প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে দ্বিচারিতা

শনিবার, ২৪ মে, ২০২৫ ৮:০৫ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ, নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের গর্ব। ক্ষুদ্রঋণের ধারণা দিয়ে তিনি শুধু বাংলাদেশের নয়, গোটা বিশ্বের দরিদ্র জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ খুলে দিয়েছেন।
অথচ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাঁকে ঘিরে যে অবমাননাকর ও বিতর্কিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে প্রশ্ন উঠছে—ড. ইউনূসকে কি আদৌ তাঁর অবদানের প্রাপ্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে? কিংবা, কারা তাঁকে অব্যাহতভাবে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে কোণঠাসা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে?
১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে ড. ইউনূস দরিদ্রদের মাঝে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের কার্যক্রম শুরু করেন। এটি কেবল আর্থিক সহায়তা নয়, বরং আর্থসামাজিক ক্ষমতায়নের এক বৈপ্লবিক মডেল হয়ে ওঠে। এই মডেল বিশ্বজুড়ে অনুসরণীয় রূপ ধারণ করে। ২০০৬ সালে তিনি ও গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন—যা বাংলাদেশের জন্য এক গৌরবজনক অর্জন।
ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে সরকারি মহলে বিদ্বেষ জন্ম নেয় মূলত ২০০৭ সালে, যখন তিনি “স্বচ্ছ রাজনীতি” নামে একটি রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তাঁর এই উদ্যোগ তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হয়। যদিও তিনি পরে রাজনীতিতে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তবে এই প্রয়াস তাঁকে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর চোখে “অস্বস্তিকর” করে তোলে।
দীর্ঘদিন স্বায়ত্তশাসিতভাবে পরিচালিত গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টাও ড. ইউনূসকে কোণঠাসা করার পরিকল্পনার অংশ বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। ২০১১ সালে “অবসরের বয়স অতিক্রম করেছেন” এই অজুহাতে তাঁকে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্টের রায় এই অপসারণকে বৈধতা দিলেও, অনেকেই একে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফল হিসেবে দেখেন।
পরবর্তীকালে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে সরকারের হস্তক্ষেপ, ইউনূস-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিভিন্ন তদন্তে জড়ানো, এবং তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের—এসবই তাঁকে সামাজিক ও প্রশাসনিকভাবে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে চিহ্নিত।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইউনূস ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ কমিউনিকেশনসসহ তাঁর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘন, কর ফাঁকি ও অর্থনৈতিক অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়। যদিও ড. ইউনূস এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং সেগুলোকে হয়রানিমূলক বলেছেন, তবু নিয়মিত হাজিরা, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও জরিমানার মতো আইনি হয়রানির মাধ্যমে তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে বিপর্যস্ত করার চেষ্টা চলে।
ড. ইউনূসের প্রতি রাষ্ট্রীয় আচরণ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। ২০২৩-২৪ সালে ৪০টিরও বেশি দেশের ১৭০ জনের অধিক নোবেলজয়ী, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব, ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দ, মার্কিন কংগ্রেস সদস্যরা বাংলাদেশের সরকারকে চিঠি দিয়ে ড. ইউনূসের প্রতি সুবিচার নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। তাঁরা বলেন, “এমন একজন মানুষ, যিনি কোটি মানুষের জীবন বদলে দিয়েছেন, তাঁকে বিচারিক হয়রানির মুখে ফেলা শুধু দুঃখজনক নয়, এটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী।”
ড. ইউনূস সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন।গত দুইদিন ধরে এই গুঞ্জনই চলছিলো সামাজিক মাধ্যম ও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে। এটি স্বতঃস্ফূর্ত নয়, বরং সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক চাপ, প্রশাসনিক অসহযোগিতা এবং সামাজিক প্রতিহিংসার একটি কৌশলী জবাব। তিনি জানেন, রাষ্ট্রের ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু নৈতিক উচ্চতা ও মানবিক অবদান চিরস্থায়ী। তাঁর এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক সংকট,জন মনে আস্থা হীনতা ও বিশ্বাস বিনষ্ট এবং আন্তর্জাতিক মহলের সাথে অঘনিষ্ঠতা তলানিতে নেমে যাবে।
ড. ইউনূস নিজে কখনোই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে চাননি, তবে তাঁর আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা তাঁকে একপ্রকার ‘বিকল্প রাষ্ট্রনায়ক’ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। আর এটাই হয়তো বর্তমান দেশের অপরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদদের অস্বস্তির কারণ। বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ভিন্নমত বা বিকল্প নেতৃত্বকে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী সহ্য করতে চায় না—এটি অনেকটাই স্পষ্ট। তাঁর স্বাধীনচেতা অবস্থান, সরকারনিরপেক্ষতা এবং আন্তর্জাতিক উচ্চতা একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিগত দিনগুলোতে ড. ইউনূসের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ইতিহাস নয়, এটি বাঙালির আত্মঘাতী মনোবৃত্তিরও প্রতিচ্ছবি। আমরা নিজেদের নায়ক সৃষ্টি করতে পারি না, আবার যিনি নায়ক হয়ে ওঠেন—তাঁকে সম্মান দিতেও ব্যর্থ হই। কিন্তু ইতিহাস চিরকাল সত্যকে স্মরণ করে, মিথ্যাকে বিস্মৃত করে। পরশ্রী কাতরতা আমাদের মন মানসিকতা কে নস্যাৎ করে অন্যের প্রতি সম্মানবোধ, বিনয় ও নম্রতা দেখানোর পরিবর্তে প্রতিহিংসা বা বৈরী মনোভাবাপন্নের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়, যা শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ডক্টর ইউনুস এর সাথে বিগত দিনে লক্ষ্য করা গেছে।
ড. ইউনূসের পদত্যাগ একটি নৈতিক অবস্থানের প্রতীক। এটি একটি রাষ্ট্রীয় সংকেতও বটে—যেখানে একজন নোবেলজয়ীকেও নিরাপদ জায়গা দেওয়া হয় না। তাঁর প্রতি রাষ্ট্রের এই আচরণ আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কৃতির এক করুণ দলিল। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এই বিদ্বেষ তাঁকে ভাঙতে পারেনি। বরং, তিনি আজও তাঁর নৈতিক উচ্চতা ও উদারতার মাধ্যমে অনন্য হয়ে আছেন—দেশের গৌরব হিসেবে, ইতিহাসের আলোর মুখ হিসেবে।
লেখক: বেসরকারি গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী।
৩৬৫ বার পড়া হয়েছে