আস্থার সংকট ও দায়িত্বহীনতা: বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংস্কার জরুরি

মঙ্গলবার, ২৭ মে, ২০২৫ ২:০৬ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে গভীর আস্থাহীনতা দেখা যাচ্ছে। এই সংকট কেবল সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে নয়; বরং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, নেতৃত্ব এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।
এ অবস্থার পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, সুশাসনের ঘাটতি ও নৈতিক অবক্ষয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আস্থার সংকট নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দলীয় বিভক্তি, সামরিক শাসন, একনায়কতান্ত্রিক প্রবণতা ও প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতির কারণে জনআস্থা বারবার ধাক্কা খেয়েছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জনগণ যখন দেখে নেতৃত্ব পরিবর্তনের প্রকৃত সুযোগ ব্যাহত হচ্ছে, তখন গণতন্ত্রের প্রতি তাদের আস্থা নষ্ট হয়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (২০২৩)-এর একটি গবেষণা জরিপে দেখা যায়, ৭২.৫% মানুষ মনে করেন রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের স্বার্থের চেয়ে দলীয় স্বার্থকে গুরুত্ব দেয়। ৬৭% মনে করেন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহনশীলতার অভাব আছে। ৫৫% জনগণ মনে করেন বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশ জনআস্থাহীন ও ভীতিকর। অন্যদিকে, গ্যালাপ ওয়ার্ল্ড পোল (২০২২) এর গবেষণায় দেখা যায়, মাত্র ৩১% বাংলাদেশি রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আস্থা প্রকাশ করেছেন—যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম নিম্ন।
এসব পরিসংখ্যান আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতি জনগণের ক্রমবর্ধমান আস্থাহীনতা তুলে ধরে। এটি একটি বিপজ্জনক সংকেত, যা সময়মতো দায়িত্বশীল রাজনৈতিক সংস্কার না হলে গণতন্ত্র, সমাজ ও রাষ্ট্রের অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
রাজনৈতিক নেতাদের দ্বিচারিতা, ক্ষমতায় থাকাকালে এক ধরনের আচরণ এবং ক্ষমতার বাইরে ভিন্নমুখী বক্তব্য, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ব্যর্থতা—সব মিলিয়ে জনগণের মধ্যে রাজনীতির প্রতি এক ধরনের হতাশা তৈরি হয়েছে। জনগণের বিশ্বাস জন্মাচ্ছে যে, রাজনীতি এখন আর সেবার ক্ষেত্র নয়, বরং ক্ষমতা ও সুবিধাভোগের মাধ্যম।
এই আস্থাহীনতা কেবল রাজনৈতিক পরিসরে সীমাবদ্ধ নয়, তা সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। সমাজে আজ যে নৈতিক অবক্ষয়, আত্মকেন্দ্রিকতা ও ভোগবাদী মানসিকতা বিস্তার লাভ করেছে, তা সামাজিক বন্ধনকে দুর্বল করেছে। পারিবারিক মূল্যবোধ, প্রতিবেশী সম্পর্ক, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আত্মিক যোগ এবং ধর্মীয় নেতাদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধও কমে এসেছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব, অপপ্রচার এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিভ্রান্তিকর তথ্য সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করছে। এর ফলে মানুষ একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখে, যা থেকে সৃষ্টি হচ্ছে হিংসা, সহিংসতা ও অপরাধপ্রবণতা। সমাজে আত্মঘাতী প্রবণতাও দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।
জনগণের আস্থা যদি প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা বিচার বিভাগের ওপর না থাকে, তবে রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থাই দুর্বল হয়ে পড়ে। দুর্নীতি, পক্ষপাতিত্ব, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং জবাবদিহির অভাব রাষ্ট্রের ওপর আস্থা নষ্ট করে। আইনের শাসন যখন প্রহসনে পরিণত হয়, তখন মানুষ ন্যায়বিচারের আশায় রাষ্ট্রের দিকে না তাকিয়ে নিজের হাতে আইন তুলে নিতে চায়। এ অবস্থায় গণতন্ত্র, শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা সবকিছুই হুমকির মুখে পড়ে।
আজকের সমাজে দায়িত্ব পালনের চেয়ে ক্ষমতা চর্চার প্রবণতা বেশি। রাজনীতিতে নীতি নয়, দল; ন্যায় নয়, সুবিধা; আদর্শ নয়, আত্মস্বার্থ প্রাধান্য পাচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিশ্বাস জন্মায় যে, কেউ তাদের কথা ভাবে না, কারও কাছে তারা জবাবদিহির দাবিদার নয়। ফলে সমাজে হতাশা ও নৈরাজ্যের আবহ সৃষ্টি হয়।
আস্থাহীনতার প্রভাব বহুমাত্রিক ও সুদূরপ্রসারী: ১. গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়ে – ভোটার অনাগ্রহ বাড়ে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ কমে যায়। ২. আইনের প্রতি শ্রদ্ধা কমে – অপরাধী পার পেয়ে গেলে মানুষ আইনকে গুরুত্ব দেয় না। ৩. সামাজিক একতা বিনষ্ট হয় – আস্থাহীনতা বিভক্তি, বিদ্বেষ ও সংঘাতের জন্ম দেয়। ৪. উন্নয়নের গতি স্তিমিত হয় – রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।
এই সংকট থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হচ্ছে দায়িত্বশীল আচরণ—যা কেবল রাজনীতিকদের জন্য নয়, বরং সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। প্রথমত, রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনতে স্বচ্ছ, সৎ ও জবাবদিহিমূলক রাজনীতির চর্চা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষাব্যবস্থায় মানবিকতা, সহনশীলতা ও নৈতিকতা ভিত্তিক পাঠ্যক্রম চালু করতে হবে। তৃতীয়ত, গণমাধ্যমকে নিরপেক্ষ থেকে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য পরিবেশন করতে হবে—তথ্যকে হাতিয়ার না বানিয়ে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। চতুর্থত, নাগরিক সমাজ, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহকে আস্থা ও সহমর্মিতার পরিবেশ তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। পঞ্চমত, প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থায় পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে।
আস্থা হলো একটি রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তি। যদি তা ভেঙে পড়ে, তবে রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যান্য অঙ্গও ধসে পড়ে। বাংলাদেশের আজকের রাজনীতিতে যে আস্থার সংকট আমরা দেখছি, তা কেবল ব্যক্তিগত বা দলীয় ব্যর্থতা নয়; এটি একটি সামগ্রিক সাংস্কৃতিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের বহিঃপ্রকাশ। তবে এটিকে রোধ করা সম্ভব—নেতৃত্বে নৈতিকতা, সমাজে সহানুভূতি এবং শাসনে ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। জনগণের হারানো আস্থা ফিরিয়ে আনাই হবে জাতির আগামী প্রজন্মের প্রতি আমাদের দায়িত্ব।
লেখক: বেসরকারি গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী।
২২১ বার পড়া হয়েছে