সর্বশেষ

মতামত

মনোবিজ্ঞান, সেক্সোলজি ও জনস্বাস্থ্যের আলোকে দাম্পত্য সখ্যতার গুরুত্ব

খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী
খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী

বৃহস্পতিবার , ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ৬:৫২ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
বিয়ে শুধু সামাজিক চুক্তি নয়; এটি মানুষের মানসিক, শারীরিক ও আত্মিক পরিতৃপ্তির একটি সমন্বিত রূপ। দাম্পত্য জীবনের অন্যতম স্তম্ভ হলো যৌন সম্পর্ক বা শারীরিক ঘনিষ্ঠতা।

এই ঘনিষ্ঠতা শুধু আনন্দের বিষয় নয়, বরং এটি মানসিক শান্তি, শারীরিক সুস্থতা, পারিবারিক স্থিতি এবং সামাজিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে— “Sexual health is fundamental to the overall health and well-being of individuals, couples and families.” (WHO, 2010)।

স্বামী/স্ত্রী যখন কাছে আসেন এবং কেউ নানা কারণে তা প্রত্যাখ্যান করে বা কারো পক্ষ থেকে কোন ধরনের ব্যাঘাত সৃষ্টি হয় তখন এর প্রভাব পড়ে সরাসরি সঙ্গীর আত্মসম্মান, ভালোবাসা ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। ১৯৯৯ সালে মনোবিজ্ঞানী ড. জন গটম্যান তার একটি বিখ্যাত বইয়ে লিখেছেন—“Emotional withdrawal and rejection in intimate moments are among the strongest predictors of divorce.” অর্থাৎ, বারবার যৌন ঘনিষ্ঠতায় অস্বীকৃতি একটি দাম্পত্য জীবনের ভাঙনের অন্যতম প্রধান কারণ। এর ফলে দেখা দিতে পারে—স্বামীর বা স্ত্রীর আত্মবিশ্বাস ভেঙে যাওয়া, দাম্পত্য সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হওয়া, মানসিক চাপ থেকে নিজের অজান্তে বিকল্প সম্পর্ক বা পরকীয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া।

অ্যানথ্রোপলজিস্ট হেলেন ফিশার বলেন—“Sex is not just recreation; it is a powerful bonding mechanism that cements trust and attachment.” অর্থাৎ, যৌনতা কেবল শারীরিক তৃপ্তি নয়, বরং এটি দু’জন মানুষের মধ্যে আস্থা ও সম্পর্কের আঠা।

জনস্বাস্থ্য ও পারিবারিক স্থিতি- জনস্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে যৌন সন্তুষ্টি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। Journal of Sexual Medicine-2007-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে— যৌন জীবনে সন্তুষ্ট দম্পতিরা হতাশা, উদ্বেগ ও বিবাহবিচ্ছেদের ঝুঁকিতে তুলনামূলকভাবে অনেক কম ভোগেন।

 

যখন দাম্পত্য সম্পর্ক অশান্ত হয়, তখন তা পরিবার ভাঙনের দিকে ঠেলে দেয়। এর ফলে শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, তাদের মধ্যে অনিরাপত্তা ও আক্রমণাত্মক আচরণ বাড়ে। তাই যৌন অশান্তি কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং সামাজিক ও জনস্বাস্থ্যগত সমস্যা হিসেবেও ধরা যায়।


সেক্সোলজিস্টদের দৃষ্টিতে- সেক্সোলজিস্টরা বলেন, যৌন সম্পর্ক হওয়া উচিত পারস্পরিক অংশগ্রহণের ভিত্তিতে। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় স্ত্রী কেবল নিষ্ক্রিয়ভাবে শুয়ে থাকেন, যাকে অনেকে ব্যঙ্গ করে "dead-fish syndrome" বলেন।

খ্যাতনামা সেক্স থেরাপিস্ট Dr. Ruth Westheimer বলেন— “The act of sex without enthusiasm becomes a mechanical duty, not an expression of love, and ultimately leaves both partners dissatisfied.” অর্থাৎ, যদি যৌনতা নিছক দায়িত্বে পরিণত হয়, তবে তা ভালোবাসার প্রকাশ নয় বরং যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

যৌনতার শাস্তি মনোবৈজ্ঞানিক ভুল

 

অনেক দম্পতি রাগ বা অভিমানের কারণে সঙ্গীকে শাস্তি দিতে যৌনতা অস্বীকার করেন। এটি দীর্ঘমেয়াদে সম্পর্ককে ধ্বংস করে। ড.গ্যারি চ্যাপম্যান The 5 Love Languages বইয়ে লেখেন— “When intimacy is withheld as a weapon, the marriage bed becomes a court of punishment rather than a sanctuary of love.”
অর্থাৎ, যৌনতাকে শাস্তির অস্ত্র বানানো হলে শোবার ঘর ভালোবাসার আশ্রয় নয়, বরং শাস্তির আদালতে পরিণত হয়।

ঝগড়া মেটানোর উপায় হিসেবে যৌনতা

 

বুদ্ধিমান দম্পতিরা ঝগড়া মেটাতে শারীরিক ঘনিষ্ঠতাকে ব্যবহার করেন। Archives of Sexual Behavior-2016-এর গবেষণায় বলা হয়েছে—“Couples who maintain sexual intimacy even during conflict report faster reconciliation and stronger relationship resilience.” অর্থাৎ, ঝগড়ার পরেও যদি যৌন ঘনিষ্ঠতা বজায় থাকে, তাহলে দাম্পত্য সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয়। কারণ শারীরিক ঘনিষ্ঠতার সময় শরীরে নিঃসৃত হয় oxytocin, যা “bonding hormone” নামে পরিচিত। এটি রাগ কমায়, আস্থা ও আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।

প্রেমিক -প্রেমিকা হয়ে ওঠা জরুরী

২০০৬ সালে মনোবিজ্ঞানী Esther Perel তার The maintain in Captivity বইয়ে লিখেছেন—“Eroticism thrives not in duty, but in playful and active engagement.” অর্থাৎ, যৌনতার আনন্দ আসে স্বতঃস্ফূর্ততা ও খেলার মধ্য দিয়ে, নিছক কর্তব্যবোধ দিয়ে নয়। একজন সক্রিয় স্ত্রী যখন নিজে থেকে স্বামীকে আদর করেন, নতুনত্ব আনেন, তখন সে সম্পর্ক অটুট থাকে।

 

Journal of Family Psychology -2018 এর গবেষণায় দেখা গেছে— পারস্পরিক যৌন অনুসন্ধান (mutual exploration) দম্পতির সুখ-সমৃদ্ধি বহুগুণ বাড়ায়।

যৌন অধিকার : ধর্মীয় ও জনস্বাস্থ্যের দৃষ্টিতে

 

ইসলামেও দাম্পত্য যৌন অধিকারের গুরুত্ব স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন— "In the sexual act of each of you there is charity." (Sahih Muslim). অর্থাৎ তোমাদের প্রত্যেকের সহবাসের মধ্যেই আছে সদকা।” (সহীহ মুসলিম)

এটি প্রমাণ করে, স্বামী-স্ত্রী দু’জনের জন্য যৌন চাহিদা পূরণ করা ইবাদতস্বরূপ। একইভাবে WHO -2002 যৌন অধিকারকে সংজ্ঞায়িত করেছে এভাবে— “the possibility of having pleasurable and safe sexual experiences, free of coercion, discrimination, and violence.”

 

অতএব, যৌনতা স্বামী বা স্ত্রীর একার বিষয় নয়; এটি পারস্পরিক অধিকার, দায়িত্ব এবং আত্ম সুরক্ষার প্রধান চালিকাশক্তি।

দাম্পত্য ঘনিষ্ঠতা রক্ষার কিছু কৌশল-মনোবিজ্ঞান ও সেক্সোলজিস্টদের দৃষ্টিতে কয়েকটি কার্যকর উপায় হলো—

 

১.ইমোশনাল ফোরপ্লে: দিনের বেলা ছোট্ট বার্তা বা আদরের কথা বলা। ড. লরা বারম্যান বলেন— “Great sex begins long before the bedroom.”
২.সক্রিয় অংশগ্রহণ: স্পর্শ, চুম্বন, শব্দের মাধ্যমে আগ্রহ প্রকাশ।
.নতুনত্ব আনা: একঘেয়েমি ভাঙতে নতুন ভঙ্গি বা পদ্ধতির চেষ্টা করা।
৪.আফটারকেয়ার: সহবাসের পর আদর ও আলিঙ্গনে থেকে যাওয়া।
৫.খোলামেলা আলোচনা: চাহিদা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে কথা বলা।
৬.ঝগড়া মেটাতে যৌনতা: রাগ পুষে না রেখে শারীরিক ঘনিষ্ঠতায় মিলন ঘটানো।

দাম্পত্য যৌনতা নিছক শারীরিক নয়, এটি শারীরিক ও মানসিক শান্তি, পারিবারিক স্থিতি ও সামাজিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যৌনতায় অস্বীকৃতি, নিষ্ক্রিয়তা বা এটিকে শাস্তি হিসেবে ব্যবহার করলে সম্পর্ক ভাঙনের দিকে ধাবিত হয় এবং স্বাস্থ্যগত সমস্যায় পর্যবসিত হয়। দীর্ঘদিন এ অবস্থা চলতে থাকলে মেন্টাল ডিজঅর্ডার, ক্যান্সার সহ নানা রোগে জর্জরিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিপরীতে, ভালোবাসা, সক্রিয় অংশগ্রহণ ও নতুনত্ব দম্পতিকে আজীবন একসাথে বেঁধে রাখে।

সেক্সোলজিস্ট "আলফ্রেড কিনসে" একবার বলেছিলেন—“The only unnatural sex act is that which you cannot perform.”

অতএব, যৌনতা লজ্জার বিষয় নয়; শারীরিক মানসিক ও আত্মিক সুস্থ থাকার অবলম্বন। এটি সুস্থ দাম্পত্য জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যারা এটিকে বোঝাপড়ার সেতু হিসেবে ব্যবহার করতে জানেন, তারাই সুখী পরিবার ও সুস্থ সমাজ গড়ে তুলতে পারেন।

লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক, একটি বেসরকারি গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘদিনের কর্ম-অভিজ্ঞতাসম্পন্ন।

১২৬ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন