ইসরাইলের নজিরবিহীন হামলায় কেঁপে উঠল ইরান: পারমাণবিক স্থাপনা ও সামরিক সদর দপ্তরে বিস্ফোরণ, নিহত শীর্ষ জেনারেল

শুক্রবার, ১৩ জুন, ২০২৫ ৫:৪৬ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
১৩ জুন, শুক্রবার ভোররাতে ইরানের রাজধানী তেহরানে এবং গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় ব্যাপক বিমান ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে ইসরাইল।
এই হামলায় ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডের (IRGC) সদর দপ্তর, নাতাঞ্জের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র, ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্রসহ একাধিক স্থাপনা লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। ইসরাইল এই অভিযানকে ‘আগাম প্রতিরোধমূলক’ হামলা বলে ঘোষণা করেছে।
স্থানীয় সময় ভোর চারটার পরপরই তেহরানে একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশন জানায়, রাজধানীর উত্তর-পূর্বে রেভল্যুশনারি গার্ডের সদর দপ্তরে সরাসরি হামলা হয়েছে। একই সময়ে মধ্য ইরানের নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনায় আগুন দেখা যায়। স্যাটেলাইট চিত্রে পারচিনসহ আরও কয়েকটি সামরিক কমপ্লেক্সে বিস্ফোরণ ও ধ্বংসের চিত্র ধরা পড়েছে।
ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কার্তজ জানিয়েছেন, এই হামলার উদ্দেশ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি ও সামরিক সক্ষমতাকে দুর্বল করা। প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেন, “আমরা ইসরাইলের ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। এই অভিযান কয়েক দিন ধরে চলবে”। ইসরাইলজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে এবং বেসামরিক নাগরিকদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
হামলায় ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর প্রধান কমান্ডার মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি নিহত হয়েছেন। এছাড়া, নিহতদের মধ্যে রয়েছেন দুইজন শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী মোহাম্মদ মেহেদি তেহরানচি (ইসলামিক আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ও পারমাণবিক বিজ্ঞানী) এবং ফেরেইদুন আব্বাসি (ইরানের পরমাণু শক্তি সংস্থার সাবেক প্রধান ও পরমাণু বিজ্ঞানী)আরও কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা ও বেসামরিক নাগরিক (নারী ও শিশু) নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম, তবে তাদের নাম ও পরিচয় বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করা হয়নি।
নাতাঞ্জ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র, ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন কারখানা, সামরিক ঘাঁটি ও গবেষণা স্থাপনায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তেহরান ও আশপাশের আবাসিক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, নারী-শিশুসহ বেসামরিক হতাহতের খবর পাওয়া গেছে।
দেশজুড়ে বিমানবন্দর ও আকাশসীমা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে, জরুরি অবস্থা জারি হয়েছে।
ইরান হামলার পরপরই প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছে। দেশটির সামরিক ও কূটনৈতিক মহল জানিয়েছে, ইসরাইলের সামরিক ও কৌশলগত অবকাঠামো লক্ষ্য করে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার প্রস্তুতি চলছে। ইরানের আঞ্চলিক মিত্র হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতি, সিরিয়া ও ইরাকের ইরানঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীগুলোও সক্রিয় হয়েছে।
এই হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কর্মকর্তারা আগেই ইসরাইলি হামলার আশঙ্কায় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে কূটনীতিক ও সামরিক সদস্যদের সরিয়ে নিয়েছে। মার্কিন প্রশাসন জানিয়েছে, তারা এই হামলায় সরাসরি জড়িত নয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সংঘাত আরও ছড়িয়ে পড়লে পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে যুদ্ধ, মানবিক সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে।
ইরান-ইসরাইল সংঘাতের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন জোট ও বিরোধিতার সম্ভাবনা বেড়েছে। ইরানঘনিষ্ঠ ‘অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স’ আরও সক্রিয় হতে পারে, আবার সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশরসহ কিছু দেশ ইরানবিরোধী অবস্থান নিতে পারে।
তেলের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে।
রাশিয়া ও চীন ইরানের পাশে অবস্থান নিচ্ছে, ফলে বৈশ্বিক মেরুকরণ আরও স্পষ্ট হচ্ছে।
ইসরাইলের একতরফা হামলা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পারমাণবিক আলোচনাকে ভেস্তে দিতে পারে। এতে ইরান আরও কঠোর অবস্থান নিতে পারে, ফলে কূটনৈতিক সমাধানের পথ সংকুচিত হবে এবং মার্কিন স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ইসরাইল-ইরান সংঘাতের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি, কূটনীতিক, নাগরিক ও আঞ্চলিক মিত্ররা সরাসরি হামলার ঝুঁকিতে পড়েছে। একই সঙ্গে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে, এবং যুক্তরাষ্ট্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও বড় ধরনের সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে।
ইসরাইলের নজিরবিহীন হামলায় ইরান সামরিক, কৌশলগত ও মানবিক—তিন ক্ষেত্রেই বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে। শীর্ষ সামরিক নেতা ও বিজ্ঞানীদের মৃত্যু, পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনার ধ্বংস এবং বেসামরিক হতাহতের ঘটনা এই সংঘাতকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে। ইরান পাল্টা হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে, ফলে পুরো মধ্যপ্রাচ্য আরও অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক মহল গভীর উদ্বেগে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, কারণ এই সংঘাত দ্রুত আঞ্চলিক যুদ্ধ ও বৈশ্বিক সংকটে রূপ নিতে পারে।
১২৪ বার পড়া হয়েছে