কেন খলিলের অপসারণ দাবি!

রবিবার, ২৫ মে, ২০২৫ ১২:৪৯ অপরাহ্ন
শেয়ার করুন:
বিএনপি সম্প্রতি ড. খলিলুর রহমানের কিছু বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেছে, বিশেষ করে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়ে মন্তব্য করার কারণে।
বিএনপি দাবি করেছে, তার বক্তব্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং তিনি বিদেশি স্বার্থ রক্ষা করছেন—এমন অভিযোগও তুলেছে। বিএনপি তার অপসারণ দাবি করেছে এবং তার নাগরিকত্ব ও অতীত অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
বিএনপি ও কিছু রাজনৈতিক মহল ড. খলিলুর রহমানের বিরুদ্ধে “আরাকান আর্মিকে করিডর দেওয়া” এবং “বিদেশি নাগরিকত্ব” সংক্রান্ত অভিযোগ তুলেছে। ড. খলিলুর রহমান এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং নিজেকে বাংলাদেশের নাগরিক বলে দাবি করেছেন।
ড. খলিলুর রহমান তারেক রহমান সম্পর্কে মূলত একটি তুলনামূলক মন্তব্য করেছিলেন, যা বিএনপি’র তীব্র প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনার জন্ম দেয়। তিনি বলেন:
“যদি আমাকে শুধু যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করার কারণে বিদেশি নাগরিক বলা হয়, তাহলে একই যুক্তিতে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান—যিনি দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন—তাকেও একইভাবে বিদেশি নাগরিক বলা যেতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “আপনি যদি আমার দিকে পাথর ছোড়েন, সেটি অন্য কারও গায়েও লাগতে পারে।” এ বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি বিএনপি’র পক্ষ থেকে তার নাগরিকত্ব নিয়ে ওঠা প্রশ্নের জবাব দেন এবং মন্তব্য করতে সাবধানতা অবলম্বনের আহ্বান জানান। বিএনপি এই মন্তব্যকে “তারেক রহমানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা” এবং “রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” বলে আখ্যা দেয়, এবং ড. খলিলুর রহমানের অপসারণ দাবি করে।
ড. খলিলুর রহমান বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (National Security Adviser) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এর আগে জাতিসংঘে দীর্ঘ সময় উচ্চ পর্যায়ের পদে ছিলেন এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতকোত্তর, এরপর যুক্তরাষ্ট্রের টাফটস বিশ্ববিদ্যালয় ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে MA এবং PhD ডিগ্রি অর্জন করেন। তার পেশাগত জীবন ও শিক্ষাগত যোগ্যতা নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য।
ভারত-বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা ক্রয় ও বাতিল করা প্রসঙ্গ। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে ভারত থেকে সামরিক সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, এবং এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একাধিক চুক্তি রয়েছে। সম্প্রতি ২১ মিলিয়ন ডলারমূল্যের একটি ভারতীয় জাহাজ ক্রয়াদেশ বাতিল করেছে বাংলাদেশ। নতুন প্রশাসনের “কৌশলগত ও নিরাপত্তা মূল্যায়ন” এবং “স্বাধীনতা রক্ষার অঙ্গীকার” বলেই উল্লেখ করা হয়েছে। ভারতীয় সরঞ্জামে গোপন ট্র্যাকার বসানো থাকতে পারে যা যুদ্ধের সময় সেগুলো সহজে অবস্থান এবং ধ্বংস করা যেতে পারে। ভারতের সাথে ২১ মিলিয়ন ডলারের জাহাজ (অ্যাডভান্সড ওশান-গোয়িং টাগবোট) কেনার চুক্তিটি ২০২৪ সালের জুলাই মাসে স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
চুক্তিটি বাংলাদেশের নৌবাহিনীর ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ডিফেন্স পারচেজেস (DGDP) এবং ভারতের কলকাতা-ভিত্তিক গার্ডেন রিচ শিপবিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স (GRSE)-এর মধ্যে ঢাকায় স্বাক্ষরিত হয়।
চুক্তির আওতায় ৬১ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি টাগবোট নির্মাণ ও সরবরাহের কথা ছিল এবং এটি ভারতের ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ডিফেন্স লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় প্রথম বড় প্রকল্প ছিল।
চুক্তি স্বাক্ষরের ঠিক এক মাস পর, ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে এবং এই চুক্তি ২০২৫ সালের ২১ মে মাসে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তিটি বাতিল করে।
এছাড়াও সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকারউজ-জামান ড. খলিলুর রহমানের (জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা) ওপর ক্ষিপ্ত হওয়ার পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে॥
ড. খলিলুর রহমানকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (NSA) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় সেনাপ্রধানের বিদেশ সফরের সময়, এবং এই পদটি তৈরি করা হয় মূলত সামরিক বাহিনীর নিরাপত্তা-নিয়ন্ত্রণের বাইরে একটি সমান্তরাল কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে। এতে সেনাপ্রধানের কর্তৃত্ব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে, যা সেনাবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে।
ড. খলিলুর রহমান NSA হওয়ার পরপরই ২০-২৫ জন ব্রিগেডিয়ার ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদমর্যাদার সেনা কর্মকর্তাকে নিয়ে নিজের ব্যক্তিগত সচিবালয় গঠনের দাবি তোলেন। সেনা সদর দপ্তর এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে, কারণ এতে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ কাঠামোতে হস্তক্ষেপ হয় এবং সেনাপ্রধানের কর্তৃত্ব ক্ষুণ্ন হয়।
ড. খলিলুর রহমান রাখাইন স্টেটে (মিয়ানমার) “হিউম্যানিটারিয়ান করিডর” বা মানবিক করিডর গঠনের ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে চেয়েছিলেন, যা সেনাপ্রধানসহ সেনাবাহিনীর একটি বড় অংশের কাছে অত্যন্ত বিতর্কিত। সেনাপ্রধান মনে করেন, এতে বাংলাদেশ অপ্রত্যক্ষভাবে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে এবং ভারত, চীন, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জটিল হতে পারে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার সংকট, সামরিক-বেসামরিক সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সঙ্গে জটিলতা—এই তিনটি ফ্রন্টে লড়াই করছে বাংলাদেশ। জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য জরুরি ভিত্তিতে রাজনৈতিক ঐক্য, সেনাবাহিনীর সাথে সমন্বয়, এবং স্বচ্ছ নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়া প্রয়োজন। অন্যথায়, এই সংকট দীর্ঘমেয়াদি অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে।
ড. খলিলুর রহমানের মতো আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন, অভিজ্ঞ ও কৌশলী নিরাপত্তা উপদেষ্টা বাংলাদেশের জন্য এই জটিল সময়ে অপরিহার্য। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ কৌশলগত স্বার্থ, নিরাপত্তা ও মানবিক চ্যালেঞ্জে আরও দক্ষতার সঙ্গে এগোতে পারবে। রাজনৈতিক বিতর্ক বা বিভ্রান্তি নয়, বরং দেশের স্বার্থ ও স্থিতিশীলতার জন্য তার মতো দক্ষ নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা এখন আরও গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট
১১৭ বার পড়া হয়েছে