সর্বশেষ

জাতীয়

“এই শহীদ মিনারে রাষ্ট্র কাঁপে”— গানে, আঁচে, রক্তে ৩৪ জুলাই

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

রবিবার, ৩ আগস্ট, ২০২৫ ৬:১০ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘৩৪ জুলাই’ নামে চিহ্নিত দিন, যখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছায় এবং দেশব্যাপী কলরব তোলে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে।

রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত কৃষিপাড়া, শিল্পনগরী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠশালা—সবখানেই উত্তাল মানুষ, প্রবল স্পর্ধা, এবং রাষ্ট্র-সমাজে নতুন এক গণজোয়ারের জন্ম।


সকাল থেকেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, টিএসসি, শাহবাগে লাখো মানুষের ঢল নামে, যেখানে ছাত্র, যুবক, নারী, শ্রমিক, শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী–সবাই নিজেদের ভাগ্য ও অধিকারের প্রশ্নে একত্রিত হন। একযোগে রাস্তায় নেমে আসে দেশের শীর্ষ ব্যান্ড শিল্পী ও সঙ্গীত ব্যক্তিত্বেরা।


মুক্তিযোদ্ধারা “রাজাকারের বংশ বিতাড়নের” ঘোষণা দেন, রাষ্ট্রের ইতিহাস ও মুক্তির সঙ্গে আন্দোলনের সংযোগ গভীর করে।


দুপুরের পর রাজধানী তথা সর্বত্র শান্তিপূর্ণ জমায়েত চরম উত্তেজনায় রূপ নেয়। দেশের অন্তত ১৫টি জেলায় পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ, সরকারি অফিস, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। শাহবাগ, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, খুলনা, রাজশাহীতে ঘটনা বর্বরতায় মোড় নেয়।

পুলিশের গুলিতে প্রাণহানি ঘটে ৪৩–৯০ জন আন্দোলনকারীর, আহত হয় আরও শতাধিক; একই সঙ্গে পুলিশের মধ্যে ঘটেছে হতাহতের ঘটনা—নৃশংস সংঘর্ষে ঢাকা, সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহসহ কয়েক জেলায় অন্তত ৬ পুলিশ সদস্য নিহত এবং ৪৫-এরও বেশি আহত হয়েছেন। বেশ কিছু এলাকায় আন্দোলনকারীরা প্রতিক্রিয়াস্বরূপ পুলিশ স্টেশন ও দলীয় অফিস ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ পরিচালনা করেন।


দেশজুড়ে সহিংসতার বিস্তার, চলমান অরাজকতা ও হতাহতের জেরে বিকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল কারফিউ ঘোষণার ঘোষণা দেন। সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন—“দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে এবং জান-মালের নিরাপত্তায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ কার্যকর করা হচ্ছে। পুলিশ কোনো সাধারণ মানুষকে হত্যা করেনি, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে বাধ্য হয়েই পুলিশের পক্ষে শক্তি প্রয়োগ হয়েছে।” একইসঙ্গে পুলিশের গুলির দায় অস্বীকার করেন, পুরো ঘটনা তদন্তাধীন বলে জানান।


এদিকে, সেনাবাহিনীর অবস্থান দেশজুড়ে গভীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। রাষ্ট্রীয় ও সামরিক সূত্রে বিশেষ বার্তা প্রকাশিত হয়—“বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কোনোভাবেই আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালাবে না। সেনা সদস্যরা শুধুমাত্র জননিরাপত্তা ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহ রক্ষার নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালন করবে; কোনো রাজনৈতিক সংঘাতে সরাসরি যুক্ত হবে না।”

সাবেক ও প্রস্তাবিত সেনা কর্মকর্তারাও গণমাধ্যমে নিরপেক্ষতার কথা বলেন। ফলে, সর্বাত্মক সহিংসতা ও প্রাণহানির মধ্যে সেনাবাহিনীর এই সিদ্ধান্ত আন্দোলনকারীদের মধ্যে তুলনামূলক স্বস্তি আনে, সরকারও সামরিক পদক্ষেপকে “শেষ বিকল্প” বলে উল্লেখ করে।


প্রবল প্রতিবাদের চাপ ও অস্থির পরিস্থিতিতে বিকালের দিকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গনভবনের দরজা আন্দোলনকারীদের জন্য খুলে দেন, সংঘাত পরিহারে আলোচনার আহ্বান জানান এবং আন্দোলন চলাকালে আটক হওয়া সব ছাত্রের মুক্তির নির্দেশ দেন।

স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় তাৎক্ষণিক ভাবে নির্দেশ পাঠায় পুলিশের কাছে। শহরের একটি অংশে রাতের দিকে পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হলেও, দেশের বহু স্থানে সংঘাত চলতে থাকে।


এই দিনেই বিএনপি আরও এক ধাপ এগিয়ে নৈতিক সমর্থন থেকে আন্দোলনে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়ার ঘোষণা দেয়—মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অফিসিয়ালি দলীয় কর্মীদের মিছিলে যোগদানের আহবান জানান। আওয়ামী লীগও পাল্টা কর্মসূচির মাধ্যমে সব ওয়ার্ড-মহানগরে দলীয় অবস্থান নিশ্চিত করে।


সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ফেসবুক-ইউটিউব বিকাল থেকেই দেশের অধিকাংশ এলাকায় বন্ধ করা হয়, গুজব রোধ ও জনমত নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলে। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টসহ সকল আদালতের কার্যক্রম স্থগিত, প্রশাসনিক কার্যক্রম স্থগিতাদেশ, ব্যাংক ও অফিসে “অসহযোগ” আন্দোলনের ডাক উঠে।


এদিন সাংবাদিক হতাহতের ঘটনার খবরও আসে—পুলিশ-আন্দোলন সংঘর্ষ কভার করতে গিয়ে অন্তত ৬ সাংবাদিক নিহত ও ২৫০ জন আহত হন। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দূতাবাসগুলো ছাত্র হত্যাকাণ্ড ও বলপ্রয়োগের নিন্দা জানায়, “মানবিক তদন্তের” আহবান তোলে।


৩৪ জুলাই ২০২৪ (৩ আগস্ট) মোড়ে মোড়ে একদিকে ভাঙা গাড়ির ধোঁয়া, অন্যদিকে গানের সুর, দলবেঁধে যুক্ত হওয়া মুক্তিযোদ্ধা, বিপ্লবী কবি, শ্রমিক ও প্রগতিশীল নাগরিক—সবাই মিলিত হন “এক দফা, সরকার পতন”–এর দাবিতে।

দেশের রাজনৈতিক ভবিতব্য ঠিক হবে এই উত্তাল দিনটির পরিণতিতে, ইতিহাস নির্মিত হবে তাদের হাতে যারা সেদিন রাস্তায়, কর্মস্থলে, পরিবারে এবং লেখনিতে ছিল নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নে একতাবদ্ধ।

১৩৪ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
জাতীয় নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন