সর্বশেষ

মতামত

গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয়: বাংলাদেশে তৌহিদী জনতার অপতৎপরতা

মনজুর এহসান চৌধুরী
মনজুর এহসান চৌধুরী

শনিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ৪:২১ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
বাংলাদেশে “তৌহিদী জনতা” নামের একটি ধর্মীয় ব্যানারে সংগঠিত মুসলিম জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে ছাত্র–জনতার জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশের সামাজিক-ধর্মীয় অঙ্গনে বারবার অগণতান্ত্রিক, সহিংস এবং জনতান্ত্রিক অপকর্মের জন্য পরিচিত হয়ে উঠেছে।

নিজেরা কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল নয়, বিভিন্ন ইসলামপন্থী সংগঠন, মাদ্রাসার ছাত্র, স্থানীয় ইমাম বা সাধারণ মুসল্লিরা ক্ষেত্রবিশেষে ধর্মীয় আবেগে কট্টরভাবে একত্রিত হয়ে এই গোষ্ঠীর ব্যানার ব্যবহার করে এবং দেশের সংস্কৃতি, নারী অধিকার, সুফি-মাজার, ও ধর্মীয় উদযাপন নিয়ে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সহিংস ও নিষেধাজ্ঞামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলেছে।


এই গোষ্ঠীর অপকর্মের পরিধি নারীদের ফুটবল–ক্রিকেট টুর্নামেন্টে হামলা, নারী তারকাদের অনুষ্ঠানে বাধা, ঐতিহাসিক ও সুফি মাজারে ভাঙচুর, পবিত্র কাবা শরীফ আদলে নির্মিত কবরের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতির নামে ভয়াবহ গণ–সহিংসতা, প্রকাশ্য জনতার বিচারসহ পুলিশ-প্রশাসনের চাকুরি কার্যক্রমে সরাসরি হস্তক্ষেপ। সবই অন্তর্ভুক্ত। বারবার ধর্ম, সংস্কৃতি বা সামাজিক শুদ্ধতার অজুহাতে এই গোষ্ঠী বিক্ষোভ, জনজাগরণ, হামলা ও বিভাজনের মাধ্যমে বাংলাদেশের নাগরিক সম্প্রীতি ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে চরম সংকটে ফেলে দিয়েছে।

নূরা পাগলার মাজারে হামলা
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার কাদির মোল্লার দরবার শরিফে ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, জুম্মার নামাজের পর উত্তেজিত জনতা ‘শরীয়ত বিরোধী আচরণ’ ও পবিত্র কাবার আদলে নির্মিত কবরের বিরুদ্ধে হামলা শুরু করে। ইসলামপ্রিয় লোকজন, স্থানীয় মুসল্লি, ও ‘ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি’র নেতৃবৃন্দ দরবারে প্রবেশ করে ব্যাপক ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ ঘটান। সংঘর্ষে রাসেল মোল্লা নিহত হন এবং অন্তত ৫০ জন আহত হন। উত্তেজিত জনতা কবরের দেয়াল টপকে মরদেহ উত্তোলন করে, মহাসড়কের মোড়ে সেটি প্রকাশ্যে আগুনে পুড়িয়ে দেয়। পুলিশ-প্রশাসনের গাড়ি ভাঙচুরের পাশাপাশি র‍্যাব, সেনাবাহিনী, অতিরিক্ত নিরাপত্তা বাহিনী এলাকায় মোতায়েন করা হয়। ঘটনার পর অন্তর্বর্তীকাল সরকার এবং বিভিন্ন সংগঠন একে ‘অমানবিক’ ও ‘অবর্ণনীয়’ অপরাধ হিসেবে নিন্দা জানায় এবং কঠোর পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দেয়।

কারা এই তৌহিদী জনতা
“তৌহিদী জনতা” বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ধর্মীয় ও সামাজিক ইস্যুতে আলোচিত একটি গণব্যানার, যার আড়ালে সাধারণত স্বতঃস্ফূর্তভাবে বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমন্বিতভাবে ধর্মীয় আবেগে উদ্দীপ্ত মুসলিম জনতার অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়। এটি কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক সংগঠন নয়, বরং মসজিদ-ভিত্তিক গ্রুপ, মাদ্রাসা ছাত্র, ইসলামপন্থী দলীয় কর্মী, স্থানীয় ইমাম ও ধর্মানুরাগী নাগরিক—এদের স্বতঃস্ফূর্ত বা কাউন্সেল করা সংমিশ্রণ।
অনেক ক্ষেত্রেই অনেক আগে থেকেই যুক্ত উগ্রপন্থী নেতা, স্থানীয় রাজনৈতিক ক্যাডার বা মৌলবাদী সদস্যরাও ‘তৌহিদী জনতা’ পরিচয়ের আড়ালে সমন্বয় করেন, মানুষকে সংগঠিত করার এদের লক্ষ্য। অর্থাৎ, স্বতঃস্ফূর্ত সাধারণ মুসলিম ও কট্টরপন্থীদের সম্মিলনেই বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ‘তৌহিদী জনতা’ নামে জনতার উত্তেজনা ও সংঘাত সংঘটিত করা হচ্ছে।

তৌহিদী জনতার অন্যান্য অপকর্ম:
নারী ফুটবল ম্যাচে হামলা ও বাধা: ১২ জানুয়ারি ২০২৫, দিনাজপুর-হিলিতে নারী ফুটবল ম্যাচে ‘তৌহিদী জনতা’ ধর্মীয় অনুভূতির নামে হামলা চালায়। মাঠের বেড়া ভাঙা, আয়োজক-প্রশাসনের সাথে সংঘর্ষ এবং অন্তত ৬ জন আহতের খবর পাওয়া যায়। স্থানীয় ইসলামি দলের নেতারা নারীদের খেলায় অংশ না নিতে হুমকি দেয়।
১৪ জানুয়ারি ২০২৫, রংপুর-তারাগঞ্জে ইসলামি আন্দোলনের হুমকিতে মাঠে নারীদের খেলা প্রশাসন বন্ধ করে দেয়।

নারী তারকাদের শো-রুম উদ্বোধনে বাধা:
১ নভেম্বর ২০২৪, চট্টগ্রাম ও ঢাকা, জনপ্রিয় অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরী ও পরীমনির শো-রুম উদ্বোধন অনুষ্ঠান সরাসরি ‘তৌহিদী জনতা’ ও ইসলামী ব্যবসায়ী সমাজের প্রতিবাদে বন্ধ হয়ে যায়। উত্তেজনা থেকে অনুষ্ঠান বাতিল, জড়ো হওয়া জনতার উপস্থিতিতে নিরাপত্তা বাহিনী সতর্ক করা হয়।

মাজারে ওরস, দরবার শরিফ ও ধর্মীয় স্থাপনায় হামলা:
২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ঢাকার ধামরাই: শুকুর আলী শাহ ফকিরের মাজারে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর-লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।
৮ জানুয়ারি ২০২৫, ময়মনসিংহ শহর: কালু শাহ দরবারে কাওয়ালি আয়োজনের সময় হামলা, ২০০ বছর পুরনো ধর্মীয় স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত করে।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নারায়ণগঞ্জের বন্দরের মদনপুর এলাকায় দেওয়ানবাগ দরবার শরিফে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। স্থানীয় মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে ফজরের নামাজের পর এলাকাবাসী হামলা চালায়, দরবারের ফটক ভেঙে ঢুকে আসবাব, টিনের ঘর ও স্থাপনা আগুনে পুড়িয়ে দেয় এবং লুটপাট করে। হামলায় বেশ কয়েকজন আহত হয়। এরপর ময়মনসিংহের ত্রিশালেও দেওয়ানবাগ দরবারে হামলার চেষ্টা হয়েছে। পুলিশ ও প্রশাসন গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে, দরবার ও আশপাশের এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন হয়।

জানুয়ারি-জুলাই ২০২৫, নারায়ণগঞ্জ-কুমিল্লা-সিলেট: আলিমুদ্দীন চিশতীর মাজার, আশরাফনগর দরবারসহ বাংলাদেশে বেশ কিছু বসতবাড়ি, মাজার ও খানকায় ‘সম্মিলিত ধর্মীয় অনুভূতির’ অজুহাতে হামলা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটানো হয়। এদের হামলার অন্যতম লক্ষ্য ছিল দেশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও সুফি মাজার। বিগত পাঁচ মাসে শুধু রাষ্ট্রীয় হিসেবে ৪০টির বেশি মাজারে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।

পুলিশের উপর হামলা, আইন হাতে নিয়ে বিচার:
৭ মার্চ ২০২৫, ঢাকা, নারী হয়রানি মামলার অভিযুক্ত কর্মচারীর মুক্তি দাবিতে থানায় রাতভর অবস্থান, ব্যাপক জনতা উপস্থিতি এবং সংশ্লিষ্ট থানা অবরোধ করে।

ফেব্রুয়ারি-মার্চ ২০২৫, দেশের বহু এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভ্যান, অফিসে আক্রমণ, সরাসরি পুলিশের সাথে সংঘর্ষ এবং থানা অবরুদ্ধ করে দাবি আদায়ের চেষ্টার নজির রয়েছে।

সার্বিক গতিধারা ও দেশজুড়ে প্রভাব
তৌহিদী জনতার কর্মকাণ্ডে প্রধান তিনটি বৈশিষ্ট্য সাধারণভাবে লক্ষ্য করা যায় যেমন; ১. উগ্র ধর্মীয় আবেগ ও মব-মনস্তত্ত্ব, যার মাধ্যমে নারী অধিকার, সংস্কৃতির স্বাধীনতা এবং সুফি-মাজারবিরোধী পদক্ষেপ সক্রিয়। ২. পুলিশ, প্রসাশন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দুর্বল করে জনতার হাতে বিচার ও সহিংসতা।
৩. সরকারের নমনীয়, অলস ও দীর্ঘসূত্রিতার কারণে বারবার এসব অপকর্ম পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
সরকারের মুখপাত্র ও নাগরিক সমাজ বারবার বলেছে ‘তৌহিদী জনতা’ তরুণ-জনতার ধর্মীয় আবেগে প্রভাবিত, স্বতঃস্ফূর্ত ও ইচ্ছাকৃতভাবে সংঘবদ্ধ হয়ে অপরাধমূলক কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে সম্প্রতি ধর্মীয় ও সামাজিক বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে ‘তৌহিদী জনতা’ নামে সংগঠিত এক দল মুসলিম জনগণের অপতৎপরতা গণতান্ত্রিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ভারসাম্যকে গভীর সংকটে ফেলছে। নারীদের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সুফি দরবার–মাজার, এমনকি স্বাস্থ্যমূলক ও ধর্মীয় উৎসবেও বারবার ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, জনতার বিচার ও ভয়জনক নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে।
পর্যায়ক্রমে দেখা যাচ্ছে, প্রশাসনের অপর্যাপ্ত প্রতিক্রিয়া ও সরকারের নমনীয় অবস্থান এসব ধর্মীয় উগ্রতা, নারী ও সংস্কৃতি বিরোধী কর্মকাণ্ড, ও বিশৃঙ্খলায় উৎসাহ জুগিয়েছে। এ ধরনের গণ-সহিংসতা সমাজের স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক ধারণা, আইনের শাসন ও মানবাধিকারের পরিপন্থী—যা দেশের স্থিতিশীলতা, শান্তি এবং নাগরিক অধিকারের জন্য অশনিসংকেত।

দেশের কল্যাণ ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য জরুরি ভিত্তিতে আইনের কঠোর প্রয়োগ, প্রশাসনিক সক্রিয়তা, সমাজের সচেতনতা এবং অসহিষ্ণুতা ও সহিংসতার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার, বাংলাদেশকে নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ রাখার জন্য এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা এখন সময়ের দাবি।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

১৭০ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন