মাহবুবুল আলম হানিফ: আধিপত্য, আত্মীয়করণ, দুর্নীতি ও বিতর্কিত রাজনৈতিক উত্থান

সোমবার, ১৪ জুলাই, ২০২৫ ১:১৪ অপরাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কুষ্টিয়া-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাহবুবুল আলম হানিফ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত নাম।
তার রাজনৈতিক উত্থান, ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্বৃত্তায়ন, কুষ্টিয়ায় আধিপত্য এবং আত্মীয়তার সূত্রে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে প্রবেশ—সবকিছুই নানা বিতর্ক ও অভিযোগে ঘেরা।
শেখ হাসিনার আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক উত্থান
হানিফের রাজনৈতিক উত্থানে আত্মীয়তার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি শেখ হাসিনার আত্মীয়—বিশেষভাবে, হানিফের বড় ভাই রশিদুল আলম শেখ হাসিনার ফুফাতো বোনের স্বামী, ফলে হানিফ শেখ হাসিনার বেয়াই হন। এই আত্মীয়তার সূত্রেই তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে দ্রুত প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন এবং উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক সুবিধা পান।
১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পর্যন্ত হানিফ আওয়ামী লীগের কোনো সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন না। তার রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ও উত্থান মূলত পারিবারিক ও আত্মীয়তার সূত্রে, বিশেষত শেখ হাসিনার আত্মীয় হওয়ার সুবাদে।
কুষ্টিয়ায় আধিপত্য ও আত্মীয়করণ
কুষ্টিয়ার রাজনীতিতে হানিফের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অন্যতম কৌশল ছিল আত্মীয়করণ ও আস্থাভাজনদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো।
তিনি তার চাচাতো ভাই আতাউর রহমানকে ভেড়ামারা থেকে এনে কুষ্টিয়া শহর আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি পদে বসান।
পরবর্তীতে, হানিফের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় এবং ভোট ডাকাতির অভিযোগের মধ্য দিয়ে আতাউর রহমান কুষ্টিয়া সদর উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
স্থানীয় পর্যায়ে আতাউরকে “আদায়কারী” বা অর্থ ও প্রভাব আদায়ের প্রধান সহযোগী হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যিনি হানিফের নির্দেশে বিভিন্ন প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রমে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্বৃত্তায়ন ও দুর্নীতি
হানিফের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ—ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি।
সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে তিনি সরকারি পদ ব্যবহার করে বিপুল সম্পদ অর্জন, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, হাটবাজার ইজারা, বালুমহাল থেকে চাঁদা আদায়, জমি দখলসহ নানা অপরাধে অভিযুক্ত।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে ৩২ কোটি টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং ৯০০ কোটি টাকার বেশি সন্দেহভাজন লেনদেনের অভিযোগে মামলা করেছে।
এসব অপরাধের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিদেশে (কানাডা) পাচার, স্ত্রীর নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং পরিবারের সদস্যদের নামে সম্পদ গড়ে তোলার অভিযোগও রয়েছে।
প্রতিহিংসার রাজনীতি ও প্রশাসনিক অপব্যবহার
হানিফের বিরুদ্ধে সবচেয়ে আলোচিত অভিযোগ হলো—প্রতিহিংসার রাজনীতি ও প্রশাসনিক শক্তি অপব্যবহার।
স্থানীয় রাজনীতিতে প্রতিপক্ষকে দমন করতে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক শক্তি, পুলিশি হয়রানি, গুম-হত্যা, মামলা ও হামলার অভিযোগ বহুবার উঠেছে।
বিরোধী দল ও ভিন্নমতাবলম্বীদের দমনে তিনি কঠোর ও বিতর্কিত ভূমিকা রেখেছেন।
তার আধিপত্যের ফলে কুষ্টিয়ার রাজনীতিতে এক ধরনের “ভীতিকর রাজনীতি” প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, যেখানে ভিন্নমত দমন, প্রশাসনিক হয়রানি ও দুর্বৃত্তায়ন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো দেশের রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন, আত্মীয়করণ ও প্রশাসনিক অপব্যবহারের বাস্তব উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত।
শেষ কথা
মাহবুবুল আলম হানিফের রাজনৈতিক জীবন, কুষ্টিয়ায় আধিপত্য, আত্মীয়করণ, দুর্নীতি, প্রতিহিংসার রাজনীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার—সবকিছু মিলিয়ে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক বিতর্কিত ও সমালোচিত চরিত্র। তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ও বিতর্কের কারণে তিনি দেশের রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন, আত্মীয়করণ ও প্রশাসনিক অপব্যবহারের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট
১৩৩ বার পড়া হয়েছে