দেশজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা, ছাত্র সংঘর্ষ ও সরকারের ব্যর্থতায় উদ্বেগ

সোমবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ৪:৫৬ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
সাম্প্রতিক সপ্তাহে বাংলাদেশে একযোগে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, ময়মনসিংহসহ দেশের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী-অধ্যুষিত অঙ্গনে সহিংসতা, সংঘর্ষ ও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়েছে।
প্রশাসনিক ব্যর্থতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও আইনের দুর্বল প্রয়োগে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভয়ানক হামলা, শিক্ষার্থীদের ওপর বহিরাগতদের আক্রমণ, এবং নিরাপত্তাহীনতা সাধারণ মানুষের মনে ব্যাপক হতাশা ও উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি জাতীয় শিক্ষা-জীবন, সমাজ ও রাজনীতিকে নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে—যেখানে সরকার ও প্রশাসনের ব্যর্থতা এবং জনমনে সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়া চোখে পড়ার মতো।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষ ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা
৩০ আগস্ট সন্ধ্যা থেকে ৩১ আগস্ট সকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্তাক্ত সংঘর্ষ ও চরম আতঙ্কের জন্ম দেয় এক নিরাপত্তারক্ষীর নারী শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে।
দারোয়ান শিক্ষার্থীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করলে, বিষয়টি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে।
প্রতিবাদে উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তারক্ষীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে, স্থানীয় এলাকাবাসী ও বহিরাগত সন্ত্রাসীরা ইট, লাঠি ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে।
প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ, পুলিশের তাৎক্ষণিক উপস্থিতি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যাপক ঘাটতির কারণে সংঘর্ষ দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করে।
দফায় দফায় ছাত্র ও এলাকাবাসীর হামলা-পাল্টা হামলায় আহত হয়েছেন অন্তত ১৫০০ শিক্ষার্থী ও শিক্ষক, যার মধ্যে শতাধিক গুরুতর এবং ১০ জন আশঙ্কাজনক অবস্থায় আইসিইউতে ভর্তি।
আহতদের স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টার, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজসহ নানা হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে।
রাতভর অচলাবস্থা এবং রবিবার সকাল পর্যন্ত আতঙ্ক বিরাজ করে।
ছাত্রদের অভিযোগ, প্রশাসনের গাফিলতি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রথমদিকে অনুপস্থিতি পরিস্থিতিকে অনিয়ন্ত্রিত করে তোলে।
বর্তমানে শিক্ষা কার্যক্রম আংশিক বন্ধ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাকসু নির্বাচনকেন্দ্রিক সংঘর্ষ
৩০ আগস্ট সকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনের মনোনয়ন ঘিরে উত্তেজনা ছড়ায়।
ছাত্রদল, সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে ভোটাধিকার নিয়ে বিরোধ বাড়তে থাকে।
রাকসুর অফিসে তালা, মনোনয়ন ফরম তুলতে এসে হাতাহাতি, ঘরভাঙা ও স্লোগানে সংঘাত বাড়ে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, ছাত্র সংগঠনের মুখোমুখি অবস্থানে প্রায় ২০ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী আহত হন, যাদের সাবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টার ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, নির্বাচনি অনিয়ম, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও পুলিশি সহায়তার ঘাটতি পরিবেশকে আরও জটিল করে তুলেছে।
কেউ কেউ গুরুতর অবস্থায় রয়েছেন; ক্যাম্পাসজুড়ে সংকট-উত্তাপ বিরাজ করছে।
ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) আন্দোলন ও হামলা
ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পশুপালন ও ভেটেরিনারি অনুষদের শিক্ষার্থীরা “কম্বাইন্ড ডিগ্রি” দাবিতে ৩০ আগস্ট দুপুরে উপাচার্যসহ দুই শতাধিক শিক্ষককে জয়নুল আবেদিন মিলনায়তনে অবরুদ্ধ করেন।
সন্ধ্যায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর বহিরাগতরা হামলা চালায়—অনেক নারীসহ অন্তত ২০ শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন; কারও মাথায় ও শরীরে মারাত্মক আঘাত আসে। বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টার ও স্থানীয় হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা চলছে, কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
পরিস্থিতি ক্রমে অবনত হলে কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ এবং বিজিবি মোতায়েনের ঘোষণা দেয়। শিক্ষক অবরুদ্ধ, আন্দোলনকারীর ওপর হামলা, প্রশাসনিক অদক্ষতা ও নিরাপত্তা ব্যর্থতায় পুরো শিক্ষা নগরি থমথমে।
দেশের আইনশৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা—হতাশা ও সংশয়
অগাস্টের এই কয়দিনে দেশের শিক্ষা ও রাজনীতিতে সহিংসতা, গণবিচার, প্রশাসনের ব্যর্থতা, এবং নিরাপত্তাহীনতা সর্বাধিক প্রকট আকার ধারণ করেছে। চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বারবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অকার্যকর উপস্থিতি অথবা অনুপস্থিতি সহিংসতাকে সহজ করেছে।
ঢাকার আলোচিত রাজনৈতিক ভিপি নুরের ওপর পুলিশ-সেনা বাহিনীর হামলা, বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগত বা দলীয় ক্যাডারদের দ্বারা গণপিটুনিসহ নানা ঘটনা সাধারণ ছাত্র, শিক্ষক ও নাগরিকদের মনে হতাশা, নিরাপত্তা-সংশয় এবং ন্যায়বিচার নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা তৈরি করছে।
বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ও প্রশাসনের কার্যকর উদ্যোগের অভাবে “মব জাস্টিস” ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণীত হিংসা বেড়ে চলেছে। দেশের তরুণ, মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ ও নতুন গণজাগরণ যেখানে বেড়ে যেতে পারত, সেখানে আতঙ্ক ও জাতীয় নিরাপত্তা-উদ্বেগ দিন দিন বাড়ছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্রমাগত “তৎপর” থাকার দাবি করলেও, গত দুই দিনে সংঘটিত নৈরাজ্য ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় চরম ব্যর্থতার দায় মেটাতে পারেনি। এখন দরকার রাজনৈতিক স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, এবং শিক্ষা-অঙ্গনে সত্যিকারের নিরাপত্তা, যাতে দেশবাসী প্রকৃতিই গণতন্ত্র ও শান্তি প্রত্যাশা করতে পারে।
শেষ কথা
বর্তমান শিক্ষাঙ্গনের সহিংসতা ও প্রশাসনিক অকার্যকারিতা বাংলাদেশের যুবসমাজ, পরিবার ও সামগ্রিক সমাজের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একের পর এক ঘটনায় স্পষ্ট, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা, প্রশাসনিক অনীহা, এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ শিক্ষাপরিবেশকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক, অসন্তোষ এবং নিরাপত্তাহীনতা ক্রমাগত বাড়ছে, যার ফলে জাতীয় অগ্রগতির পথ বারবার বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়া হতাশা এবং সংশয় দূর করতে হলে অবশ্যই আইনের শাসন শক্তিশালী, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও শিক্ষাঙ্গনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। শুধু জরুরি নিরাপত্তা বা সাময়িক দমন নয়, মৌলিক সংস্কার, জবাবদিহি, এবং গঠনমূলক রাজনৈতিক সদিচ্ছা হলেই শিক্ষার্থীরা নতুন আস্থার সাথে তাদের ভবিষ্যৎ গড়ার সুযোগ পাবে। আজকের ঘটনার শিক্ষা—সভ্য, নিরাপদ ও মুক্ত চিন্তার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠা করার দায় কারও এড়ানোর সুযোগ নেই; দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এর ওপরই।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
১৪৬ বার পড়া হয়েছে