বিভিন্ন সংকটের মধ্যে সীমিত পরিসরে চলছে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ৩:২০ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম প্রত্যাশিত সরকারি স্বাস্থ্য শিক্ষা ও চিকিৎসা কেন্দ্র, যার যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সালে ।
প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই নানা চ্যালেঞ্জ—দুর্নীতি, বাজেট বৃদ্ধির পুনঃপুন প্রক্রিয়া, নির্মাণে দীর্ঘ বিলম্ব, অবকাঠামো সংকট ও জনবল ঘাটিতে হাসপাতালটি আলোচনায় আসে। অবশেষে দীর্ঘ এক যুগ পরে ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হলেও, এখনো প্রকৃত অর্থে পূর্ণাঙ্গ-সেবা দিতে পারছে না এই মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। জনস্বাস্থ্য, চিকিৎসাসেবা ও স্বাস্থ্যশিক্ষায় এর ভূমিকাকে কেন্দ্র করে এর বাস্তবতা, সংকট ও ভবিষ্যৎ সম্ভবনা নিয়ে আমার আজকের প্রতিবেদন।
প্রতিষ্ঠার ইতিহাস ও প্রকল্প অনুমোদন
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণের লক্ষ্যে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রকল্পের ভিত্তি স্থাপিত হয়। প্রথমবার ১৯৭৮-৭৯ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকার অঞ্চলটিকে মেডিকেল কলেজের আওতায় আয়ত্তে আনার পরিকল্পনা করলেও প্রকল্পটি পরবর্তীতে রাজনৈতিক কারনে বাস্তবায়িত হয়নি। পরে ২০১১ সালে বর্তমান সরকারের উদ্যোগে এই প্রতিষ্ঠানের মূল প্রকল্প অনুমোদিত হয়, যেখানে স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসা শিক্ষা—দুই ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক মানের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের প্রস্তাব দেওয়া হয়। ২০১২ সালের একনেক সভায় চূড়ান্তভাবে প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়, যার শুরুর বাজেট নির্ধারিত হয় ২৭৫ কোটি টাকা। শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে, প্রায় ৩১ একর জমিতে একাডেমিক ভবন, ছাত্রাবাস, আধুনিক হাসপাতাল ও নানা সেবামূলক ইউনিট তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়।
নির্মাণ কার্যাদেশ ও ব্যয় বৃদ্ধি
প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় গণপূর্ত বিভাগ, কার্যাদেশ পায় রাজনৈতিক যোগাযোগসম্পন্ন ‘হাই প্রোফাইল’ কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। আর্থিক ও প্রশাসনিক বিভিন্ন সমস্যার কারণে প্রকল্পে বাড়ে দুর্নীতির অভিযোগ। মূল বাজেট মাত্র কয়েক বছরে তিন ধাপে সংশোধিত হয়ে দাঁড়ায় ৬০০ কোটি টাকারও বেশি—ফলে প্রকল্প প্রথম অনুমোদনের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি ব্যয়বৃদ্ধি ঘটে। এসব আচমকা ব্যয়বৃদ্ধির অন্যতম কারণ ছিল নকশা বদল, অতিরিক্ত কাজ, অনুমোদনবিহীন অর্থব্যয়, এবং অনিয়মযুক্ত দরবৃদ্ধি, যেগুলো নিয়মতান্ত্রিক তদন্তে বারবার প্রমাণিত হয়েছে।
সময়সীমা ও বিলম্ব
প্রকল্প অনুমোদনের সময় নির্ধারিত হয়েছিল ৩-৫ বছরের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ করে পুরোপুরি চালুর, অর্থাৎ ২০১৪-১৬ সালের মধ্যেই হাসপাতাল চালু হওয়ার কথা ছিল । কিন্তু বারবার বাজেট, নকশা ও কার্যাদেশ পরিবর্তন, কাজের নিম্নমানসহ প্রশাসনিক জটিলতায় প্রকল্প শেষ হতে সময় লাগে প্রায় ১৪ বছর—চূড়ান্ত কার্যক্রম শুরু হয় ২০২৫ সালে। এতে শুধু সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা বিঘ্নিত হয়নি, শিক্ষার্থী, ডাক্তারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিলম্বের কারণ ও দুর্নীতি
বিলম্বের মূল কারনগুলো হচ্ছে- বিভিন্ন সময়ে ঠিকাদারি নিয়োগে ‘কমিশন’ ও রাজনৈতিক প্রভাব, অনুমোদনহীনভাবে সংশোধিত বাজেট, নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার, এবং নির্দেশিত সময়ের বারবার পরিবর্তন।
সিরিয়াস দুর্নীতির কারণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং দপ্তর সংশ্লিষ্ট কিছু প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। গণমাধ্যম ও সরকারি পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, ক্লিনিক্যাল যন্ত্রপাতির ক্রয়ে ঘুষ, অতিরিক্ত বিল নেওয়া, নির্মাণসামগ্রীতে বাজেট অনিয়ম, প্রকল্প ডিপিআর (ডিটেইলড প্রজেক্ট রিপোর্ট) ছাড়াই দর বৃদ্ধির মতো ঘটনা।
নির্মাণে দুর্ঘটনা
২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি হাসপাতালের নির্মাণাধীন শতভাগ ভবনের ছাদ ধসে একজন নির্মাণ শ্রমিক বজলু মিয়া (৬০) নিহত হন এবং পাঁচজন শ্রমিক আহত হন। তদন্তে স্টীল পাইপের পরিবর্তে নিম্নমানের কাঠ-বাঁশ ব্যবহারের প্রমাণ মেলে, সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ও কর্মচারীরা তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত হন। ভবিষ্যতে আবারও এমন দুর্ঘটনার জেরে প্রকল্প বাস্তবায়ন মন্থর হয় এবং আতঙ্ক দেখা দেয় শ্রমিকদের মধ্যে।
আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু
দীর্ঘ প্রতীক্ষার শেষে ২০২৫ সালের ৬ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে আংশিক ইউনিট নিয়ে হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথম পর্যায়ে মেডিসিন ও শিশু বিভাগে ৯০টি বেডে চিকিৎসাসেবা শুরু হয়, পর্যায়ক্রমে সমগ্র হাসপাতাল চালুর লক্ষ্য জানানো হয়। একইসাথে, স্থায়ী ক্যাম্পাসে একাডেমিক কার্যক্রমও চালু হয়।
লোকবল ও পূর্ণাঙ্গ যাত্রার সংকট
নিয়োগ পদ্ধতির দীর্ঘসূত্রিতা, বাজেট অনিশ্চয়তা, এবং নানা প্রশাসনিক জটিলতায় চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীসহ প্রয়োজনীয় জনবল এখনো পূরণ হয়নি। নানা পদ শূন্য থাকায় জরুরি আর ক্লিনিক্যাল পরিষেবা পুরোপুরি চালু করা যাচ্ছে না। প্রশাসনিক চাপ, অর্থায়নে বিলম্ব, এবং কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তহীনতায় হাসপাতালের রোগীবান্ধব সকল ইউনিট এখনো অপূর্ণ রয়েই গেছে ।
পড়ুয়া ও চিকিৎসক তৈরির চ্যালেঞ্জ
এখানে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীরা ক্লিনিক্যাল শিক্ষা ও ইন্টার্নশিপ পর্যায়ে চরম সংকটে পড়েছে। রোগী কম, আধুনিক ল্যাব ও ওয়ার্ডের সেবার ঘাটতি—এসব কারণে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের মান কমেছে। ফলে, শিক্ষার্থীরা দক্ষ চিকিৎসক হিসেবে তাদের পূর্ণ সামর্থ্য অর্জনে সমস্যায় পড়ছে, যদিও সরকারিভাবে (বিশ্ববিদ্যালয়/স্বাস্থ্য অধিদপ্তর) সর্বোচ্চ সুযোগ ও সহযোগিতা দেওয়ার কথা বলা হয় । দেশের নির্ধারিত বোর্ড পরীক্ষায় টিকে গেলে তারা চিকিৎসক হতে পারলেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানের দক্ষতা অর্জনে তাদের জন্য ঝুঁকি রয়ে যাচ্ছে।
সারসংক্ষেপ
দীর্ঘ ১৪ বছরের দুর্নীতি, বিলম্ব ও লোকবল ঘাটতির ইতিহাস ঘেঁটে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এখন পুরোপুরি চালু হয়নি। শিক্ষার্থী ও সাধারণ রোগীদের জন্য পূর্ণাঙ্গ সেবার নিশ্চয়তায় তাই এখনই গর্বের কিছু নেই, বরং সততার ঘাটতি, উপযুক্ত পরিকল্পনার অভাব, ও প্রশাসনিক সংকটে সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নের দুর্বলতা এই প্রকল্পে আবারও প্রমাণিত । আর এর জন্য দায়ী বিগত সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
১৪৬ বার পড়া হয়েছে