রোহিঙ্গা সংকট নিরসন ও নয়াদিগন্ত উন্মোচন

রবিবার, ১ জুন, ২০২৫ ৩:১২ অপরাহ্ন
শেয়ার করুন:
রোহিঙ্গা সংকট এখন আর কেবল বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক কোনো বিষয় নয়। এটি এক জটিল আন্তর্জাতিক মানবিক ও নিরাপত্তাজনিত সংকটে পরিণত হয়েছে, যার আঞ্চলিক প্রভাব সুদূরপ্রসারী।
২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সামরিক দমন-পীড়নের পর প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা প্রতিশ্রুতি ও কূটনৈতিক উদ্যোগের পরও এখনো একটি টেকসই সমাধান অধরা। এই প্রেক্ষাপটে টোকিওতে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং জাপানের দ্য নিপ্পন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ইয়োহেই সাসাকাওয়ার মধ্যে সাম্প্রতিক বৈঠক নতুন কূটনৈতিক আশার দিগন্ত খুলে দিয়েছে।
ইয়োহেই সাসাকাওয়া কেবল একজন দানবীর বা বিশিষ্ট জাপানি সংস্থার প্রধান নন; তিনি একজন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শান্তি-দূত, বিশেষ করে মিয়ানমারে সংঘাত নিরসনে তাঁর অসাধারণ অভিজ্ঞতা রয়েছে। দ্য নিপ্পন ফাউন্ডেশন এবং সাসাকাওয়া পিস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি গত কয়েক দশকে ১৫০ বারের বেশি মিয়ানমার সফর করেছেন, যেখানে তিনি যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন ও মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিয়েছেন। মিয়ানমারের সরকার এবং ১০০টিরও বেশি জাতিগত গোষ্ঠীর নিকট তাঁর গ্রহণযোগ্যতা এমন এক বিরল দৃষ্টান্ত যা খুব কম আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব অর্জন করতে পেরেছেন।
এই প্রেক্ষিতে, অধ্যাপক ইউনূসের এই কূটনৈতিক সংলাপ বাংলাদেশ সরকারের রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচক। মিয়ানমারের বিভিন্ন পক্ষ কর্তৃক গ্রহণযোগ্য একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে ইউনূস যেটি করেছেন, সেটিকে Track-II diplomacy (অনানুষ্ঠানিক কূটনীতি) বলা যেতে পারে, যেখানে বিশ্বস্ত বেসরকারি ব্যক্তিরা মধ্যস্থতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস রোহিঙ্গা সংকটের ক্রমবর্ধমান বিপর্যয় তুলে ধরেন: “প্রতি বছর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রায় ৩৫,০০০ শিশুর জন্ম হচ্ছে,” তিনি বলেন, “এই শিশুরা বেড়ে উঠছে কোনো আশা ছাড়াই।” এই ক্যাম্পগুলো, যেগুলো একসময় অস্থায়ী ছিল, আজ স্থায়ী বসতির রূপ নিচ্ছে—নিজস্ব সামাজিক কাঠামো, হতাশা ও নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে।
রোহিঙ্গা শরণার্থী সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ১০,৫৫,০০০। কক্সবাজারে ৩৩টি ক্যাম্পে প্রায় ৯,৪২,৯৪৪ জন, এবং ভাসানচরে প্রায় ৩৫,০৫৯ জন রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। ২০২৩ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৬৫,০০০ নতুন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। প্রতিদিন গড়ে ৯০ থেকে ১০০ শিশুর জন্ম হচ্ছে, যা জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখছে। ৫২% রোহিঙ্গা শিশু-কিশোর (১৮ বছরের নিচে)। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী, তীব্র অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় ২৭% বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে ক্যাম্পে শিশুদের মধ্যে ১৫.১% অপুষ্টিতে ভুগছে, যা জরুরি পরিস্থিতির মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। খাদ্য সংকট আরও গভীর হয়েছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (WFP) দানের ঘাটতির কারণে প্রতি রোহিঙ্গার জন্য মাসিক খাদ্য সহায়তা $১২.৫০ থেকে $৬-এ নামিয়ে আনার ঝুঁকিতে পড়েছে। এই সংকট মোকাবেলায় ২০২৫ সালের এপ্রিলের মধ্যে $১৫ মিলিয়ন প্রয়োজন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০২৫ সালের মার্চে নতুন করে $৭৩ মিলিয়ন সাহায্য ঘোষণা করেছে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো অধ্যাপক ইউনূসের এই সতর্কতা—“পরিস্থিতি শিগগিরই বিস্ফোরক ও বিপজ্জনক রূপ নিতে পারে।” শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও পরিচয়বিহীন এই প্রজন্ম র্যাডিকালাইজেশন, মানবপাচার ও মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে, যা কেবল ক্যাম্প নয়, পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে। সাসাকাওয়াকে সময় থাকতেই পদক্ষেপ নিতে অধ্যাপক ইউনূসের এই আহ্বান এখন সময়োপযোগী নয়, বরং অতীব জরুরি।
বৈঠকে ইউনূস আরেকটি গুরুতর ইস্যু উত্থাপন করেন—USAID-এর সাম্প্রতিক সহায়তা বন্ধ হওয়ার ফলে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (ICDDR’B)-এর কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত এই প্রতিষ্ঠান বর্তমানে তাদের চিকিৎসা ও গবেষণা সেবাকে টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে।
রোহিঙ্গা সংকট এবং অনুদান হ্রাস বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করে তুলেছে। সাসাকাওয়ার ফাউন্ডেশনকে এই গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় এগিয়ে আসতে অনুরোধ জানিয়ে ইউনূস মানবিক খাতে অনুদান ক্লান্তির (donor fatigue) বিষয়ে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। বিশ্ব যখন নতুন নতুন সংকটের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে, তখন এই ধরনের প্রতিষ্ঠানে সহায়তা অব্যাহত রাখা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
সাসাকাওয়ার ভূমিকার গুরুত্ব কোনোভাবেই খাটো করে দেখা যায় না। বহু আন্তর্জাতিক কূটনীতিক ও সংস্থার মিয়ানমারে প্রবেশ ও গ্রহণযোগ্যতা সীমিত হলেও সাসাকাওয়া উভয়ই অর্জন করেছেন। বহু বছর ধরে তিনি জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন, যা তাঁকে শুধু শান্তি নয়, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও অধিকার সংক্রান্ত আলোচনায়ও অনন্য মধ্যস্থতাকারীতে পরিণত করেছে।
ইউনূসের সাসাকাওয়াকে উদ্দেশ করে বলা—“আপনাকে মিয়ানমারের সকল পক্ষই সম্মান করে”—এই কথার মধ্য দিয়ে তাঁর কৌশলগত কূটনৈতিক বোধ ফুটে উঠেছে। যদি সাসাকাওয়া তাঁর প্রভাব কাজে লাগিয়ে একটি বিশ্বাসযোগ্য সংলাপ শুরু করতে পারেন—নিরাপদ, স্বেচ্ছাসেবামূলক ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার জন্য—তবে হয়তো বহু বছরের অচলাবস্থা ভেঙে যেতে পারে।
এছাড়া, মিয়ানমারের রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল পরিবেশে সাসাকাওয়ার অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন ও আস্থা গড়ে তোলার ক্ষমতা ভবিষ্যতে বৃহত্তর একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাধানের ভিত্তি স্থাপন করতে পারে।
এই বৈঠক বাংলাদেশ কূটনীতির একটি নতুন রূপের ইঙ্গিত দেয়। ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশ যেমন জাতিসংঘ, ওআইসি বা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ওপর নির্ভর করত, এখন তা ব্যক্তিকেন্দ্রিক কূটনীতির দিকে এগোচ্ছে।
একজন নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে অধ্যাপক ইউনূস এই দৃষ্টিভঙ্গিতে কেবল প্রতীকী মূল্যই যোগ করছেন না; তাঁর ব্যক্তিগত নেটওয়ার্ক ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি সেখানে অর্থনৈতিক ও নৈতিক সহায়তা আহ্বান করতে পারছে, যেখানে প্রথাগত কূটনীতি ব্যর্থ হয়েছে। তাঁর “প্রধান উপদেষ্টা” পদ তাই কেবল আনুষ্ঠানিক নয়—এটি কৌশলগত।
সাসাকাওয়াকে বাংলাদেশ সফরে আমন্ত্রণ জানানোর মধ্য দিয়ে ইউনূস যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তা আলোচনার ধারাবাহিকতা রক্ষা ও সম্পর্ক গভীর করার একটি কৌশলী পদক্ষেপ। বাস্তব পরিস্থিতি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যালোচনার মাধ্যমে নিপ্পন ফাউন্ডেশন হয়তো দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন ও সমাজে পুনঃঅন্তর্ভুক্তির উদ্যোগেও ভূমিকা রাখতে পারে।
বৈঠকের অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ দিক ছিল ইউনূসের বৈশ্বিক সহযোগিতার আহ্বান। রোহিঙ্গা সংকট কেবল বাংলাদেশের সমস্যা নয়। এটি মানবাধিকার, ন্যায়বিচার এবং আঞ্চলিক শান্তির একটি পরীক্ষাস্বরূপ। একটি গোটা প্রজন্ম পরিচয়, শিক্ষা ও আশাহীনতায় বেড়ে উঠছে—এমন বাস্তবতায় বিশ্ব চুপ থাকতে পারে না।
ইউনূসের বক্তব্য—“আমরা রোহিঙ্গা সংকটের অবসান চাই। এখনই ভালো সময়। আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারি।” এটি একদিকে যেমন সংকট সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপের জন্য সময়ের জানালা সংকীর্ণ হচ্ছে—সেই স্মরণ করিয়ে দেয়, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে জাপান ও অন্যান্য প্রভাবশালী শক্তির প্রতি সম্মিলিত উদ্যোগের আহ্বানও জানায়।
অধ্যাপক ইউনূস ও ইয়োহেই সাসাকাওয়ার এই বৈঠক আনুষ্ঠানিকতা নয়—এটি ছিল প্রতীকী ও কৌশলগতভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। একদিকে যেমন অনুদান কমে আসছে, অন্যদিকে কূটনৈতিক জড়তা সংকটকে দীর্ঘায়িত করছে। এই পরিস্থিতিতে, এমন মানুষকেন্দ্রিক কূটনীতিই হতে পারে একটি নতুন সমাধানের পথ।
বিশ্বস্ত এক মধ্যস্থতাকারীর সঙ্গে সরাসরি আলাপের মাধ্যমে বাংলাদেশ শান্তি ও ন্যায়বিচারের বিকল্প পথ অনুসন্ধান করছে। এই উদ্যোগ যদি বাস্তবায়ন হয়, তাহলে এটি অন্যান্য ক্ষেত্রেও অনুরূপ কূটনীতিকে অনুপ্রাণিত করতে পারে—যেখানে প্রচলিত কূটনীতি ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে নতুন চিন্তার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।
১২ লক্ষ রোহিঙ্গার ভবিষ্যৎ এবং একটি গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তা নির্ভর করছে এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগগুলোর বাস্তব রূপায়নের ওপর। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরেকটি সহিংসতা দেখার আগেই জেগে ওঠা উচিত। কাজ শুরু করার সময় এখনই।
লেখক: সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী।
১৪৬ বার পড়া হয়েছে