৩৩ জুলাই গণপ্রতিরোধের এক দফা ঘোষণা: উত্তরা ও মিরপুরে সংঘর্ষে রক্তাক্ত রাজপথ

শনিবার, ২ আগস্ট, ২০২৫ ৩:৩২ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাংলাদেশের ইতিহাসের এক বেদনাবহ ও উত্তাল দিন—এই দিনে কোটা সংস্কার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল, আদালত ও জনপদজুড়ে প্রতিরোধ, বিক্ষোভ, সংঘর্ষ এবং গভীর শোকের পরিবেশ তৈরি হয়।
সকালে টিএসসি, শহীদ মিনার, প্রেস ক্লাব, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, প্রধান আদালত ও নানা নগরকেন্দ্রিক স্থানে হাজার হাজার ছাত্র, শিক্ষক, নাগরিক, অভিভাবক ও সংহতি জানানো মানবাধিকার কর্মী “Remembering Our Heroes” কর্মসূচিতে মৌন প্রতিবাদ, শোকানুষ্ঠান, মোমবাতি প্রজ্বলন ও প্ল্যাকার্ড হাতে নীরবতা পালন করেন।
দেশের শীর্ষ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়—নর্থ সাউথ, আইইউবি, ব্র্যাক, এআইইউবি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও শোভাযাত্রা করেন। অভিভাবক ও শিক্ষকরা তাঁদের পাশে দাঁড়ান; মানবাধিকার আইনজীবী ও সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও টিএসসি, প্রেস ক্লাব, সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণসহ জেলা শহরে আন্দোলনের সঙ্গে প্রকাশ্যে যুক্ত হন, নিখোঁজ-নিহত পরিবারকে সান্ত্বনা দেন এবং আইনি সহায়তার ঘোষণা দেন। আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরাও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন।
শুক্রবার জুমার নামাজের পর হাজারো মুসল্লি ও ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে বৃহৎ গণমিছিল বের হয়, যা পল্টন, হাইকোর্ট, শাহবাগ, সায়েন্সল্যাব, উত্তরার দিকে অগ্রসর হয়; শান্তিপূর্ণ শোক, প্রতিবাদ, ন্যায়বিচারের আহ্বানে শহীদদের স্মরণ করা হয়। রাজধানীর শাহবাগ, টিএসসি, বনানী, মিরপুর, ফার্মগেট, ধানমন্ডি, বাড্ডা, কুরিল-বসুন্ধরা, মালিবাগসহ দেশের বড় শহরজুড়ে “গণমিছিল” ও “দ্রোহ যাত্রা” হয়, যেখানে “এক দফা—সরকার পদত্যাগ” দাবিটি মুখ্য হয়ে ওঠে। ছাত্ররা প্রতিবাদী চিহ্ন হিসেবে পুলিশের এপিসির গ্লাস ও গায় স্প্রে পেইন্ট করেন—“বিচার চাই”, “গণহত্যা বন্ধ করো” লিখে রাজপথে প্রতিবাদের প্রতীকী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন; পুলিশ শান্ত আচরণ ধরে রাখে।
দুপুর ও বিকেলের দিকে উত্তরা, মিরপুর, মালিবাগ, আজমপুর শহরতলি-উপশহরগুলোতে পুলিশসহ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরাও সংঘর্ষে জড়ায়; উত্তরা-আজমপুরে এক ছাত্র (মাহিম) ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা নিহত হন, মিরপুর-১০ অঞ্চলে পুলিশের উপস্থিতিতে দলীয় ক্যাডাররা আন্দোলনকারীদের উপর গুলি, লাঠিচার্জ, নির্মম নির্যাতন চালান; অন্তত দুইজন নিহত, বহু আহত হন—অনেক নারী শিক্ষার্থীও আক্রান্ত হন। সন্ধ্যার পর এসব এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ বাড়ে, রাস্তাঘাট ফাঁকা পড়ে, ভারী অস্ত্র সামরিক যান মোতায়েন করা হয়।
এই দিনই খুলনায় গণঅভ্যুত্থানের সময় পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের কনস্টেবল সুমন ঘোষ নিহত হন, আরও ২০-২৫ পুলিশ-ছাত্র-নাগরিক আহত হন। ঘটনাটি গল্লামারী মোড়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, জিরোপয়েন্ট এলাকায় ঘটে; বিরাট উত্তেজনা ও শতাধিক গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে জেলার পরিস্থিতি বিপজ্জনক আকার নেয়—এটাই চলমান অভ্যুত্থানে পুলিশের প্রথম মৃত্যু।
বিকালে ঢাকার টিএসসি, শহীদ মিনার সংলগ্ন এলাকায় ‘সব রফার হয় দফা / যদি বানাও এক দফা’—এই শ্লোগান ছড়িয়ে পড়ে। রাতের গণসমাবেশ ও সংবাদ সম্মেলন থেকে ছাত্র-নাগরিক ঐক্যবদ্ধভাবে ঘোষণা দেয়—আর নয় বহু দফা, এবার এক দফা: “শেখ হাসিনার পদত্যাগ”; পরবর্তী ৩ আগস্ট সারাদেশে গণবিক্ষোভ এবং ৪ আগস্ট থেকে অসহযোগ ও দেশজুড়ে কর্মবিরতির ঘোষণা দেওয়া হয়।
এদিন “গণহত্যা ও নিপীড়িত বিরোধী শিল্পী সমাজ”-এর আহ্বানে আজমেরী হক বাঁধন, মোশাররফ করিম, পরিচালক আকরাম খানসহ নাটক–সিনেমা–সংগীত–চারুকলা–সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বহু মুখ ফার্মগেট, টিএসসি এলাকায় সুস্পষ্ট অবস্থানে দাঁড়ান—‘শিক্ষার্থীর রক্ত আর না’, ‘গণহত্যা-নিপীড়নের বিরুদ্ধে শিল্পী সমাজ’ স্লোগানে অবস্থান নিয়ে ন্যায়বিচারের পক্ষে বার্তা দেন।
রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়ায় দিনজুড়ে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনগুলো ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষ্যে মাসব্যাপী কর্মসূচি সর্বত্র পালনে নির্দেশ দেয়, টিভি-রেডিও-সামাজিক মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্মরণ বার্তা ছড়িয়ে পড়ে। তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক সামাজিক মাধ্যমে তরুণ, পরিবার, শিক্ষার্থীদের কাছে প্রকাশ্য দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা প্রার্থনা করেন—সামাজিক মাধ্যমে তা আলোচনার ঝড় তোলে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবৃতিতে বলেন, সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের দিয়ে শান্তিপূর্ণ মিছিল, শহীদ স্মরণ কর্মসূচিতে হামলা চালাচ্ছে; গণতান্ত্রিক অধিকার দমন করতে “স্বৈরশাসকবিরোধী ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ” গড়ে তুলতে দেশের ছাত্র, শিক্ষক, পেশাজীবী, নাগরিক, শ্রমিক, ধর্মীয়, সংখ্যালঘু ও তৃতীয় লিঙ্গসহ সকলকে পথে নামার আহ্বান জানান।
রাতের দিকে কেন্দ্রীয় চুক্তিতে সিদ্ধান্ত হয়—পরদিন দেশজুড়ে গণবিক্ষোভ, এরপরদিন থেকে অসহযোগ-অবরোধ; আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থা জাতিসংঘ—হেলিকপ্টার গুলি, কারফিউ, গ্রেপ্তার, মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে উদ্বেগ জানায়।
২৪ ঘণ্টার বিস্তৃত উত্তেজনা ও সংঘর্ষ–শোকের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থান ও রাষ্ট্র-দমন-ইতিহাসে ২ আগস্ট ২০২৪ (৩৩ জুলাই) হয়ে ওঠে নির্ধারক দিন—অনির্দিষ্টকালের জন্য আন্দোলনের দায় ও শোক, পুলিশের প্রথম মৃত্যু, শিল্প-মানবাধিকার-জাগরণ, নতুন নেতৃত্ব ও প্রত্যয়ের ইতিহাস।
১১৭ বার পড়া হয়েছে