মতামত

জামায়াতের মহাসমাবেশে শৃঙ্খলা ও জনস্রোত: পিয়ার পদ্ধতিতে নির্বাচনের আহ্বান

খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী
খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী

সোমবার, ২৮ জুলাই, ২০২৫ ২:২৮ অপরাহ্ন

শেয়ার করুন:
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম AP এবং Al Jazeera র মন্তব্য দিয়ে আজকের লেখার সূচনা করি-
“Hundreds of thousands of supporters of Bangladesh’s Jamaat‑e‑Islami took part in a historic rally at Suhrawardy Udyan on 19 July 2025, demanding sweeping electoral reforms, justice for mass killings, and the adoption of a proportional representation system ahead of the planned national election.”

২০২৫ সালের ১৯ জুলাই, বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় মহাসমাবেশ ছিল নিছক একটি দলীয় প্রদর্শনী নয়, বরং এটি ছিল আদর্শ, ন্যায়, শৃঙ্খলা এবং ভবিষ্যত গঠনের এক বিস্তৃত কর্মসূচি। যেখানে উঠে এসেছে আগামী দিনের নির্বাচন পদ্ধতি, রাজনৈতিক সংস্কার, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান এবং দেশের ভবিষ্যৎ গঠনে একটি স্পষ্ট রূপরেখা। আমি ব্যক্তিগত ভাবে মহাসমাবেশে উপস্থিত থেকে যা দেখেছি, অবলোকন করেছি ও উপলব্ধি করেছি, তার সারসংক্ষেপ নিচে তথ্যভিত্তিকভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করছি:

 

১. পিয়ার পদ্ধতিতে’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জোর দাবি: মহাসমাবেশের অন্যতম কেন্দ্রীয় দাবি ছিল, “পিয়ার পদ্ধতি” অনুসারে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে হবে। ‘PEER’ (Participatory, Equitable, Ethical, Responsible) পদ্ধতির মূল বৈশিষ্ট্য হলো—সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত, সমান সুযোগ ও প্রচার, নৈতিকতা-ভিত্তিক প্রক্রিয়া এবং দায়বদ্ধতা। অধ্যাপক মুজিবুর রহমান তার বক্তৃতায় স্পষ্টভাবে বলেন:একদলীয় প্রহসনের নির্বাচন নয়, আমরা চাই পিয়ার পদ্ধতিতে জনগণের সম্মতিতে একটি গ্রহণযোগ্য সরকার গঠিত হোক। এই দাবি শুধু জামায়াতের স্বার্থ নয়, বরং সমগ্র জাতির স্বার্থে একটি অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ ও ন্যায়নিষ্ঠ নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি আহ্বান।

 

২. জুলাই সনদ' ঘোষণার দাবি: একটি রাজনৈতিক চুক্তির রূপরেখা-সমাবেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দাবী ছিল 'জুলাই সনদ'—যা একটি প্রতীকী রাজনৈতিক চুক্তিপত্রের মতো উপস্থাপন করা হয়। নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি, রাজনৈতিক দলগুলোর উপর দমন-পীড়নের অবসান, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার, নৈতিক নেতৃত্বের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার রূপরেখা। প্রস্তাবনায় বলা হয় ‘জুলাই সনদ’ আদতে একটি জনআকাঙ্ক্ষা ভিত্তিক রাজনৈতিক ম্যাগনা কার্টা, যা প্রতিশ্রুতি দিবে – “ভবিষ্যতের বাংলাদেশ হবে দুর্নীতিমুক্ত, ন্যায়-ইনসাফ ভিত্তিক ও অংশগ্রহণমূলক।”

 

৩. দখলবাজ ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা: এই মহাসমাবেশে স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যারা দখলবাজি ও চাঁদাবাজির রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হলো। রাজনৈতিক অঙ্গনে যে অপশক্তি ‘বুলেট বনাম ব্যালট’ ধারণাকে কাজে লাগিয়ে জনগণকে জিম্মি করে রেখেছে, জামায়াত তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে—এই বার্তা সমাবেশে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। বক্তারা বলেন: রাজনীতি হতে হবে সেবামূলক, ক্ষমতা নয় বরং আদর্শই হোক নেতৃত্বের ভিত্তি। আমরা দেশকে চাঁদাবাজদের করালগ্রাস থেকে মুক্ত করবো ইনশাআল্লাহ।

 

৪. দুর্নীতি ও অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান: সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে দুর্নীতির পরিমাণ যে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে—তা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্টেও উঠে এসেছে। জামায়াতের সমাবেশে নেতারা বলেন: দুর্নীতি এখন শাসকের রক্তে মিশে গেছে। বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে আগে দুর্নীতিকে হারাতে হবে। এই বক্তব্যের মাধ্যমে জামায়াত একটি “নীতির বিপ্লব” এর সূচনা করতে চায়—যেখানে দুর্নীতি, ঘুষ, আত্মসাৎ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে।

 

৫. শৃঙ্খলার এক বিরল দৃষ্টান্ত : লাখো মানুষের উপস্থিতি, অথচ কোনো বিশৃঙ্খলা নেই! না কোনো হট্টগোল, না কোনো পুলিশি লাঠিপেটা। বরং মানুষের মধ্যে ছিলো এক নিখুঁত শৃঙ্খলা, সহনশীলতা, এবং সাংগঠনিকভাবে সুপরিকল্পিত আচরণ। বিশেষতঃ প্রতিটি জেলার অংশগ্রহণকারীরা নিজ নিজ ব্যানারে, চিহ্নিত জায়গায়, নির্দিষ্ট নেতৃত্বের অধীনে মিছিল করে আসা—যা প্রমাণ করে, জামায়াত কেবল একটি রাজনৈতিক দল নয়; বরং এটি একটি আদর্শভিত্তিক জনগণনির্ভর সংগঠন।

 

৬. নেতৃত্বের বুদ্ধিবৃত্তিক ভারসাম্য : আমিরে জামাত সহ এটিএম আজহারুল ইসলাম, অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, মিয়া গোলাম পরোয়ার, ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ, হামিদুর রহমান আজাদ প্রমুখ নেতাদের বক্তব্যে ছিল না কোনো আগুনঝরা কট্টরবাদ, বরং যুক্তি, পরিসংখ্যান, কোরআন-সুন্নাহ এবং আন্তর্জাতিক উদাহরণ।
যা প্রমাণ করে—এই নেতৃত্ব ধ্বংস নয়, বরং নির্মাণে বিশ্বাসী। তারা সংঘাত নয়, সংলাপকে পথ হিসেবে গ্রহণ করছে।

 

৭. মিডিয়ার নীরবতা বনাম জনমাধ্যমের বিস্ফোরণ: জাতীয় টিভি ও পত্রপত্রিকাগুলোর একটি বড় অংশ এই বিশাল সমাবেশকে ‘না দেখার’ রাজনীতিতে লিপ্ত ছিল।
তবে ইউটিউব, ফেসবুক ও ব্যক্তিগত সংবাদমাধ্যমগুলোতে সমাবেশ লাইভ সম্প্রচারে মিলেছে কোটি ভিউয়ার্স। গণমাধ্যমে অবরুদ্ধ হলেও, জনগণের হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়া—এটাই জামায়াতের বিজয়ের প্রথম ধাপ।

 

৮. তরুণদের সাড়া: আদর্শের আলোর নতুন বাহক-সমাবেশে লক্ষ করা গেছে অসংখ্য তরুণ—বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, মাদ্রাসা শিক্ষার্থী, তরুণ পেশাজীবী, নারী কর্মী—যারা ব্যানার হাতে, হ্যাশট্যাগ নিয়ে, ক্যামেরা ঝুলিয়ে অংশ নিচ্ছেন।
তাদের চোখে মুখে একটি প্রশ্ন—"আমরা আর কত দিন চোর-বাটপারদের হাতে দেশ দেখতে থাকবো?" জামায়াত এই তরুণদের মধ্যে নৈতিকতা, নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক শিক্ষা ছড়িয়ে দিয়ে আদর্শিক ভবিষ্যৎ নির্মাণে ভূমিকা রাখছে।

 

৯. আন্তর্জাতিক বার্তা: শান্তিপূর্ণ ইসলামী রাজনীতি সম্ভব-জামায়াত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই মহাসমাবেশের মাধ্যমে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে—বাংলাদেশে ইসলামী রাজনৈতিক শক্তি অস্তিত্বশীল, গণতান্ত্রিক পথে বিশ্বাসী এবং সন্ত্রাসমুক্ত রাজনীতির চর্চায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

 

১০.জুলাই ১৯,২০২৫ ঢাকায় জাতীয় মহাসমাবেশে জামাতে ইসলামের আমির ডা. শফিকুর রহমান বারবার লুটিয়ে পড়েছেন—শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি হেঁটেছেন, দাঁড়িয়েছেন, বক্তব্য দিয়েছেন। এই দৃশ্য জাতির হৃদয়ে এক অভূতপূর্ব আলোড়ন তুলেছে। ক্ষমতা, অর্থ, সুবিধা বা বাহিনীর শক্তির জোরে নয়—একজন রোগাক্রান্ত প্রবীণ নেতার নীরব আত্মত্যাগে জনগণ দেখেছে নেতৃত্বের এক অনন্য উচ্চতা। জাতি দেখেছে, অসুস্থ শরীর কাঁপছে, কিন্তু আদর্শে কোনো কাঁপুনি নেই। তাঁর প্রতিটি লুটিয়ে পড়া যেন বলছে—এই দেশকে ভালোবাসার ত্যাগ কতটা নির্মল ও নিঃস্বার্থ হতে পারে। হাজারো জনতার চোখে জল এসেছে, মুখে উচ্চারিত হয়েছে, “এই নেতার জন্যই আমরা আশা করি”। ডা. শফিকুর রহমানের এই দৃশ্য রাজনৈতিক নেতাদের জন্য যেমন এক আদর্শিক শিক্ষা, তেমনি দেশের জনগণের জন্য এটি এক আস্থা ফিরিয়ে আনার মুহূর্ত। তিনি লুটিয়ে পড়েননি, বরং তিনি ইতিহাসে উঠে দাঁড়িয়েছেন। আর জাতি তাঁকে দেখেছে একজন নীরব বীর হিসেবে—যার নিঃশব্দ সংগ্রামই হয়ে উঠেছে সবচেয়ে গম্ভীর ও গর্জনময় বক্তব্য।

 

বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায়, ওআইসি, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর জন্য এই বার্তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯ জুলাইয়ের জাতীয় মহাসমাবেশ কেবল একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল না—এটি ছিল আদর্শ, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং ভবিষ্যতের নেতৃত্ব নির্মাণের একটি চিত্রপট।

 

পিয়ার পদ্ধতি, জুলাই সনদ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ, দখলবাজির প্রতিরোধ—এই সবকিছু একটি রাজনৈতিক দল নয়, বরং জাতীয় আন্দোলনের অংশ হয়ে উঠতে পারে, যদি জনগণ তা ধারণ করে। আজ বাংলাদেশ একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে—একদিকে লুটপাট ও চোরতন্ত্র, অন্যদিকে আদর্শিক রাজনীতির পুনরাবির্ভাব। এই সন্ধিক্ষণে ১৯ জুলাইয়ের সমাবেশ ইতিহাসে হয়ে থাকবে এক উল্লেখযোগ্য টার্নিং পয়েন্ট।

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক কালের কথা।

১৬৬ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন