বাংলাদেশ সামলায়, ভারত চাপে, পাকিস্তান সুবিধায়—মার্কিন ট্যারিফে দক্ষিণ এশিয়ার রূপরেখা

শুক্রবার, ১ আগস্ট, ২০২৫ ৭:৩১ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
২০২৫ সালের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর ২০% শুল্ক কঠোরভাবে কার্যকর করেছে। অতীতে তুলনামূলকভাবে কম শুল্ক সুবিধায় মার্কিন বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ছিল বাংলাদেশের।
তবে নানা আন্তর্জাতিক চাপ ও দীর্ঘ আলোচনার পর বর্তমান কঠিন হার এখন দেশের রপ্তানি ও অর্থনীতির জন্য উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
অতীতের অনুকূল পরিবেশ
২০১৭ সালের আগে, বিশেষত ট্রাম্প প্রশাসনের আগপর্যন্ত, বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের গড় শুল্ক ছিল ১৫%–১৮%। কিছু পণ্যে অবশ্য ৩০%–৩২% পর্যন্ত শুল্ক ছিল, তবে তা ছিল সীমিত ও নির্দিষ্ট। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, চামড়া ও কৃষিপণ্য ছিল সবচেয়ে রপ্তানিনির্ভর খাত, এবং এই পণ্যগুলো যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করত অপেক্ষাকৃত কম শুল্কে। তৎকালীন নীতিমালায় কোনো রেসিপ্রোকাল বা জরুরি শুল্ক ছিল না; ফলে মার্কিন বাজার বাংলাদেশের জন্য আত্মবিশ্বাসের জায়গা ছিল।
বর্তমান বাস্তবতা: প্রতিযোগিতার মধ্যেও চাপে বাংলাদেশ
২০২৫ সালের আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর ২০% শুল্ক চূড়ান্তভাবে কার্যকর করেছে। শুরুর প্রস্তাব ছিল ৩৫% পর্যন্ত শুল্ক আরোপ, যা শেষ পর্যন্ত কৌশলগত কূটনীতির মাধ্যমে নেমে এসেছে ২০%-এ। এটি তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ সমঝোতা হলেও, আগের ১৫–১৮% হার থেকে ২–৫% পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান বাস্তবতায়, ভারতের ওপর শুল্ক ২৫%, শ্রীলঙ্কা ২০%, আর পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ১৯% নির্ধারিত হয়েছে—যার ফলে বাংলাদেশ এখনো মাঝামাঝি প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে রয়েছে।
সুবিধাসমূহ: গভীর পতনের হাত থেকে রক্ষা
এই সমঝোতার ফলে বাংলাদেশ তীব্র ৩৫%-এর শুল্ক এড়াতে পেরেছে, যা হলে বড় বাজার হারানোর শঙ্কা থাকত। পাকিস্তানের পরে বাংলাদেশের শুল্ক দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। এতে মার্কিন বাজারে অবস্থান ধরে রাখা এবং বড় ক্রেতাদের আস্থা বজায় রাখার একটা ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। বোয়িং বিমান চুক্তি, গম–সয়াবিন আমদানির মতো বিশাল অর্থনীতি–কূটনীতির টানাপোড়েনেও বাংলাদেশ স্বতঃস্ফূর্ত ছিল, যা সার্বিক ক্ষেত্রে কাজে দিয়েছে।
অসুবিধাসমূহ: লাভের মার্জিন সংকোচন ও বাজার হারানোর আশঙ্কা
২০% শুল্ক মানেই আগে থেকে বেশি ব্যয়। এতে তৈরি পোশাকের একক মূল্যে উৎপাদন খরচ বাড়বে, লাভ কমবে এবং অনেক কারখানায় উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে শ্রমবাজার ও কর্মসংস্থানে। তাছাড়া, কেম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া বা ভিয়েতনাম—যাদের কোথাও কোথাও ১৯%-এর মতো শুল্কের সুবিধা আছে—তারা যদি প্রযুক্তি ও সক্ষমতায় বাংলাদেশকে ছাপিয়ে যায়, তাহলে মার্কিন ব্র্যান্ডগুলো সেদিকে ঝুঁকবে।
প্রতিযোগীদের তুলনায় বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়িয়ে
পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে, কারণ তাদের ওপর মাত্র ১৯% শুল্ক আরোপিত হয়েছে—যা একটি সফল কূটনৈতিক সমঝোতা ও তেল চুক্তির ফল। ভারত সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ, কারণ ২৫% হারে শুল্ক চাপানো হয়েছে এবং তারা মার্কিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু কৌশলগত দাবি মেনে চলতে পারেনি। বাংলাদেশ এই দুই চরম অবস্থার মাঝামাঝি—ঝুঁকি ও সম্ভাবনার দ্বৈত ভারসাম্যে এগোচ্ছে।
ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি: পথ কঠিন, তবে অসম্ভব নয়
চূড়ান্ত চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে থাকছে উৎপাদন খরচ কমানো, দক্ষতা বৃদ্ধি, প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো এবং নতুন রপ্তানি বাজার খোঁজা। মার্কিন বাজারে তো টিকে থাকতেই হবে, অথচ একে একমাত্র ভরসা না রেখে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য বা আফ্রিকা–মুখী রপ্তানিকে জোর দিতে হবে। কূটনীতির পাশাপাশি ব্যবসা পরিবেশ এবং শ্রম দক্ষতা—এই তিনটি ফ্যাক্টর ঠিকমতো সমন্বয় করে এগোতে পারলে বাংলাদেশ এখনও বিশ্ববাজারে প্রতিযোগীর আসনে টিকে থাকতে পারবে।
শেষ কথা
বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের ২০% শুল্কে আংশিক সুরক্ষা পেলেও এখনো বড় চ্যালেঞ্জের মুখে। লাভের মার্জিন কমে যাওয়ায় রপ্তানি খাত চাপে রয়েছে, আর প্রতিযোগী দেশগুলো (পাকিস্তান, কেম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া) তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে। বাজার বৈচিত্র্য, প্রযুক্তি উন্নয়ন ও উৎপাদন দক্ষতায় দ্রুত অগ্রগতি না ঘটলে বাংলাদেশের অন্য দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য রপ্তানিনির্ভর ভবিষ্যৎ টিকিয়ে রাখতে এখনই কৌশলগত পদক্ষেপ জরুরি।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট
১৭৭ বার পড়া হয়েছে