সর্বশেষ

মতামত

৪৮ বছরে সরকারি অনুদানে চলচ্চিত্র: সাফল্য, ব্যর্থতা ও বিতর্ক

মনজুর এহসান চৌধুরী
মনজুর এহসান চৌধুরী

বৃহস্পতিবার , ৩ জুলাই, ২০২৫ ৬:১২ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
বাংলাদেশে সরকারি অনুদানে চলচ্চিত্র নির্মাণের ইতিহাস প্রায় পাঁচ দশকের। ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছর থেকে শুরু হওয়া এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য ছিল দেশীয় সংস্কৃতি, ইতিহাস ও মানবিক মূল্যবোধ তুলে ধরা, নতুন নির্মাতা ও প্রতিভা উৎসাহিত করা এবং শিল্পের বিকাশ ঘটানো।

তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই অনুদান ব্যবস্থার কার্যকারিতা, স্বচ্ছতা ও সাফল্য নিয়ে নানা প্রশ্ন ও বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ও অর্থের পরিমাণ

১৯৭৬ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সরকারি অনুদানে নির্মিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা প্রায় ৪০০। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের সংখ্যা ও বরাদ্দ বেড়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩২টি চলচ্চিত্র নির্মাণে ৯ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে—এর মধ্যে ১২টি পূর্ণদৈর্ঘ্য ও ২০টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। গত ৫০ বছরে সরকারি তহবিল থেকে প্রায় ১৫০-২০০ কোটি টাকা চলচ্চিত্র অনুদানে ব্যয় হয়েছে।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি: হতাশাজনক চিত্র

এত বিপুল অর্থ ও প্রচেষ্টার পরও সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের আন্তর্জাতিক সাফল্য অত্যন্ত সীমিত। ৪০০ চলচ্চিত্রের মধ্যে মাত্র ৪টি আন্তর্জাতিকভাবে উল্লেখযোগ্য পুরস্কার বা স্বীকৃতি পেয়েছে—যেমন ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ (মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, ১৯৮০), ‘গাড়িওয়ালা’ (শিকাগো আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসব, ২০১৪), ‘মাটির প্রজার দেশে’ (বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, ২০১৮) এবং ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ (কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, ২০১৩)। সাফল্যের হার মাত্র ১%—যা শিল্পের মান ও ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা প্রকাশ করে।

অনুদান বিতরণ ও অপচয়: অভিযোগ ও বাস্তবতা

অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের মান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সমালোচনা রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, অনেকে রাজনৈতিক, ব্যক্তিগত বা প্রশাসনিক প্রভাব খাটিয়ে অনুদান পান, যাদের প্রকৃত যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতা নেই। অনেক নির্মাতা অনুদানের টাকা নিয়ে বছরের পর বছর সিনেমা শেষ করেন না, নিম্নমানের কাজ জমা দেন বা বাজেটের বড় অংশ আত্মসাৎ করেন। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং দুর্বল, শর্ত ভঙ্গ করলেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

পুরস্কার ও প্রণোদনা: সীমাবদ্ধতা ও সংস্কার প্রয়োজন

বর্তমানে নির্মাণের সময়ই অনুদান দেওয়া হয়, নির্মাণ-পরবর্তী মান, দর্শকপ্রিয়তা বা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অনুযায়ী বড় অংকের পুরস্কার বা প্রণোদনার ব্যবস্থা নেই। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে নগদ অর্থের পরিমাণও তুলনামূলক কম। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নির্মাণ-পরবর্তী সাফল্যকে আর্থিকভাবে পুরস্কৃত করার সংস্কৃতি চালু হলে নির্মাতাদের মধ্যে গুণগত প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং শিল্পের মানোন্নয়ন হবে।

দায়ী কারা?

অনুদানের টাকা অপচয় ও মানহীন চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য দায়ী—অনুদান কমিটির অস্বচ্ছতা, দুর্বল মনিটরিং, রাজনৈতিক প্রভাব ও নির্মাতাদের অনিয়ম। কার্যকর জবাবদিহি, স্বচ্ছতা ও কঠোর মনিটরিং ছাড়া এই অপচয় বন্ধ হবে না।

করণীয় কী?

স্বচ্ছ ও কঠোর বাছাই প্রক্রিয়া চালু করা। নির্মাণ-পরবর্তী মান দেখে পুরস্কার ও প্রণোদনা চালু করা। নিয়মিত মনিটরিং ও অডিট। শর্ত ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা। জনগণের সামনে প্রতিবছর অনুদান ও অগ্রগতি প্রকাশ।

শেষ কথা

সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের সংখ্যা ও বাজেট বাড়লেও কাঙ্ক্ষিত মান ও আন্তর্জাতিক সাফল্য আসেনি। অনিয়ম, দুর্বল মনিটরিং ও স্বচ্ছতার অভাবে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় হচ্ছে—এ নিয়ে সমালোচনা তীব্র। নীতিমালার সংস্কার, কার্যকর মূল্যায়ন ও জবাবদিহি ছাড়া এই চিত্র বদলানো কঠিন।


লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

১৫২ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন