সর্বশেষ

ফেবু লিখন

আব্বার ওসিয়াত: ধৈর্যের পাহাড়ে দাঁড়িয়ে সিলসিলার বহমান ধারায় আমি

খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী, ফেসবুক থেকে:
খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী, ফেসবুক থেকে:

বুধবার, ৯ জুলাই, ২০২৫ ৮:৫২ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
২০১৭ সালের একটি নির্জন ফজরের সকাল। নামাজ পড়ে বিছানায় শুয়ে ছিলাম। জানালার ফাঁক দিয়ে আসা হালকা সকালের আলোয় ঘুম-জাগরণে দুলছিল আমার শরীর।

হঠাৎ আব্বার কাঁপা কণ্ঠে ফোনে ঘুম ভেঙে গেল। তিনি হজ্বে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখন। তাঁর কণ্ঠে এক গভীর বেদনার ঢেউ ছিল—যেন অতীতের শত বছরের স্মৃতি স্রোতের মতো তাঁর গলা বেয়ে ঝরে পড়ছে।

তিনি বললেন:
"বাবা, আমি আমার পূর্বপুরুষদের সিলসিলা ধরে রেখে বাড়িতে দ্বীন ও ধর্মের আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছি। আমার মৃত্যুর পরে তুমি এই সিলসিলা ধরে রেখে দ্বীন ও ধর্মের খেদমত করে যাবা। এটাই আমার ওসিয়াত।"

তাঁর মুখের কথা থেমে গেল, কিন্তু আমার হৃদয়ের মধ্যে সেই শব্দগুলি ধ্বনিত হতে থাকল আজও। মুহূর্তেই আমি অনুভব করলাম, আমার কাঁধে যেন অদৃশ্য এক ভার নেমে এলো—একটি অলৌকিক চাপ বোধ করতে থাকলাম নিজের ভেতরে। একটি সিলসিলা, একটি উত্তরাধিকার, একটি দায়, একটি আত্মিক প্রতিশ্রুতি আমার উপর অর্পিত হলো।

সিলসিলা মানে শুধু রক্তের পরিচয় নয়, আত্মার দায়িত্ব-আমার বড় আব্বা হযরত শাহসুফী খাজা ফয়জুদ্দিন (রহঃ), আমাদের আধ্যাত্মিক বংশধারা ছিল না কেবল একটি বংশানুক্রমিক পরিচয়, বরং তা ছিল রুহানিয়তের চর্চা, নফসের মোজাহাদা, খালেস ইবাদতের ইতিহাস। একদিকে এই ধারা গড়ায় হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) ও হযরত আলী (রা:) পর্যন্ত, অন্যদিকে তা বিস্তৃত হয় বাংলার চন্দ্রদ্বীপ, বালিয়াতলীর মাটি ছুঁয়ে সরল, নবাব পরিবারের উত্তরসূরী মানুষদের হৃদয়ে।

এই সিলসিলার মূল কথাই ছিল—আল্লাহর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক গড়া, অন্তরের গভীরে তাঁর ভয় ও ভালোবাসার আলো জ্বালানো।

আব্বার চোখে আমি দেখেছি সেই আত্মিক উপলব্ধির অগ্নিশিখা। তিনি কখনো তা চাপিয়ে দেননি, কখনো তা বড়াই করে বলেননি, বরং তাঁর জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আমি সেই তাওয়াজ্জুহর, সেই তাওয়াক্কুলের, সেই দরদমাখা দাওয়াতের সৌরভ পেয়েছি।

“ধৈর্য ধরো, পাহাড় সমান বিপদ আসবে” – সেই পিতৃবাণী আজো কানে বাজে- আব্বা আমাকে প্রায়ই বলতেন,
“বাবা, ধৈর্য ধরো। পাহাড় সমান বিপদ আসবে। সব কেটে যাবে। সহে যে রহে সে।”

তাঁর এই কথাগুলি যেন আমার জীবনের ‘মন্ত্র’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কত কষ্ট, কত অপমান, কত অসম্ভব বাধা এসেছে জীবনে—তখন এই কথাগুলো বুকের মধ্যে পাথরের মতো শক্তি দিয়ে গেছে।

বাড়ি থেকে বিদায়ের সময় মা মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, “বাবা, পৃথিবীর যেখানে থাকো, যে অবস্থায় থাকো না কেন, আমার দোয়া সবসময় তোমার সাথে থাকবে।” সেই মায়ের মুখে কখনো বেশি কথা শুনিনি, কিন্তু তার প্রতিটি বাক্য যেন ছিল জীবনের দিকনির্দেশনা। মা ছিলেন অত্যন্ত পর্দানশীল ও আল্লাহভীরু নারী। তাহাজ্জুত নামাজ ছাড়া তাকে খুব কমই দেখেছি। জীবনের এক পর্যায়ে আমি চরম ভেঙে পড়েছিলাম, দিশাহীন অবস্থায় মা বলেছিলেন, “বাবা, পৃথিবী অনেক বড়, মনকে ছোট কোরো না। সব সময় মনটা বড় রাখবা। বিপদ-আপদ, মুসিবত সবকিছুতেই আল্লাহর সাহায্য আসবে, শুধু ধৈর্য ধরো।” মায়ের সেই কথাগুলো আজো আমার জীবনের পাথেয়। তার দোয়া ও পরামর্শ আমাকে সাহস দিয়েছে, সব অন্ধকারে আলোর পথ দেখিয়েছে।

বাবার প্রিয় উপমা ছিল:
"যেমন নবী ইউসুফ (আ:) ও পিতা ইয়াকুব (আঃ) এর মধ্যে বাধা ছিল, তেমনটা আমাদের বাপ-বেটার মধ্যেও হবে। কিন্তু এই ফারাকই একদিন সেতুতে পরিণত হবে।"

এই কথা আমি তখন বুঝিনি। কিন্তু সময়ের প্রবাহে যখন আমি সমাজে ধর্মীয় খেদমতের দায়িত্ব নিতে শুরু করলাম, যখন প্রতিকূলতা, কুটিলতা, দ্বিধা ও ভয় মাথাচাড়া দিলো—তখন বুঝলাম, আব্বা ভবিষ্যতের স্রোতের আওয়াজ আগে থেকেই শুনতে পেয়েছিলেন।

স্মৃতির আয়নায় আব্বার মুখ- আমি যতবার তাঁর সামনে বসতাম, তিনি চোখ বন্ধ করে কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকতেন।

তিনি বলতেন: “তুমি আলেম হও, তোমাকে মুত্তাকি হতে হবে। মুত্তাকিরা সমাজ বদলায়, যুগ বদলায়। আমার মৃত্যুর পর, তুমি যদি মুত্তাকি হতে পারো, তাহলেই সিলসিলার হক আদায় হবে।” আমাদের বংশীয় সিলসালা বড় উত্তম ও নীতি -আদর্শের।

আমি যেন তাঁর সেই কথায় নিজের ভবিষ্যতের ছায়া দেখতে পেতাম। প্রতিদিনই মনে হতো, আমি যেন একটি পরীক্ষায় বসে আছি—যার প্রশ্নপত্র আব্বা দিয়ে গেছেন, আর উত্তর লিখে যাচ্ছি আমি।

কেন এই ওসিয়াত আমাকে দেওয়া হয়েছিল?

আমি এই প্রশ্নে আজও থমকে যাই: “আব্বা কেন আমাকে এই ওসিয়াত দিলেন?”
আমার ভাইরাও আছেন, আত্মীয়-স্বজনও আছেন, এত ভক্ত, ছাত্র-অনুসারী—তবুও কেন আমি?

সম্ভবত, তিনি আমার মধ্যে এমন কিছু দেখেছিলেন যা আমি তখন নিজেই বুঝিনি। হয়তো তিনি অনুভব করেছিলেন, আমি যেই নাড়ির টানে তাঁর পাশে থেকেছি, প্রতিটি দোয়ার আসরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকেছি, লোকচক্ষুর আড়ালে তার মূল্য বেশি।

আমার গভীর বিশ্বাস—জীবনের পথে বহু বাধা, ক্ষতি, ও প্রতিকূল পরিস্থিতি এসেছে, কিন্তু সবকিছুর মাঝেও আমি আল্লাহর অশেষ রহমতে নিরাপদ থেকেছি। আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি, আমার এই রক্ষা ও সাফল্যের পেছনে রয়েছে আমার পরহেযগার বাবা-মায়ের চোখের পানি ও হৃদয়ছোঁয়া নেক দোয়ার বরকত। তাদের তাহাজ্জুদের সিজদা, কান্না, আর আল্লাহর দরবারে আমার জন্য চাওয়া মাগফিরাতই আমার জীবনের প্রতিটি বিপদে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কুরআনে বলা হয়েছে, “আত্-তাকওয়া তানজিলুল বালা”—পরহেযগারি ও দোয়ার মাধ্যমে বিপদ দূর হয়। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমার জীবনে যত মুসিবত এসেছে, আল্লাহ তা দূর করেছেন আমার মা-বাবার দোয়ার বদৌলতে। তাদের দোয়া আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, আর সেই দোয়ার ছায়াতলে আমি সবসময় আল্লাহর রহমতের আশ্রয়ে আছি।

তিনি একবার বলেছিলেন: “তুমি কথা কম বলো, বেশি বোঝো—তোমার চুপ থাকাই আমার উপর ভরসার এক ইশারা। আল্লাহ এই চুপকেই বড় কাজে লাগাবে।”

সেই ‘চুপ’ যেন আজ শব্দে রূপ নেয়, কলমে রূপ নেয়, খেদমতে রূপ নেয়।

ওসিয়াত মানে কেবল দায়িত্ব নয়, এক প্রেমের পরীক্ষাও: ওসিয়াত অনেক সময় শুধু দায়িত্বের ভার নয়, বরং এটি প্রেমের একটি কঠিন পরীক্ষা।
যাকে ভালোবাসা হয়, তাকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়।

 

আর সেই দায়িত্ব বহন করতে গিয়ে প্রেমের অনেক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়।

আব্বা আমাকে ভালোবাসতেন। কিন্তু সেই ভালোবাসা দিয়ে আমাকে আলস্যে ঘুম পাড়াননি। বরং তাঁর ভালোবাসা আমাকে এক যুদ্ধে ঠেলে দিয়েছে—নফসের বিরুদ্ধে, সমাজের অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে, নিজের দ্বিধা ও লোভের বিরুদ্ধে।

আজ আব্বার তেমন চলার শক্তি নেই, নানা ষড়যন্ত্রে জর্জরিত কিন্তু তাঁর সেই ওসিয়াত আজও জীবন্ত। আমি যখন সমাজে ‘মানবিকতা’র কথা বলি, আমি যখন দীন প্রচারে কাজ করি, আমি যখন একটি নতুন প্রজন্মকে আত্মিক উন্নতির কথা শোনাই—আমি বুঝি, আমি আমার বাবার উত্তরাধিকার রক্ষা করছি।

এই ওসিয়াত আমাকে শুধু দীনদার বানায়নি, আমাকে সংবেদনশীল করেছে, বিচক্ষণ করেছে, দায়িত্বশীল করেছে। আমি নিজেকে আজ আর শুধু "বাবার সন্তান" মনে করি না—আমি নিজেকে "একটি সিলসিলার ধারক" হিসেবে অনুভব করি।

সিলসিলা টিকে থাকে ধৈর্য ও প্রেমের উপর, আব্বা বলতেন: “তোমার ঘাড়ে এই দায়িত্ব থাকবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। তুমি হয়তো অনেক ভুল করবে, কিন্তু কখনো পলায়ন করবে না। সাহস হারাবে না। আল্লাহ তোমাকে শক্তি দিবেন। ধৈর্য ধরো।” ইন্নাল্লাহা মা আস-সবিরীন।

আজ আমি সেই ধৈর্য ধারণ করছি। প্রতিদিন জীবনের নানা প্রতিকূলতায় যখন নুয়ে পড়ি, তখন আব্বার কণ্ঠের সেই ডাক আমার হৃদয়ে বেজে ওঠে।
আমি তখন আবার দাঁড়াই, আবার লিখি, আবার মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াই। কারণ আমি জানি—এই সিলসিলা আমার নয়, এই সিলসিলা আল্লাহর। আমি শুধু এর একজন নগণ্য বাহক মাত্র।

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক কালের কথা

১১৮ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
ফেবু লিখন নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন