সর্বশেষ

মতামত

জটা চুল, দাড়ি কেটে দেয়া নিষ্ঠুর অমানবিকতা

মাসুদুল হাসান রনি
মাসুদুল হাসান রনি

শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ৯:৫৫ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
ক'দিন যাবত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, কয়েকজন ব্যক্তি প্রকাশ্যে একজন পথচারীর চুল ও চুলের জট জোরপূর্বক কেটে দিচ্ছেন।

এর আগে বেশ অর্থাৎ গত দেড়বছরের মধ্যে এরকম বেশ ক'টি ভিডিও ইউটিউবে চোখে পড়েছিল। তখনও বিষয়টি ভাল লাগেনি। কিছু লিখব কিনা ভাবছিলাম। কিন্ত গত দুইদিন যাবত ফেসবুকে একই ভিডিও বারবার চোখের সামনে চলে আসায় বিরক্ত।

এ ঘটনা নতুন নয়। গত দেড় বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রচলিত জীবনধারার বাইরের মানুষজনদের এমন ‘জোরপূর্বক’ চুল-দাড়ি কেটে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে, তা আবার ফলাও করে প্রচারও করা হচ্ছে ফেইসবুক- ইউটিউবে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠেছে, কেউ চাইলেই কাউকে ধরে জোর করে চুল-দাড়ি কেটে দিতে পারেন কি না; কিংবা ‘ভিউ বাণিজ্যের’ চেষ্টায় আবার সেসব ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করাটাও কতটা আইনসিদ্ধ?

বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যায় লোকজনগুলো দাড়ি,টুপি ও পাঞ্জাবি পরিহিত। এরা কাঁচি,ট্রিমার,সাবান,শ্যাম্পু নিয়ে জটাধারি ব্যক্তিদেরকে বলপ্রয়োগ করে চুল,দাঁড়ি কেটে দিচ্ছে। এই ভিডিওগুলো নিশ্চয় আপনারাও দেখে থাকবেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ব্যক্তিগুলো কারা?

ভিডিও দেখে শুধু এতটুকু বুঝতে পারছি, তাঁরা পোশাক-আশাকে চেহারা-সুরতে ইসলাম বেশধারী। এছাড়া পাঞ্জাবির ওপর ভেস্ট পরেন। ভেস্টের ওপর একটি প্রতিষ্ঠানের লোগোও দেখা যায়। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, ফেসবুক ভিত্তিক হিউম্যান সার্ভিস বাংলাদেশ নামে একটি সংগঠনের লোকজন এরা। হিউম্যানিটি ফার্স্ট বিডি নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলও আছে তাদের। এরা দেখতে বেশ শক্ত সামর্থ্যবান। তাঁদের সঙ্গে শক্তিতে কুলিয়ে উঠতে পারেন না আক্রান্ত ব্যক্তিরা। গত দুইদিন আগের আলোচিত ভিডিওটি তাদের পেইজে পোস্ট করার পর সবার নজরে আসে। ভিডিওতে যেভাবে জোর করে ধরে তাঁর চুল-দাড়ি কেটে দেওয়া হলো, সেই দৃশ্য কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। ভুক্তভোগী মানুষটি শেষ দিকে বারবার বলছিলেন, ‘আল্লাহ তুই দেহিস।’ প্রকারান্তরে আল্লাহর কাছেই বিচার দিলেন তিনি। গরিবের আশ্রয়ের জায়গা তো ওই একটাই।

আচ্ছা, বলুনতো আপনি বা যে কেউ চুল লম্বা রাখবে কিনা ন্যাড়া হবেন কিংবা দাড়ি বা জট রাখবেন - এ বিষয় কেউ কি জোরপূর্বক মতামত চাপিয়ে দিতে পারেন?

কিংবা আপনি কারোর সম্মতি ছাড়া তাঁর ওপর জবরদস্তি চালিয়ে চুল-দাড়ি কাটতে পারেন?

যদি না পারেন, এ ধরনের আচরণ সম্পূর্ণ অমানবিক, বেআইনি এবং সংবিধান ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩১ নম্বর অনুচ্ছেদ প্রতিটি নাগরিককে আইনের আশ্রয়ে মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের অধিকার দিয়েছে। ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদ জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করেছে এবং ৩৫ নম্বর অনুচ্ছেদ কারও প্রতি নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ নিষিদ্ধ করেছে।

সংবিধানের ৩২ নাম্বার অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ব্যক্তির জীবন যাপন, স্বাধীনতা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি রাস্ট্র দিয়েছে। তাহলে এরা ( যারা এই অপকর্ম করছেন) কারা? রাস্ট্র কি তাদের দায়িত্ব দিয়েছে পথে ঘাটে বাবড়ি চুল,জটাধারী বা মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিকে আটকে জোরপূর্বক চুল,দাঁড়ি,জটা কেটে দেয়ার?

পথে ঘাটে যা হচ্ছে এধরনের কাজ অন্যায়। শুধু অন্যায় নয়, আবারও বলছি এটা নিষ্ঠুর ও অমানবিক এবং অপমানজনক। আজ একজন সাধারণ মানুষের স্বাধীন জীবন যাপন বা তার পছন্দমতন চলতে চাওয়ায় বাধাগ্রস্থ করা হচ্ছে। আগামীকাল আপনার, আমার সাথে হবে না - এই গ্যারিন্টি কি আছে?

ইতোমধ্যে মানবাধিকার সংগঠন আইন শালিস কেন্দ্র গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় সাংবাদিক আরিফুজ্জামান তুহিন এই বিষয় প্রতিবাদ জানিয়ে লেখায় জীবন নাশের হুমকি পেয়েছেন। জোরপূর্বক চুল জটা কাটার প্রতিবাদ জানানো কিভাবে ধর্মের অবমাননা হয়, জানি না। যারা হুমকি দিয়েছেন তারা ধর্ম বোঝেন কিনা যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। জীবন নাশের হুমকির তীব্র নিন্দা জানাই।

প্রকাশ্যে জোর করে চুল কেটে দেওয়া কেবল ভুক্তভোগীর মৌলিক অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতারই লঙ্ঘন নয়, বরং এটি তাঁর মর্যাদার ওপর সরাসরি আঘাত। এ ধরনের ঘটনা সমাজে ভীতি, আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করছে।

বিভিন্নসুত্রে বের হয়ে আসছে, এই নিষ্ঠুর, অমানবিক কাজটি যারা করছেন এরা ইসলামি কোনো সংগঠন বা সমাজসেবামূলক প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত। আবার কেউ কেউ তা-ও নয়। কিন্তু ছড়িয়ে পড়া ভিডিওগুলো দেখে খেয়াল করার মতো বিষয় হলো, তাঁদের প্রত্যেকেরই টার্গেট থাকে কোনো ভবঘুরে, মাজার-খানকা ঘরানার ফকির বা পাগল বেশধারী মানুষকে ধরে নিয়ে তাঁদের চুল কেটে দেওয়া এবং এ কাজটাকে ভালো কাজ হিসেবে প্রদর্শন করা। এ ক্ষেত্রে তাঁদের কেউই সম্মতি-অসম্মতির ধার ধারছেন না।

জোরজবরদস্তির এই অধিকার যেমন মানবাধিকার কিংবা সেক্যুলার দৃষ্টিকোণ থেকে নেই, একইভাবে ধর্মের দিক থেকেও নেই। ধর্ম কারোর ওপর এমন কিছু চাপিয়ে দেওয়ার কথা বলেনি। পবিত্র কোরআনে সুরা বাকারার আয়াতেই আল্লাহ বলেছেন, ‘ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই।’ ফলে ধর্মের দায় দিয়ে আপনি কারও ওপর কোনো ধরনের আঘাত করার অধিকার রাখেন না। এই কাজগুলো কোনভাবেই সমাজসেবা নয়। স্রেফ নিষ্ঠুর অমানবিক নির্যাতন।

দায়ী ব্যক্তিদের দ্রুত চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে আর কোনো নাগরিক এমন অবমাননাকর ও বেআইনি আচরণের শিকার যাতে না হন, রাষ্ট্রকে তা নিশ্চিত করতে হবে।

এ ধরনের নিষ্ঠুর ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেখানে হবার সম্ভাবনা দেখবেন পুলিশকে দ্রুত জানিয়ে সামাজিকভাবে এই অপকর্ম হতে এদের নিবৃত্ত করবেন।

লেখক: গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

১২৬ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন