জাতীয়

৩১ জুলাই ২০২৪

বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি বিস্তৃত, নির্ভুল ও সময়ানুগ দিন 'March for Justice'

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

বৃহস্পতিবার , ৩১ জুলাই, ২০২৫ ৯:২৯ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
৩১ জুলাই ২০২৪ বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার ‘গণঅভ্যুত্থান’ নামে ইতিহাসে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়।

এই দিনে “March for Justice”—বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাক, অন্যমাত্রায় সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং দিনভর প্রতিটি মুহূর্ত বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবিকতা ও প্রতিরোধ-আকাঙ্ক্ষার নিখুঁত নমুনা হয়ে ওঠে।

 

সকাল শুরু হয় দেশজুড়ে আদালত, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, জেলাশহর, কলেজ ও প্রধান মোড়ে মোড়ে ছড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থী, শিক্ষক, নাগরিক—সবার লাল ফিতা ও ব্যানার হাতে নিরব অবস্থানে। “ন্যায়বিচার চাই”, “বিচারহীন শোক নয়”—প্রতিটি পোস্টার, মৌনতার শৃঙ্খলা, ব্যানার ও কালো ব্যাজের মাঝ দিয়ে শোকের সঙ্গে জনতার প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধের প্রকাশ ঘটে।

 

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট মহিলা কলেজসহ শ’খানেক প্রতিষ্ঠান একযোগে ‘কোর্ট পয়েন্ট’ থেকে মিছিল শুরু করে; রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বরিশাল, ময়মনসিংহ—সব জায়গায় স্কুল-কলেজ, শহীদ মিনারে প্ল্যাকার্ড হাতে মানববন্ধন হয় এবং অনেকে মুখে লাল কাপড় বাঁধেন।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, নটরডেম কলেজ, রাজধানীর প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা বেলা ১১টার পর থেকে হাইকোর্টের দিকে মিছিল শুরু করেন। শহরের শিশুপার্ক, শাহবাগ ও নিউমার্কেট এলাকায় পুলিশের কড়া উপস্থিতি ও লাঠিপেটা, তল্লাশি এবং সন্দেহভাজনদের আটক দেখা যায়। ‘হোয়াইট প্যানেল’ এবং প্রগতিশীল শিক্ষকরা ঢাবি ক্যাম্পাসে নীরব শোক মিছিলে অংশ নেন। বিকেল ৩টার পর সামাজিক মাধ্যমে দীর্ঘ ব্লকেডের অবসান ঘটে — ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম খুলে দেওয়া হয়, ফলে গণসচেতনতা দ্রুত ছড়াতে শুরু করে এবং সবার প্রোফাইল লাল ও কালো হয়ে যায়: লাল শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিচার, কালো সরকারপন্থী শোকের প্রতীক।

 

৩১ জুলাই ২০২৪, বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ধারাবাহিক দমন ও সহিংসতার পর সরকারের দেওয়া অফিসিয়াল পরিসংখ্যানে নিহতের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৪৫ থেকে ২০০-এর মধ্যে। একইসঙ্গে, ইউনিসেফ জানায় পুরো জুলাই মাসে অন্তত ৩২ শিশুর মৃত্যু হয়েছে।

 

চট্টগ্রাম কোর্ট এলাকা, কুমিল্লা, টাঙ্গাইল, খুলনা, রংপুরের জেলা শহরে দুপুর থেকে আইনজীবী, সাধারণ মানুষ, শিক্ষার্থী একত্রে অবস্থান কর্মসূচিতে যোগ দেন; বিএনপি-সমর্থক আইনজীবী পড়ন্ত বিকেলে অনেকে শিক্ষার্থীদের পাশে যোগ দেন এবং আওয়ামী লীগ-সমর্থক আইনজীবীরা পাল্টা মিছিল করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মহাসড়ক অবরোধে ৫ জন শিক্ষার্থী আটক হন; ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অংশে পুলিশ-ডিবির হাতে নতুন করে আরও শিক্ষার্থী ও জনতা গ্রেফতার হন। বিকেলে মোমবাতি প্রজ্বলন, কফিন মিছিল, শহীদদের স্মরণে গায়েবানা জানাজা চলে ঢাকা, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা, ময়মনসিংহসহ দেশের নানা প্রান্তে। শিক্ষকরা “Anti-Repression Rally” করেন, ৯ দফা দাবিতে শপথ নেন এবং মানববন্ধন করেন।

 

উল্লেখযোগ্যভাবে, এই দিন ৭৪ জন বিশিষ্ট নাগরিক, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী ও অর্থনীতিবিদ সম্মিলিতভাবে “গণতদন্ত কমিশন” গড়ে আন্তর্জাতিক তদারকিতে রাষ্ট্রীয় হত্যা, নিখোঁজ ও নির্যাতনের নিরপেক্ষ বিচার দাবিতে জনগণের সমর্থনের আহ্বান জানান এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে তদন্ত চেয়ে বিবৃতি দেন। বিকেলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের সঙ্গে চলমান পার্টনারশিপ আলোচনার অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিতের ঘোষণা দেয়—শুট অ্যাট সাইট, সহিংসতা, গণহত্যার ঘটনায় উদ্বেগ জানায়। জাতিসংঘ এবং অ্যামনেস্টি, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা একই দিন সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন, মিথ্যাচার, তথ্য-ব্লকড প্রমুখ বিষয়ে প্রতিবাদ জানায়।

 

দিনশেষে এইচএসসি কার্যক্রমে নয়া মোড় নেয়—শতাধিক কলেজ ও স্কুলের পরীক্ষার্থী ঘোষণা দেয়, “কারাগারে/হেফাজতে থাকা সহপাঠীরা মুক্ত না হলে কেউ পরীক্ষা দেবে না।” রাতভর নানা ক্যাম্পাস, গ্রামে গ্রামে শহীদদের জন্য শোকসভা, মোমবাতি, গণজানাজা ও মানববন্ধন চলে; শহীদ পরিবারের সদস্যদের আহাজারি, নাগরিক সমাজ ও অধ্যাপকদের কণ্ঠে বিচারের জোর দাবি ওঠে।

 

রাজনীতিতে, সরকার ও প্রশাসন “জাতীয় শোক দিবস” উদযাপনে ব্যস্ত থাকলেও, প্রধানমন্ত্রী গনভবনেই দিনের সব বৈঠক করেন, কোথাও প্রকাশ্য সংবেদনশীলতা বা নিহতদের স্বজনদের সান্ত্বনা দিতে যাননি। বিটিভি-সহ একাধিক টিভি চ্যানেল ও বহু সরকারি গণমাধ্যমে সরকারি ভাষ্য, আন্দোলনের বিভাজন ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচার জোরদার হয়।

 

সবশেষে, আন্দোলনকারীরা ঘোষণা দেন—জুলাই ৩১-এ শুধু মাস শেষ হবে না; ন্যায়বিচার না পাওয়া পর্যন্ত “৩২, ৩৩, ৩৪, ৩৫, ৩৬ জুলাই”-এর মতো দিনপঞ্জি চলবে। এই দিনটিতে বাস্তব রাস্তায়, ডিজিটাল অ্যাক্টিভিজমে, সামাজিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে—সবখানেই বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও ছাত্র-জনতার ন্যায়বিচারের অভিপ্রায় স্পষ্ট হয়। ৩১ জুলাই ২০২৪—তাই শুধুই একদিন নয়, বিজ্ঞান, মানবিক শিক্ষা আর আন্দোলনের অনন্য সম্মিলিত শক্তি-প্রতীক।

১৫৮ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
জাতীয় নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন