রক্ত-ঘামে লেখা জুলাই: বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানে ভাগ্যবদলের মহাকাব্য

মঙ্গলবার, ৫ আগস্ট, ২০২৫ ৪:৫৮ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
নশ্বর রাত কেটে রাত, অশ্রুজল মিশে রক্ত-ঘামে। ঢাকা শহরের আশ-পাশ দিয়ে জ্বলছে আগুন, কাঁপছে জনপদ। অবিচার, অমানিশার রাত বিদীর্ণ করে ছাত্র-জনতার বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত হল এক প্রতিজ্ঞা—‘বিজয় না হলে রাজপথ ছাড়বো না!’ আহ্বান উঠল, স্রোতের মতো গোটা জাতি ঝাঁপিয়ে পড়ল কোটা সংস্কারের দাবিতে, যার ভিতরে গেঁথে ছিল হাজারো ক্ষোভ আর প্রতিজ্ঞা।
২০২৪ সালের গনমুখর জুলাই—এটা কেবল একটি মাস ছিল না, ছিল আগুনঝরা ইতিহাসের প্রাণ। পুরনো রাষ্ট্রযন্ত্রের গ্রাসে দেড় দশকের জঞ্জাল জমে ছিল জনপদের বাঁকে বাঁকে, তারপর এক ভয়ংকর সত্য চিৎকার করে ফেটে পড়ল—জেগে উঠলো ছাত্র-জনতা, এই প্রজন্মের অসম্পূর্ণ দাবিতে নানা পর্ব, নানা মোড়, নানা টার্নিং পয়েন্টে ঘনিয়ে উঠল ইতিহাসের সবচেয়ে নাটকীয় আন্দোলন।
পটভূমি
নিঃশব্দে জমে থাকা অসন্তোষ থেকেই ২০১৮ সালে শুরু হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন। প্রধানমন্ত্রীর অভিমানে সব কোটা বাতিলের ঘোষণায় আন্দোলন থেমে গেলেও, হৃদয়ে থেকে যায় অমীমাংসিত ক্ষোভ। ছয় বছর পর ২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্টের কোটা পুনর্বহাল আদেশ সেই চাপা ক্ষোভে আগুন ধরায়।
এক ঘোষণাতেই আবার প্রাণ ফিরে পায় পুরোনো প্রতিবাদ—বয়স, স্বপ্ন ও প্রকৃত ন্যায়ের টানে রাজপথে নামে ছাত্র-জনতা।
সংকটে জন্ম, সাহসে ক্রোধ
বিতর্কিত কোটা পদ্ধতির ভারে দিন দিন নুয়ে পড়ছিল সরকারি চাকরির স্বপ্নভাগী দেশজুড়ে লাখো তরুণ-তরুণী। ২০২৪ সালের ৫ জুন আদালতের রায়ে ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল—পুরোনো ক্ষতের উপরে যেন নতুন জ্বালা ছুঁয়ে দিল। বহুদিন ধরে জমে থাকা অসন্তোষ, হতাশা আর ক্ষোভ সেদিন নতুনভাবে আগুন হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশজুড়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
১ জুলাই সেই ক্ষোভ আর চেপে রাখা গেল না। ঢাকার রাজু ভাস্কর্য থেকে শুরু—ঢাবি, জাবি, রাবি, সারা দেশের ক্যাম্পাস, কলেজ, মফস্বলের মাঠ পেরিয়ে একে একে ছড়িয়ে পড়ল ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর জোয়ার। পরীক্ষাসহ শ্রেণিকক্ষে পাঠদান বর্জন ঘোষিত হলো; শহরের মহাসড়কে জাগল মিছিলের ঢেউ, রাজু ভাস্কর্যের কেন্দ্রীয় চত্বরে জমল প্রত্যয়ের কালো-সাদা ব্যানার আর অভিমানী চোখের আলো।
এই আন্দোলনের ঢেউ কেবল ক্যাম্পাসেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ব্যাংক, অফিস, চায়ের টঙ, এমনকি গ্রামের অস্থির মাটিতেও প্রতিটি হৃদয়ে হৃদয়ে উচ্চারিত হতে লাগল একটাই শ্লোগান—‘সংস্কার চাই!’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাদ-জানালা আর বাইরের সব দেয়াল ভেদ করে প্রতিবাদের বৃষ্টিধারা ঢুকে পড়ল প্রতিটি রক্তকণিকায়।
ক্রোধানল যত বেড়েছে, যত বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়েছে তরুণ প্রজন্ম, ততই সাধারণ মানুষের কণ্ঠে-কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে এক অমোঘ প্রত্যয়—‘আমার অধিকার, আমিই ছিনিয়ে নেবো!’ আন্দোলন এখন আর কারও সম্পত্তি নয়, এটা হয়ে ওঠে সারাদেশের ঘুম ভেঙে ওঠার গল্প।
আন্দোলনের শুরু, উত্তাল রাজপথ
দুই সপ্তাহেই গণাবেগের জোয়ার ছড়িয়ে পড়ে দেশের প্রতিটি শহর, গ্রাম, অলিতে-গলিতে। কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর চোখে এ ছিল কেবল ‘অশান্তি’। মাসের মাঝামাঝি এসে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়—সরকার রাজপথে নামিয়ে দেয় তাদের লাঠিয়াল বাহিনী; কারও হাতে রড, কারও হাতে বন্দুক, কেউ পুলিশ, কেউ ছাত্রলীগের চেনা চেহারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সেই কৃষ্ণপক্ষের রাত—বাংলার মাটিতে রক্ত রাঙিয়ে দেয় ইতিহাস। গর্জে ওঠে বুলেট, ভেঙে পড়ে কত স্বপ্ন, ঝাঁপিয়ে আসে শত তরুণ প্রাণ, বুকের ভেতর তবু দ্বিধা নেই।
এই উত্তাল সময়েই আসে সেই ঘাতক মুহূর্ত—১৪ জুলাই। প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে উৎকণ্ঠা আর বিরক্তির সুরে শেখ হাসিনা বলে বসেন—“মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা (চাকরি) পাবে?”
এই অসহ্য কথাটি যেন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিস্ফোরক বারুদ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। সেদিন রাতেই হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী হোস্টেল থেকে বের হয়, গর্জে ওঠে রাজপথে, শ্লোগান তোলে—“চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার!” “আমি কে, তুমি কে—রাজাকার, রাজাকার! কে বলেছে? কে বলেছে—স্বৈরাচার, স্বৈরাচার!”
সেই বাঁধভাঙা কান্না, রুদ্রবাদ্য কণ্ঠ, আর চোখের দীপ্তিতে রাত হয়ে যায় অনমনীয় প্রতিজ্ঞার ভোর। অন্যদিকে সরকার কিছুতেই আর শান্ত হয় না—বারবার ঘোষণা আসে: ‘কারফিউ, অফিস-আদালত বন্ধ!’
ঢাকা শহর ডুবে যায় অন্ধকারে, সোশ্যাল মিডিয়ার সকল জানালা বন্ধ।
তবুও—আন্দোলন থামে না; নিভৃতে প্রজ্জ্বলিত বাতিঘরের মত, প্রতিবাদের সেই আলো অঞ্জনিতে তে জ্বলে থাকে।
রক্তপাত, নিষ্ঠুরতা আর অক্ষমতার আর্তনাদ
এ যেন কোনো গল্প নয়, যেন মহাকাব্যের মর্মন্তুদ ট্র্যাজেডি! ১৬ জুলাই থেকে শুরু হয় পুলিশ-আওয়ামী লীগের তাণ্ডব, যার নির্মমতা ভাষায় প্রকাশের ঊর্ধ্বে। রাস্তায় পড়ে থাকে ছাত্রের নিথর দেহ, নারী আন্দোলনকারী গুম হয়ে যায়, শিশুরও রক্ষা নেই এই হিংস্রতার হাত থেকে। তিনবার ইন্টারনেট বন্ধ, চারবার কারফিউ, শহরজুড়ে আতঙ্কের ছায়া; তবুও মুক্তির অপেক্ষায় নামাজ শেষে বৃদ্ধ, কষ্টের ভারে নুয়ে পড়া রিকশাচালক, কিশোরী স্কুলছাত্রী সবাই মিছিলে মিশে হৃদয়ের স্পন্দন বাড়িয়ে তোলে।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে জড়ো হয় হাজার ছাত্র, বুকের ভেতর জ্বলছে বিদ্রোহের আগুন। সেখানে অগ্রভাগে ছিল ২৩ বছরের নির্ভীক-নিষ্পাপ তরুণ আবু সাঈদ। সে দুই হাত ফাঁকা করে, বুক টান করে পুলিশের গুলিকে দৃপ্ত আলিঙ্গন করে নেয়—তার পতন বিদ্রোহকে নতুন সুর দেয়।
১৮ জুলাই, ঢাকার উত্তরায় চলমান আন্দোলনের উত্তাল দুপুরে, মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ ক্লান্ত-তৃষ্ণার্ত সহযোদ্ধাদের খুঁজে খুঁজে পানি দিচ্ছিলেন। “পানি লাগবে কারো? পানি, পানি?”—তার এই মানবিক ডাকে ছেদ পড়ে গুলির শব্দে; এক রাউন্ড গুলি যায় কপাল ছুঁয়ে, ডান কানের নিচ দিয়ে বিদীর্ণ হয়ে। সেই মুহূর্তে আন্দোলনের ব্যথা আর বেদনা রক্তাক্ত হয়ে ওঠে।
এরপর ১৯ জুলাই মধ্যরাতে দেশব্যাপী ঘোষণা আসে কারফিউ। দেশের বিভিন্ন জেলায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। কিন্তু কারফিউ উপেক্ষা করে লাখো ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসে। আশঙ্কা আর প্রতিরোধের মাঝে ঘটে চলে ব্যাপক সংঘর্ষ, অসংখ্য মানুষ নিহত হন; কিছু রিপোর্টে উঠে আসে হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানোর কাহিনি।
অন্যদিকে, সরকারি ভবন পোড়ে—কিন্তু তার চেয়েও বেশি পোড়ে প্রতিটি মানুষের বিপর্যস্ত বুক। ‘‘দোষী তোমরা, শাসকেরা!’’—এই চিৎকার ঘুরপাক খায় শহরজুড়ে। পরিবার হারায় সন্তান, প্রিয়বন্ধু; হাসপাতালে জোটে শুধু কান্না আর শোক। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে আসে—কমপক্ষে ১,৪০০ লাশ নিবন্ধন হয়েছে, অথচ আসল সংখ্যার শেষ নেই—এ যেন রক্তে লেখা এক অব্যাখ্যাত আন্দোলনের দামামা, যার জবাব সময়ই একদিন দেবে।
ব্ল্যাকআউট, গুম ও নাটকীয় প্রত্যাহার
এরপর শুরু হয় দেশের এক গভীর ব্ল্যাক আউট, রাত যেন আরও গাঢ় আর শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে ওঠে। আন্দোলনকারীদের বাসা-বাড়ি থেকে রাতের আঁধারে তুলে নেয়া শুরু হয়; বন্ধুরা নিখোঁজের খোঁজে দিশেহারা, আতঙ্ক জড়িয়ে ধরে প্রতিটি পরিবার। সরকার তখন কৌশলে জামায়াত, শিবির, বিএনপির ওপর সন্ত্রাসী হামলার দায় চাপিয়েছে—প্রতিটি সংবাদ বিবৃতিতে ‘বিদ্বেষের রাজনীতির’ আলামত ছড়াতে থাকে তারা।
প্রতিদিন দুই বাঁধা জলপ্রপাত—একদিকে আতঙ্ক-ছাওয়া পুলিশ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ মিলে ভয় ধরানোর দাপুটে শাসন; অন্যদিকে ছাত্র-জনতার দুঃসাহসী জোয়ার, কারফিউ-ভাঙা আলিঙ্গন, প্রত্যয়ের কালো সকালে সাদা চাদর হয়ে বেঁধে থাকা আলোক-বিন্দু।
তুমুল নাটক দেখা যায়—তুলে নিয়ে যাওয়া হয় শীর্ষ ছয় সমন্বয়কদের। তাদের খোঁজ নেই, ফোন বন্ধ, পরিবার কাঁদে। পরে জানা যায়, ডিবি অফিসে অনির্বাচিত ‘হেফাজতে’ তারা। বিতর্ক হয়, কারণ ভাইরাল হলো—হারুনে ভাতের হোটেলে ডিবির অফিসারদের সাথে তাদের চুপচাপ বসে থাকা দৃশ্য।
তারপর শুরু “প্রত্যাহার নাটক”—প্রচণ্ড চাপে পড়ে ক্যামেরার সামনেই নাহিদ ইসলামকে দিয়ে মুখস্থ বিবৃতি পড়ে শোনানো হয়—‘‘আন্দোলন প্রত্যাহার করছি’’।
কিন্তু কেউ জানে, ওই মুখে মুখে কোনো সত্য নেই—চোখের ভাষা বলে দেয় নিশ্চিত বাঁধাহীন স্বাধীন স্পন্দন। এরই মাঝে হাইকোর্টে পুলিশের গুলি বন্ধের রীটও খারিজ হয়ে যায়—রাজপথ আরও অনিশ্চিত, আরও বিপদসংকুল।
দিনের পর দিন ডিবির হেফাজতে থেকে অবশেষে মুক্ত হন ষষ্ঠ সমন্বয়করা—তারা ফিরে এসে আন্দোলনে যুক্ত হন দ্বিগুণ কঠোরতায়, আরও দুঃসাহসে, আরও অবিচলতায়।
সরকারও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। হাসিনা ডাকে তার পোষ্য সাংবাদিক এবং দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের। বৈঠকের আয়োজনে পরামর্শ নেওয়া হয়—কীভাবে সরকার পতনের সুনামিতে বাধা হবে।
এরা সবাই হাসিনার টেবিলে বসে সরকারের পাশে থাকার আশ্বাস দেয়—কিছু ক্রুদ্ধ, কিছু নিরুপায়—তবুও প্রধানমন্ত্রী এমন রাজনৈতিক চাপ সামলানোর পথ খুঁজে বেড়ান। হুকুম দেন মরণঘাতি অস্ত্র ব্যবহারের, যাতে লাশের উন্মাদনায় তৃপ্ত হয় রক্ত পিপাসু স্বৈরাচার।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্ব
আগস্ট এসে গেছে, অথচ জুলাইকে শেষ হতে না দিয়ে ৩২, ৩৩, ৩৪, ৩৫ জুলাই—এক সিদ্ধান্তে ঘোষণা হলো। দেশের আকাশে, মানুষের মনে যেন অস্থিরতার নতুন স্রোত নামে গেল।
আগস্টেই রাজনৈতিক মানচিত্র নতুন মোড় নেয়; সরকার গম্ভীর উচ্চারণে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করে। শহীদের স্মরণে দেশ জুড়ে পালিত হয় ‘Remembering Our Heroes’—সাদা বধ্যভূমিতে, পতাকা হাতে, কণ্ঠে শপথ নিয়ে তরুণ-তরুণীরা উচ্চারণ করে, ‘‘তাদের রক্ত বৃথা যেতে দেবে না প্রজন্ম।’’ পরীক্ষার্থীরা ঘোষণা দেয় কঠিন সিদ্ধান্ত—এইচএসসি পরীক্ষা বর্জন। সে সাথে সামাজিক গণমাধ্যমে লাল প্রোফাইল, শিল্পীর তুলিতে দেওয়াল গুলোতে প্রতিবাদের আঁকাবাঁকা রেখা, প্রবাসীর কণ্ঠেও জেগে ওঠে অদেখা বাংলাদেশের জন্য কান্না-মুঠো একাত্মতা।
রাজধানীর রাস্তায় পড়ে থাকে নতুন বিস্ফোরণ; সংঘর্ষে আহত, পুলিশের গুলিতে নিহত—থানায় বিক্ষোভকারীদের মারধর, প্রতিবাদে জ্বলে উঠে থানার দেয়াল, বাতাস ভারী হয়ে উঠে আগুনের ধোঁয়ায়। শহর যেন ফুসে ওঠে, কারো চোখে পানি, কারো মুখে রক্তের রেখা—সব মিলিয়ে জনতার ক্রোধ আর কষ্ট উচ্চারিত হয়, ‘‘তোমরা আর থামাতে পারবে না!’’
এর মধ্যে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ পৌঁছায় চূড়ান্ততম মাত্রায়; খোলা মাঠে, ফুটপাথে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘরে-বাইরে অজস্র তরুণ-তরুণী, পেশাজীবী, শ্রমিক—শাহবাগ থেকে শহীদ মিনার, মিছিল ছড়িয়ে যায় একাই। কেউ পিছু নেয় না; নারী-পুরুষ, ছাত্র-অভিভাবক, শ্রমিক-শিক্ষক—বিষাদের দিনে, প্রতিজ্ঞার রাতে সবাই একত্রে দাঁড়ায়।
ডাকে ওঠে একটাই ঘোষণা—সরকার পতনের এক দফা। পত্রিকার পাতায়, চায়ের টেবিলে, আদালতের বারান্দায় প্রতিটি মুখে মুখে উজ্জ্বল ঘোষণা—‘‘চলো, চলো, ঢাকা চলো!’’
চূড়ান্ত চ্যালেঞ্জ—বিপ্লবের আগুন
৩৬ জুলাই ইতিহাসের এক অনন্য উদাহরণ, লাখো ছাত্র-জনতা রাজপথ দখলে নেয়! পতাকার সমুদ্র ফেটে উঠে, শহর জুড়ে গর্জে উঠে বাংলার শ্লোগান। পুলিশ-আর্মড ফোর্স একের পর এক ব্যারিকেড গড়ে তুলেও আত্মসমর্পণ করে, কারণ নবীন-প্রবীণের বলিষ্ঠ হাতে, চোখে শ্রাবণ অশ্রু আর অগ্নিশিখায় স্নান করা হৃদয়ে, রক্তের ঝড় কেউ তাদের থামাতে পারেনি।
গণভবন ও সংসদ চত্বর যেন কার্নিভালের মানুষের ঢলে মুখরিত—‘একদম শেষ! আর বাকি নেই কিছু!’ ঢাকা থেকে গ্রাম, শহর থেকে পাড়া—প্রত্যেক রাস্তায় ঝাঁকে ঝাঁকে ধেয়ে যায় বিজয়উল্লাস। রাস্তায় রাস্তায় শুধু মানুষের ঢেউ, মাথা উঁচু করে ঘোষণা—জয় এসেছে, রাজপথ দখল হয়েছে, মুক্তির প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন।
ক্লাইম্যাক্সের মুহূর্ত—হাসিনার পলায়ন, বিজয়ের আর্তনাদ
প্রচণ্ড লজ্জায়, ভয়ে আপ্লুত হয়ে শেখ হাসিনা ও তার বোন রেহানা সামরিক প্রহরায় দুপুরে হেলিকপ্টারে উঠে পালিয়ে যান ভারতের দিকে। ঘোষণা ছড়িয়ে যায়—‘হাসিনা নেই, সরকার নেই’; নগর থেকে মফস্বল, চারদিক মুখর মানুষের উল্লাসে। বিকেল তিনটায় সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশ্যে টেলিভিশনের পর্দায় জানিয়ে দেন—বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হবে, সকল রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন। দেশ ‘স্বৈরশাসন’ থেকে মুক্ত!
এই ঘোষণার পর পুরো দেশ বিজয়ের আনন্দে প্রবাহিত হয়, পটভূমি কাঁপিয়ে খেলে যায় বিজয়ের ঝড়।
লাখো শহীদের রক্তে রাজপথ ধুয়ে যায়, পতাকা উড়তে থাকে নতুন স্বাধীনতার প্রতীকে। মা সন্তান খুঁজে ফেরেন, বাবারা নিথর দেহ বুকে চেপে রাখেন—তবুও ওই কান্নায়ই উচ্চকিত হয় আশার নীরব গান।
সন্ধ্যা ঘরমাঝে মানুষের হাসি আর কান্নায় মিশে যায় বিজয়োল্লাসে—‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট
১০৫ বার পড়া হয়েছে