তিতে উপস্থাপন করবে।
আদর্শ ও রাজনীতির পরিবর্তনের আলামত
নতুন লোগোর মধ্য দিয়ে দলটির চিন্তাধারায় বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। ইসলামি আদর্শের সঙ্গে গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়, সংখ্যালঘু ও নারীর অধিকার, যুব সংগঠনের অধিকতর অন্তর্ভুক্তি এসব কিছুর পুনর্নিমাণ ছাপ ফুটে উঠেছে। তরুণ কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে এ পরিবর্তন ইতিবাচক সাড়া ফেলেছে, আর কট্টর পক্ষের মধ্যে আছে কিছুটা উদ্বেগ ও বিতর্ক।
তরুণ প্রজন্ম ও সমর্থকদের প্রতিক্রিয়া
প্রথম ও দ্বিতীয় সারির নেতৃত্বের পাশাপাশি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ কর্মীরাও এই নতুন আদর্শ ও আধুনিক প্রতীকের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করছে। দলটির আধুনিকীকরণ প্রচেষ্টাকে সমর্থন করছে এমন তরুণদের তদারকি বাড়িয়েছে দলীয় প্রশাসন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জামায়াত পরিবর্তিত সমাজ ও রাজনীতির চাহিদাকে সামনে রেখে এগোচ্ছে।
ধর্মীয় রাজনীতি বনাম উদার ধারা
দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত মহল ও সিনিয়র নেতারা আপাতত বলছেন, এটি চূড়ান্ত নয়—এখনো নকশা চূড়ান্তকরণের কাজ চলছে। কট্টর নেতারা ধর্মীয় পরিচয় কমে যেতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, অন্যদিকে উদারতাবাদী অংশ মনে করছে, বাংলাদেশি রাজনীতিতে নতুনভাবে টিকে থাকতে জামায়াতের জন্য এই রূপান্তর জরুরি।
কেন আলোচনায়
লোগো পরিবর্তনের ঘটনাটি নিজেই রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দলের অভ্যন্তরেও এ নিয়ে দ্বিমত আছে; কেউ একে ইতিবাচক উদারতাবাদী রূপান্তর মনে করছেন, কেউ আবার ধর্মীয় ভিত্তি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করছেন। দলীয় সূত্র ও বক্তব্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, জামায়াত এখন “ইসলামিস্ট লেফট” বা উদার ইসলামি গণতন্ত্রের মডেল অনুসরণে মনোযোগী।
তারা সংখ্যালঘু ও নারীর অংশগ্রহণ, যুব রাজনীতি ও সামাজিক ন্যায় বাড়ানোর কথা বলছে, মুসলিম পরিচয়কে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সঙ্গে একীভূত করতে চায়।
আসল কথা
জামায়াতে ইসলামী এখন রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও দর্শনগত মোড় ঘুরিয়ে “কট্টর ধর্মীয়” প্রচলন থেকে আরও উদার, আধুনিক ও গণতান্ত্রিক ভূমিকায় নিজেকে প্রতিস্থাপন করছে। ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫-এ ঢাকায় বসুন্ধরার দলীয় কার্যালয়ে নতুন লোগোর প্রকাশ অনুষ্ঠানে এই রূপান্তরের চিত্র সবচেয়ে বেশি প্রতিভাত হয়েছে—যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশ রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
১৩৭ বার পড়া হয়েছে