বেআইনিভাবে চলছেই ভারত থেকে পুশইন

রবিবার, ৬ জুলাই, ২০২৫ ৭:৪৭ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
ভারত থেকে বাংলাদেশে বেআইনিভাবে পুশইন বা ঠেলে পাঠানোর ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। কোনো নিয়ম বা আন্তর্জাতিক চুক্তির তোয়াক্কা না করেই প্রায় প্রতিদিন সীমান্ত পেরিয়ে রোহিঙ্গাসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হচ্ছে।
গতকাল শনিবার পর্যন্ত এভাবে ভারতে অবস্থানরত ১,৯০১ জনকে বাংলাদেশে পুশইন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়।
এর মধ্যে শুধুমাত্র কক্সবাজারে পাঠানো হয়েছে দুই শতাধিক রোহিঙ্গাকে। তারা কেউ রোহিঙ্গা ট্রানজিট ক্যাম্পে, কেউবা স্বজনদের আশ্রয়ে অবস্থান করছেন।
বিস্তৃত পুশইন, প্রশ্ন তুলছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো
প্রথমবার গত ৭ মে শুরু হওয়া এই পুশইন কার্যক্রমকে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বিস্তৃত ঠেলে দেওয়ার নজির হিসেবে উল্লেখ করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলো এরইমধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তবে প্রতিবাদ সত্ত্বেও থামছে না এই প্রক্রিয়া।
বিশ্লেষকদের মতে, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোনো নাগরিককে অন্য দেশে ফেরত পাঠাতে হলে তা হতে হবে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে। কিন্তু এইসব পুশইনের ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম মানা হচ্ছে না। ফেরত পাঠানো অনেকের শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন রয়েছে বলেও জানা গেছে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, "প্রতিদিনই কোনো না কোনো সীমান্ত দিয়ে ঠেলে দেওয়া রোহিঙ্গাদের আমরা ক্যাম্পে পাঠাচ্ছি। পৃথিবীর সবাই জানে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া বেআইনি, এটি সংকট সৃষ্টি করতে পারে।"
কোন কোন সীমান্ত দিয়ে পুশইন?
বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে মোট ১,৯০১ জনকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে মৌলভীবাজার দিয়ে সর্বোচ্চ ৫০২ জনকে, সিলেট সীমান্ত দিয়ে ২৫০ জন, খাগড়াছড়ি দিয়ে ১৬০, লালমনিরহাট ১২৮, পঞ্চগড় ১১৪, সাতক্ষীরা ১১০, কুড়িগ্রাম ৯১, ঠাকুরগাঁও ৭৫, ফেনী ৬৭ ও সুনামগঞ্জ দিয়ে ৫৩ জনকে ঠেলে দেওয়া হয়।
এ ছাড়া বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ৪৩ জন করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর ও হবিগঞ্জে, ৩২ জন নেত্রকোনায়, ৩১ জন ময়মনসিংহে, ২৫ জন চুয়াডাঙ্গায় এবং অন্যান্য সীমান্ত দিয়ে আরও কিছু সংখ্যককে পাঠানো হয়েছে।
পুশইন হওয়াদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৭৮ জনকে কোস্টগার্ড এবং ২৯ জনকে পুলিশ আটক করেছে।
পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওয়ে নতুন করে পুশইন
গত শুক্রবার রাতে পঞ্চগড়ের দুটি সীমান্ত দিয়ে নারী-শিশুসহ আরও ১৫ জনকে পুশইন করে বিএসএফ। একই দিন ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ সীমান্তেও ছয়জনকে ঠেলে পাঠানো হয়। স্থানীয় প্রশাসন বলছে, তারা এসব ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে এবং যাচাই-বাছাই করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিন ধরনের রোহিঙ্গা ফেরত পাঠাচ্ছে ভারত
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ভারত থেকে মূলত তিন ধরনের রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে—
১. যাদের কাছে ভারতের ইউএনএইচসিআর-এর নিবন্ধন রয়েছে,
২. যাদের কোনো কাগজপত্র নেই,
৩. যারা বাংলাদেশে নিবন্ধিত ছিলেন কিন্তু ভারতে গিয়েছিলেন।
বিশ্লেষকদের মতে, এভাবে গণহারে ফেরত পাঠানো আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের শামিল।
আন্তর্জাতিক আইন কী বলছে?
জাতিসংঘের ‘সিভিল অ্যান্ড পলিটিকাল রাইটস’ চুক্তির ১৩ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো দেশে বৈধভাবে অবস্থানরত ব্যক্তিকে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া দেশত্যাগে বাধ্য করা যায় না। ১২(৪) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কেউ তাঁর নিজ দেশে প্রবেশের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন না। ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ই এই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী।
ভারতের মানবাধিকারকর্মী কিরীটী রায় বলেন, “বিচার বিভাগের সিদ্ধান্ত ছাড়া কাউকে ফেরত পাঠানো সংবিধানবিরোধী। শুধু ধর্মের ভিত্তিতে আটক করে পুশইন আন্তর্জাতিক রীতিনীতির লঙ্ঘন।”
‘কূটনৈতিক উদ্যোগ জোরদার করা জরুরি’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, "যাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে তারা কখন ভারতে ঢুকেছেন, কেন এখন তাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে—সেসব জানতে হবে। ভারত আন্তর্জাতিক নিয়ম লঙ্ঘন করছে। বিষয়টি মোকাবেলায় বাংলাদেশকে কূটনৈতিকভাবে আরও সক্রিয় হতে হবে।"
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনও বলেছেন, “ভারত থেকে বাস্তবিক অর্থে পুশইন ঠেকানো সম্ভব নয়। তবে কনস্যুলার সংলাপের মাধ্যমে একটি প্রক্রিয়ায় সমাধানের চেষ্টা হচ্ছে।”
১৩৫ বার পড়া হয়েছে