সর্বশেষ

মতামত

কৈলাশহর বিমানঘাঁটি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিরব!

মনজুর এহসান চৌধুরী
মনজুর এহসান চৌধুরী

বুধবার, ২৮ মে, ২০২৫ ১২:১৭ অপরাহ্ন

শেয়ার করুন:
বাংলাদেশের লালমনিরহাট বিমানবন্দর দীর্ঘদিন পর পুনরায় চালুর উদ্যোগ নিয়েছে, যা দেশের এভিয়েশন ও আঞ্চলিক যোগাযোগ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

তবে এই উদ্যোগকে ঘিরে ভারতের উদ্বেগ রয়েছে, কারণ তারা মনে করছে এটি চীনের সামরিক প্রভাব বৃদ্ধির হাতিয়ার হতে পারে এবং ভারতের কৌশলগত নিরাপত্তায় হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। এর ফলে ভারত ত্রিপুরায় পুরনো বিমানঘাঁটি পুনরুজ্জীবিত করার মাধ্যমে পাল্টা ব্যবস্থা নিচ্ছে। এই সংকটটি মূলত ভূ-রাজনৈতিক ও সামরিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত কারণে সৃষ্টি হয়েছে।

লালমনিরহাট বিমানবন্দরটি দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত ছিল এবং বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। এর অংশবিশেষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

চলতি বছর বাংলাদেশ সরকার এই বিমানবন্দরটি পুনরায় চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে। বিমানবন্দরটির পরিধি ও কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হবে এবং সেখানে আধুনিক অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে। পাশাপাশি একটি অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনাও রয়েছে। এই বিমানবন্দর চালু হলে এটি আঞ্চলিক একটি গুরুত্বপূর্ণ এভিয়েশন হাব হিসেবে গড়ে উঠতে পারে, যা নেপাল, ভুটানসহ পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ করবে।

লালমনিরহাট বিমানবন্দর ভারতের সীমান্ত থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এবং শিলিগুড়ি করিডর বা ‘চিকেন নেক’ এর খুব কাছে, যা ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। ভারতের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশ এই বিমানবন্দর চালু করার প্রক্রিয়ায় চীনের সহায়তা নিচ্ছে, যা ভবিষ্যতে সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে পারে। ভারতের আশঙ্কা, চীন যদি এখানে অর্থায়ন করে, তাহলে ফাইটার জেট, রাডার ও নজরদারি সরঞ্জাম স্থাপনের মতো সামরিক কার্যক্রম চালানো হতে পারে, যা ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। ভারতের প্রতিক্রিয়ায় তারা ত্রিপুরার কৈলাশহর এলাকায় তিন দশক পুরোনো একটি বিমানঘাঁটি পুনরুজ্জীবিত করার কাজ শুরু করেছে, যা বেসামরিক হলেও সামরিক বিমান চলাচলের জন্য প্রস্তুত রাখা হবে। এটি লালমনিরহাট বিমানবন্দরের পরিকল্পনার ‘পাল্টা ব্যবস্থা’ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

লালমনিরহাট বিমানঘাঁটির ইতিহাস:
লালমনিরহাট বিমানবন্দরটি (Lalmonirhat Airport) ১৯৩১ সালে ব্রিটিশ সরকার সামরিক কৌশলগত কারণে নির্মাণ করে। এটি রংপুর অঞ্চলের লালমনিরহাট সদর উপজেলার মহেন্দ্রনগর ও হারাটি এলাকায় ১,১৬৬ একর জমির ওপর নির্মিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনী এই বিমানবন্দরটি ব্যবহার করেছিল। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বিমানবন্দরের ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৫৮ সালে স্বল্প পরিসরে বিমান সার্ভিস চালু হলেও তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী এখানে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে এটিকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর হেডকোয়ার্টার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৮৩ সাল থেকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী এখানে কৃষি প্রকল্প পরিচালনা করছে এবং বর্তমানে এটি একটি কৃষি খামার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। লালমনিরহাট বিমানবন্দরটি এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ বিমানবন্দর হিসেবে বিবেচিত, যার রানওয়ে প্রায় ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ। দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত থাকলেও, সম্প্রতি বিমানবন্দরটি পুনরায় চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা রংপুর অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

ত্রিপুরার কৈলাশহর বিমানঘাঁটির ইতিহাস:
কৈলাশহর বিমানঘাঁটি (Kailashahar Airport) ত্রিপুরা রাজ্যের উনকোটি জেলায় অবস্থিত এবং এটি ১৯৯০-এর দশক থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। এই বিমানবন্দরটি ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ তথা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এখান থেকেই বাংলাদেশের প্রথম আকাশ হামলা ইউনিট ‘কিলো ফ্লাইট’ এর অভিযান শুরু হয়েছিল, যা ভারতীয় বিমানবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হতো। কিলো ফ্লাইট ইউনিটে ছিল কানাডীয় DHC-3 Otter বিমান, ফরাসি Alouette II হেলিকপ্টার ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের DC-3 Dakota বিমান, যা সরবরাহ ও আক্রমণ উভয় কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের বিমানবাহিনীর ভিত্তি এই কিলো ফ্লাইট ইউনিট থেকেই গড়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ও ১৯৭১ সালের যুদ্ধে ব্যবহারের পর, ১৯৯০-এর দশকে বিমানবন্দরটি বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে ভারতের বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ (AAI) রাজ্য সরকারের অনুরোধে বিমানবন্দরটি পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এটি বেসামরিক বিমান চলাচলের জন্য হলেও, জরুরি পরিস্থিতিতে সামরিক ব্যবহারের পরিকল্পনাও রয়েছে।

উভয় বিমানঘাঁটির ইতিহাসেই দেখা যায়, এগুলো কৌশলগত ও সামরিক গুরুত্বের কারণে নির্মিত ও ব্যবহৃত হয়েছে এবং বর্তমানে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে নতুন করে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

ভারত-বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া:
ভারত বাংলাদেশের কাছে লালমনিরহাট বিমানবন্দর চালু করার বিষয়ে উদ্বেগ ও সতর্কতা প্রকাশ করেছে, তবে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো কূটনৈতিক প্রতিবাদ বা নোট দিয়ে থাকেনি। ভারতের পক্ষ থেকে মূলত গণমাধ্যম ও উচ্চ পর্যায়ের প্রশাসনিক সূত্রে এই উদ্বেগ প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে যে, চীনের সহায়তায় এই বিমানবন্দর পুনরায় চালু হলে তা ভারতের কৌশলগত নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।

এনডিটিভির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারত মনে করছে লালমনিরহাট বিমানবন্দর থেকে চীনা সামরিক সরঞ্জাম যেমন ফাইটার জেট, রাডার ও নজরদারি যন্ত্র স্থাপন হতে পারে, যা ভারতের ‘চিকেন নেক’ করিডরের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি। এই কারণে ভারত ত্রিপুরার কৈলাশহর বিমানঘাঁটি পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নিয়েছে, যা মূলত বেসামরিক হলেও সামরিক ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত রাখা হবে। এই পদক্ষেপকে ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের নতুন সরকারের রাজনৈতিক অবস্থান ও চীন-পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার প্রেক্ষাপটে একটি সতর্কবার্তা হিসেবেও দেখা হচ্ছে।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে কোনো অফিসিয়াল বক্তব্য বা প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি, যদিও বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তী এই অঞ্চলের সাম্প্রতিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার প্রেক্ষিতে আনুমানিকভাবে বাংলাদেশ এই উদ্যোগকে পর্যবেক্ষণ করছে বলে ধারণা করা যায়। তবে বর্তমানে ত্রিপুরার কৈলাশহর বিমানঘাঁটি সংক্রান্ত কোনো স্পষ্ট বা প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশ সরকার থেকে জানানো হয়নি।

চীনের সম্পৃক্ততার ধরন:
চীনা কর্মকর্তারা সম্প্রতি লালমনিরহাট বিমানবন্দর এলাকা পরিদর্শন করেছেন এবং বাংলাদেশ সরকারের অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুস চীনকে বিমানবন্দরটি উন্নয়নের জন্য সরাসরি অনুরোধ করেছেন। এই অনুরোধটি ইউনুসের সাম্প্রতিক চীন সফরের সময় আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপিত হয়। বিমানবন্দরটির উন্নয়ন প্রকল্পে চীনা অর্থায়ন বা কারিগরি সহায়তা থাকবে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকল্পটির কাজ ২০২৫ সালের অক্টোবর মাসে শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং চীন একটি পাকিস্তানি কোম্পানিকে সাব-কন্ট্রাক্টর হিসেবে যুক্ত করতে পারে।

চীনা কর্মকর্তাদের সফরের আগে পাকিস্তানি সামরিক-গোয়েন্দা প্রতিনিধি দলও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী কিছু এলাকা পরিদর্শন করেছে বলে জানা গেছে, যা ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

ভারতীয় মিডিয়া:
লালমনিরহাট বিমানবন্দর নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার তথ‍্য সম্প্রতি স্পষ্টভাবে সন্ত্রাস বা “প্রোপাগান্ডা” মূলত ২০২৪ সালের আগস্টের পর থেকে শুরু হয়েছে। বিশেষ করে ২০২৫ সালের মে মাসে বিষয়টি আরও জোরালোভাবে প্রকাশ পেতে থাকে, যখন বাংলাদেশের নতুন সরকারের চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর প্রসঙ্গ এবং বিমানবন্দরটি চীনের সহায়তায় চালু হচ্ছে—এমন দাবি ভারতীয় মিডিয়ায় উঠে আসে।

লালমনিরহাট বিমানবন্দর বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সংযোগ, আঞ্চলিক বাণিজ্য, কৃষিপণ্য পরিবহন, এবং নেপাল-ভুটানসহ পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি চালু হলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগের নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে, রংপুর অঞ্চলে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটবে, এবং বাংলাদেশ আঞ্চলিক হাব হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে। নেপাল ও ভুটানও এই বিমানবন্দর ব্যবহার করতে আগ্রহী, ফলে উপ-আঞ্চলিক সংযোগ আরও শক্তিশালী হবে।

লালমনিরহাট বিমানবন্দর প্রসঙ্গে ভারতের একতরফা বিরোধিতা বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার পরিপন্থী। বাংলাদেশের উচিত, জাতীয় স্বার্থ ও আঞ্চলিক উন্নয়নের লক্ষ্যে দৃঢ় অবস্থান বজায় রাখা এবং প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখা।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট

২১৩ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন