বাংলাদেশে এআই-চালিত ভিডিওতে রাজনৈতিক প্রচার ও অপপ্রচার

মঙ্গলবার, ১ জুলাই, ২০২৫ ৮:৫৫ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) প্রযুক্তি ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রচার-প্রচারণা, অপপ্রচার ও নেতিবাচক ভিডিও প্রকাশের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।
তথ্য যাচাইবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ডিসমিস ল্যাব বলছে, বাংলাদেশে তৈরি এমন ভিডিও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
বেশিরভাগই মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য প্রচারের ক্ষেত্রে ব্যবহার করছে। যা প্রযুক্তি জ্ঞানশূন্য মানুষের জন্য ভীতিকর অথবা ক্ষতিকর। এমনকি এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সংবাদ বা দুর্ঘটনার ছবি তৈরি করে ভীতির সৃষ্টি করা হচ্ছে।
এক গবেষণা প্রতিবেদনে ডিসমিস ল্যাব জানিয়েছে, গত ১৮ থেকে ২৮ জুন পর্যন্ত সময়কালে ফেসবুকের বিভিন্ন পেজ ও গ্রুপ থেকে এআই দিয়ে তৈরি ৭০টি রাজনৈতিক ভিডিও সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ভিডিওগুলো এতটাই নিখুঁতভাবে তৈরি যে সাধারণ মানুষের পক্ষে সেগুলোর ভিন্নতা বা কৃত্রিমতা চিহ্নিত করা কঠিন।
এই ভিডিওগুলোতে কারিগরি সতর্কতা, যেমন ‘এআই-প্রসেসড’ লেবেল ছিল না, যা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর নীতিমালার পরিপন্থী। এআই প্রযুক্তির এই ব্যবহার রাজনৈতিকভাবে কোনো এক পক্ষকে সমর্থন কিংবা প্রতিপক্ষের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।
ভিউ, প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব
গবেষণা অনুযায়ী, এই ৭০টি ভিডিও ইতোমধ্যে ২ কোটি ৩০ লাখেরও বেশি বার দেখা হয়েছে। প্রতি ভিডিও গড়ে ৩ লাখ ২৮ হাজার বার দেখা গেছে এবং প্রতিটিতে গড়ে ১৭ হাজারের বেশি প্রতিক্রিয়া (লাইক, কমেন্ট, শেয়ার) পাওয়া গেছে। যা প্রমাণ করে—এই ভিডিওগুলোর ব্যাপক বিস্তার ও প্রভাব রয়েছে।
গবেষণায় এসব ভিডিওকে 'সফটফেক' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে, যেখানে সাধারণ মানুষের চেহারা ও কণ্ঠস্বর কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে। এদের মধ্যে কিছু ভিডিও ‘ডিপফেক’ ধরনের বলেও চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এআই নীতিবিষয়ক বিশ্লেষক রুম্মান চৌধুরী বলেন, “ভিডিওগুলো সরাসরি হিংসাত্মক না হলেও এগুলো বিপজ্জনক। কারণ, এগুলো অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য এবং বিভ্রান্তিকর।”
ভিইও-৩: নতুন টুল, নতুন চ্যালেঞ্জ
এই ভিডিওগুলোর বেশির ভাগই তৈরি করা হয়েছে গুগলের নতুন ভিডিও জেনারেশন টুল ‘ভিইও-৩’ দিয়ে, যা ২০২৫ সালের মে মাসে চালু হয়। ডিসমিস ল্যাবের ভাষ্যমতে, আগের এআই ভিডিওগুলোর মতো বিকৃত মুখাবয়ব বা ভুলভাল কণ্ঠস্বর নেই; বরং ভিডিওগুলো প্রায় বাস্তবের মতো নিখুঁত, যা শনাক্ত করা কঠিন করে তুলেছে।
কারা তৈরি করছে এই ভিডিও?
ডিসমিস ল্যাবের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রথমদিকে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকেরা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভিডিও তৈরি করে ছড়ানো শুরু করেন। ‘জামায়াত শিবির সাপোর্টার্স’ নামের একটি পেজ থেকে এমন বেশ কিছু ভিডিও পাওয়া যায়। যদিও পেজটির পরিচালকেরা দাবি করেছেন, এটি জামায়াতের কোনো কেন্দ্রীয় নির্দেশনা নয়, বরং ব্যক্তিগত উদ্যোগ।
পরে বিএনপি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সমর্থকেরাও এআই ভিডিও ছড়িয়ে রাজনৈতিক বার্তা প্রচার করতে থাকেন। এমনকি আওয়ামী লীগের সমর্থকদেরও এ ধরনের ভিডিও ছড়াতে দেখা গেছে, যদিও বর্তমানে দলটির ডিজিটাল প্রচার সীমিত।
নির্বাচন সামনে, শঙ্কা বাড়ছে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক বি এম মইনুল হোসেন বলেন, “এআই দিয়ে তৈরি ভিডিও এখন সাধারণ মানুষের জন্য বিভ্রান্তিকর হয়ে উঠছে। এটি নির্বাচনের পরিবেশ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “নির্বাচন কমিশনের এখনই উচিত একটি প্রযুক্তি সেল গঠন করা, যা এই ধরনের ভিডিও শনাক্ত ও মোকাবিলা করতে পারবে।” পাশাপাশি তিনি বেসরকারি সংস্থা এবং রাজনৈতিক দলগুলোকেও সচেতনতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান।
ফেক ভিডিও, বাস্তব প্রভাব
মেটা ও টিকটকের নীতিমালায় স্পষ্টভাবে বলা আছে, এআই দিয়ে তৈরি ভিডিওতে উপযুক্ত লেবেল থাকতে হবে। অথচ ডিসমিস ল্যাবের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ফেসবুকের ৭০টি ভিডিওর একটিতেও এআই চিহ্নিত করার কোনো লেবেল ছিল না। টিকটকের ২৬টি ভিডিওর মধ্যে ৯টিতে ছিল না কোনো সতর্কবার্তা।
এআই প্রযুক্তির নেতিবাচক ব্যবহার নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেক বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তি বিশ্লেষক। যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু এআই সিস্টেম প্রতারণামূলক আচরণ করছে—মিথ্যা বলছে, ছলনার আশ্রয় নিচ্ছে এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করছে।
চিন্তার কারণ
বিশ্বব্যাপী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন নানা ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য দেখালেও এর অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক হুমকি। গবেষকরা বলছেন, ডিপফেক ভিডিও এবং সফটফেক কনটেন্ট শুধু ব্যক্তি নয়, গোটা নির্বাচন ব্যবস্থাকেও প্রভাবিত করতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের মস্তিষ্ককেও ছাড়িয়ে যেতে পারে, এবং তখন তার ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যেতে পারে। ফলে প্রয়োজন সরকারের, সামাজিক মাধ্যমের, এবং নাগরিক সমাজের সম্মিলিত উদ্যোগ।
১২০ বার পড়া হয়েছে