বিশ্বজুড়ে বাংলার মানবতাবাদী সাধকের দর্শন-অন্বেষণ

শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ১০:০৪ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ফকির লালন সাঁইয়ের ভাব, দর্শন এবং সংগীত নিয়ে গবেষণা আজ আর কুষ্টিয়া কিংবা ঢাকা বা কলকাতার ছোট পরিসরে সীমাবদ্ধ নেই, বিশ্বের বহু দেশে একাডেমিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে।
পশ্চিমের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় হোক বা এশিয়ার গবেষণা প্রতিষ্ঠান এখন লালনের দর্শন, তাঁর মানবতাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক আদর্শ, বাউল সংগীত ও সাধনা নিয়ে বহু গবেষণা হচ্ছে এবং প্রতিনিয়তই বাড়ছে আন্তর্জাতিক উন্মাদনা। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা, থিসিস, আন্তর্জাতিক কনফারেন্স ও ফিল্ড স্টাডিতে লালন দর্শন, সংগীত ও অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদ।
বিশ্বে যেসব খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে লালন
যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড, শিকাগো, ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটি, ইংল্যান্ডের লাফবরো বিশ্ববিদ্যালয়, জার্মানির হান্স হার্ডার, ফ্রান্সের ক্যারোল সলোমন, জাপানের মাসাহিকো তোগাওয়া, ইতালির ক্যারোলা এরিকা লোরেয়া—এদের গবেষণার বিষয়বস্তুতে রয়েছে লালনের “দেহতত্ত্ব”, “সমাজ সংস্কার ও মানবতাবাদ”, “বাংলা লোকসংস্কৃতির আন্তর্জাতিক প্রভাব” এবং “ভাববাদ”। ফ্রান্স ও জার্মানির গবেষকরা কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়াতে এসেও ফিল্ড স্টাডি করেছেন; কেউ সাধুদের জীবনযাত্রা অনুসন্ধান করতে বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে মিশে গেছেন।
ভারতের শান্তিনিকেতন, কলকাতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং নতুন কুষ্টিয়ার লালন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড আর্টস-এ লালনবিষয়ক এমফিল/পিএইচডি, সেমিনার ও জার্নাল প্রকাশ হচ্ছে নিয়মিত। গবেষণার বিষয়: ধর্ম-বর্ণ গোত্রহীন মানবসমাজ, সমাজে অসাম্প্রদায়িকতা ও মুক্তচিন্তা, দেহতত্ত্ব, লোকায়ত বাংলা চিন্তার আধুনিক প্রসার।
গবেষকরা কি করছেন?
লালন গবেষণা এখন আর শুধু সংগীত কিংবা লোক-দর্শন নয়—সমাজবিজ্ঞান, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, ফোকলোর, মানবতাবাদ, ফিলোসফি ও গ্লোবাল স্টাডিজের গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে। দেশের বাইরে তথা ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে “Lalonism”, “Baul Philosophy”, “Humanistic Traditions of Bengal”—এই টাইটেলে কনফারেন্স, রিসার্চ প্রজেক্ট, জার্নাল ও লাইভ-ফিল্ডওয়ার্ক চলছে।
বিশ্বের আগ্রহ এখন শুধু লালনের গান বা বাউল জীবন নয়, তাঁর “মানব ধর্ম”-এর বহুত্ববাদী দর্শন, জাতপাত-নিরপেক্ষ অবস্থান, মানবপ্রেম, মুক্ত চিন্তা ও বাস্তববাদী জীবনের প্রতি আকর্ষণ। হাজার বছর ধরে যে “সব জাত-গোত্র-ধর্মের ঊর্ধ্বে মানুষের পরিচয়”—এই দর্শন আজকের বৈশ্বিক টানাপোড়েন, অসহিষ্ণুতা ও আধুনিকতা-সংকটে এক অনন্ত আলোর পথ দেখাচ্ছে।
ফকির লালন সাঁই যে ধারণা, অর্থাৎ মানুষ ও মানবধর্মের চেতনা, তা গবেষকদের চোখে এখন “গ্লোবাল হিউম্যানিজম”-এর অন্যতম উদাহরণ। আর তাই দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লালনের ওপর গবেষণা আজ বহুজাতিক, বহুমাত্রিক এবং গতিময়। তাঁর জীবন, দর্শন ও সংগীত বিশ্ববোধ, উদারতা ও মানবিক সংহতির প্রধান প্রতীক হয়ে উঠেছে।
সারসংক্ষেপ
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে লালন সাঁইয়ের ওপর যে বৈচিত্র্যপূর্ণ গবেষণা চলছে, তার মধ্য দিয়ে বাংলা থেকে শুরু করে সমগ্র পৃথিবীর মানবিক, সহনশীল এবং মুক্তচিন্তার অন্বেষার পথ আরও প্রসারিত হয়েছে। একদিকে স্থানীয় আধ্যাত্মিকতা, সমাজচিন্তা ও গান-সংগীতে লালনের অবদান; অন্যদিকে তাঁর দর্শন বিশ্ব সংস্কৃতি ও একাডেমিক পরিমণ্ডলে নবনন্দিত হয়ে উঠছে। বৃহত্তর মানবসমাজে জাতি-ধর্ম পেরিয়ে ‘মানুষ’ পরিচয়ের যে বার্তা লালন রেখে গেছেন—তাঁর গবেষণা ও আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ড সেই বার্তাকে নিরন্তর ছড়িয়ে দিচ্ছে।
লাইব্রেরি, গবেষণা কেন্দ্র, স্নাতক ও পিএইচডি থিসিস—এভাবে লালন শুধু বাংলার গণ্ডিতে নয়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউরোপ, জাপান, ভারত—সবখানেই নতুন আলো, দর্শন এবং গবেষণা-ভাবনার উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছেন। বিশ্বের মানবতা, নৈতিকতা ও সম্প্রীতির পরিসরে লালন সাঁই নতুন সংযোগ, নতুন চেতনা, আর বহুমাত্রিক অনুপ্রেরণার এক বিজয়রথ হয়ে উঠছেন।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট
১১৬ বার পড়া হয়েছে