জুলাই বিদ্রোহের পরিণতি: জাতিসংঘের তদন্ত ও মানবাধিকারের নবযাত্রা

বুধবার, ৩০ জুলাই, ২০২৫ ৫:৩২ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের রাজপথে যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠেছিল, তা ছিল নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক জাতিগত আত্মপ্রতিরোধ, একটি সম্মিলিত মানবিক চেতনার বিস্ফোরণ।
দীর্ঘদিন ধরে অকার্যকর গণতন্ত্র, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম-খুনের সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের অপপ্রয়োগে দমবন্ধ অবস্থায় থাকা একটি জাতি সেদিন রাস্তায় নেমে এসেছিল তার অস্তিত্ব রক্ষার দাবিতে। আর ঠিক এক বছর পর, ২০২৫ সালের ২৯ জুলাই, জাতিসংঘ প্রকাশিত একটি ঐতিহাসিক মানবাধিকার তদন্ত প্রতিবেদন সেই বিদ্রোহের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থনের ভিত্তি স্থাপন করে। এই প্রতিবেদন এবং তৎপরবর্তীকালে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণ বাংলাদেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ইতিহাসে একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে চিহ্নিত হয়।
একবিংশ শতাব্দীর একটি নির্মম জুলাই-২০২৪ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশের প্রধান নগরগুলোতে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নামে। তরুণদের নেতৃত্বে সংগঠিত এই বিদ্রোহ ছিল মূলতঃ রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে এবং একটি সুশাসনভিত্তিক গণতন্ত্রের দাবিতে আত্মপ্রকাশ। আন্দোলনের পেছনে ছিল দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা ক্ষোভ, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, নির্বাচনের নামে প্রহসন এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের দলীয় করণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ। মানবাধিকার সংগঠন “অধিকার”, “হিউম্যান রাইটস ওয়াচ” (HRW), “অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল” ইতোমধ্যেই এই সময়কালে অসংখ্য নিপীড়নমূলক ঘটনার প্রাথমিক ডকুমেন্টেশন করে। কিন্তু যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের (OHCHR) একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন, যা আন্দোলনের এক বছর পরে আন্তর্জাতিক স্তরে উপস্থাপিত হয় এবং যেটি বাংলাদেশে ন্যায়বিচার ও মানবিক রাষ্ট্র গঠনের একটি মৌলিক দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে।
জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন: একটি নিরপেক্ষ দলিল:
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত জাতিসংঘের OHCHR-এর রিপোর্টে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয় ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ঘটে যাওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা দিক। প্রতিবেদনে বলা হয়: প্রায় ১৪০০ জন মানুষ নিহত হয়েছে এই সময়কালে, যাদের অধিকাংশই ছিল শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারী। হাজার হাজার মানুষ গুম ও আটক হয়েছে, যার বেশিরভাগই বিনা পরোয়ানায় এবং বিনা বিচারে। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় যে এই সহিংসতা ছিল “centrally coordinated, policy-driven, and systematically executed”। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের পরিপ্রেক্ষিতে এটি “crimes against humanity” অর্থাৎ মানবতা-বিরোধী অপরাধের পরিসরে পড়ে।
OHCHR Report on Bangladesh, 2025 প্রতিবেদনের একাংশে বলা হয়:
"The evidence strongly suggests a premeditated use of state apparatus to suppress dissent, intimidate civilians, and eliminate opposition through lethal force and unlawful detention."
এই প্রতিবেদনে বিশেষভাবে জোর দেয়া হয় যে এ ধরনের অপরাধ বিচারের আওতায় না আনলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা ও দমন-পীড়নের চক্র কখনো বন্ধ হবে না। আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও মিডিয়ার ভূমিকায় বাস্তবতা উন্মোচন-এই ঘটনার পরপরই বিবিসি, আল জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ান, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, দ্য ইকোনমিস্ট ইত্যাদি প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম একের পর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এসব প্রতিবেদনে উঠে আসে- রাজপথে সেনা ও পুলিশের যৌথ অভিযানে বেছে বেছে তরুণদের হত্যা, সামাজিক মাধ্যমে সরকারবিরোধী পোস্ট দেয়ার কারণে লোকজনকে নির্যাতন, হাসপাতালগুলোতে গুলি ও নির্যাতনের শিকার তরুণদের চিকিৎসা দিতে বাধা প্রদান।
এ ধরনের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে বলেন:
"The suppression of fundamental freedoms in Bangladesh cannot be ignored. Justice must prevail for those who suffered and died defending their democratic rights."
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অগ্রগতি ও মানবাধিকার সংস্কার-জাতিসংঘের অনুরোধে ২০২৪ সালের আগস্টে গঠিত হয় একটি জাতীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার প্রধান উপদেষ্টা হন নোবেল বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি রাষ্ট্রের মানবাধিকার কাঠামো সংস্কারে নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন:
1. জোরপূর্বক গুম প্রতিরোধ বিষয়ক আন্তর্জাতিক কনভেনশনে বাংলাদেশের স্বাক্ষর।
2. বিশেষ মানবাধিকার কমিশন আইন-২০২৫ প্রণয়ন, যার মাধ্যমে স্বাধীনভাবে তদন্ত চালানোর ক্ষমতা দেওয়া হয়।
3. Truth and Accountability Commission গঠন, যেটি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের আদলে গঠিত হয়ে ২০২৪ সালের দমনপীড়নের ঘটনার বিচার শুরু করে।
4. MOU স্বাক্ষর OHCHR-এর সাথে, যেন ভবিষ্যতে জাতিসংঘ সরাসরি পর্যবেক্ষণ করতে পারে।
5. বিচারবহির্ভূত হত্যার বিরুদ্ধে একটি স্বাধীন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ মিশন অনুমোদন।
প্রফেসর ইউনূস বলেন: "আমরা বিচার করবো শুধুমাত্র প্রতিশোধের জন্য নয়, বরং যেন ভবিষ্যতে কেউ আর এই অপরাধ করতে সাহস না পায়। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রকে দাঁড় করানো।"
বিচার নয়, গণতন্ত্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থার পুনঃগঠন,এই সংস্কার ও বিচার প্রক্রিয়ার অন্যতম প্রধান দিক হচ্ছে একটি টেকসই গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তোলা। শুধুমাত্র অপরাধীদের শাস্তি নয়, বরং: নির্বাচনী কমিশনের পূর্ণ স্বাধীনতা,প্রশাসন ও পুলিশে দলীয় প্রভাবমুক্ত নিয়োগ,নাগরিক সমাজ ও মিডিয়ার মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা,সাইবার নিরাপত্তা আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংস্কার, এইসব পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে একটি Inclusive Democracy প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে, যেখানে বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজ নীতিনির্ধারণে অংশগ্রহণ করতে পারে।
শহীদদের স্মরণ ও জাতির ভবিষ্যৎ স্বপ্ন-প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের সবচেয়ে হৃদয়গ্রাহী অংশ ছিল জুলাই বিদ্রোহের শহীদদের স্মরণে উৎসর্গকৃত অংশ:
"They died not for a party or a slogan, but for the right to live in dignity, to vote freely, and to speak without fear." এই কথাগুলো শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং একটি জাতির নৈতিক আত্ম-পরিচয়ের প্রতিচ্ছবি। এটি সেই “নতুন বাংলাদেশ”-এর প্রতিশ্রুতি, যেখানে: আইনের শাসন থাকবে,মানবিক মর্যাদা সুরক্ষিত হবে,রাষ্ট্রীয় শক্তি হবে জনগণের সেবক, শত্রু নয়।
জাতিসংঘের ভূমিকা:
সহানুভূতি নয়, সাথী হিসেবে অংশগ্রহণ-জাতিসংঘ কেবল সমালোচনা করেনি, বরং অংশগ্রহণ করেছে সক্রিয়ভাবে। তাদের মানবাধিকার সহায়ক মিশন, ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং টিম এবং মানবাধিকার উপদেষ্টাদের মাধ্যমে বাংলাদেশে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। গুইন লুইস, ভলকার টার্ক ও হুমা খানের মত ব্যক্তিত্বেরা বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলে ধরেছেন দৃঢ়ভাবে। বিশ্ব মানবাধিকার আন্দোলনের অন্যতম নীতিকথা হলো: "Justice delayed is justice denied, but justice denied publicly becomes a warning for all."
জাতিসংঘ নিশ্চিত করেছে যেন সেই ন্যায়বিচার আর গোপনে না থাকে। এক নৈতিক পুনর্জাগরণের গল্প-জুলাই বিদ্রোহ এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রতিবেদন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কেবল একটি আন্দোলন বা প্রতিবাদ নয়—এটি একটি নৈতিক জাগরণ, যা রাজনীতির চেয়ে অধিকতর গভীর। এটি রাষ্ট্রকে তার দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, জনগণকে তাদের ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে, এবং বিশ্বকে দেখিয়েছে, একটি উন্নয়নশীল দেশও আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মানদণ্ডে দাঁড়াতে পারে।
আমরা এক বছর পেছনে তাকিয়ে দেখি—একটি স্বৈরাচার পতিত হয়েছে, একটি প্রতিবাদ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে, এবং একটি জাতি তার নৈতিক ভিত্তি নতুন করে নির্মাণ করতে শুরু করেছে। এই যাত্রা শেষ হয়নি, তবে শুরু হয়েছে। নতুন বাংলাদেশ গঠনের এই অভিযাত্রায় যেখানে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং জবাবদিহির মেলবন্ধন ঘটেছে, সেখানে আমাদের প্রত্যয় একটাই—এই বার্তা যেন চিরকাল থেকে যায়:
“রাষ্ট্র জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের হয়ে।”
লেখকঃ সম্পাদক, দৈনিক কালের কথা।
৩৮৯ বার পড়া হয়েছে