ইসরাইলের বর্বরতায় গাজা মৃত্যুপুরী
বিশ্বমানবতার দিকে তাকিয়ে ফিলিস্তিন

বৃহস্পতিবার , ২২ মে, ২০২৫ ৪:৫০ অপরাহ্ন
শেয়ার করুন:
গাজায় চলমান গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন শুধু একটি অঞ্চলের সংকট নয়—এটি বৈশ্বিক নৈতিকতা, মানবিকতা ও আন্তর্জাতিক আইনের চরম ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্বৈত মানদণ্ড, রাজনৈতিক স্বার্থ ও কার্যকর উদ্যোগের অভাবে ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্ভোগ দিন দিন বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে মানবতা, ন্যায়বিচার ও বিশ্ববিবেকের পুনর্জাগরণ ছাড়া স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়—তবে দেরি হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে গোটা মানবজাতি।
গাজায় ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ইসরাইলের নির্বিচার গুলি ও বোমা বর্ষণ এবং এর ফলে ব্যাপক প্রাণহানি ও মানবিক বিপর্যয় নিয়ে বিশ্ব মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা বা সীমিত প্রতিক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন বহুবার উঠেছে। এই নীরবতার পেছনে একাধিক রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে।
ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ:
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইসরাইলের প্রধান মিত্র এবং সমর্থক। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর ইসরাইলকে বিপুল সামরিক সহায়তা দেয় এবং জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবগুলো বারবার ভেটো দেয়। পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ ইসরাইলের সঙ্গে জড়িত, ফলে তারা সরাসরি কঠোর অবস্থান নিতে চায় না।
মুসলিম দেশগুলো রাজনৈতিক বিভাজন, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক সংকট এবং পশ্চিমা দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার কারণে কার্যকর ও ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। সৌদি-ইরান বৈরিতা, মিশরের সীমান্তনীতি, কাতার-তুরস্কের কৌশলগত পার্থক্য—এসব কারণে সম্মিলিত কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি হয়নি।
জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা মানবিক বিপর্যয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও, তাদের হাতে কার্যকর সামরিক বা রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করার ক্ষমতা নেই, বিশেষ করে যখন স্থায়ীসদস্যরা (যেমন যুক্তরাষ্ট্র) ভেটো দেয়।
আন্তর্জাতিক আদালতের আদেশও অনেক সময় রাজনৈতিক কারণে বাস্তবায়িত হয় না। জাতিসংঘের বিশেষ কমিটি ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগ তুলেছেন। তারা বলেছেন, ইসরাইলের কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং এটি গণহত্যার বৈশিষ্ট্য বহন করে। আন্তর্জাতিক আদালত (ICJ) ইসরাইলকে গণহত্যা প্রতিরোধে কিছু পদক্ষেপ নিতে বলেছে, তবে বাস্তবে যুদ্ধ বন্ধ হয়নি। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, যেমন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, বারবার নিন্দা জানালেও কার্যকর চাপ বা প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি।
গাজায় চলমান মানবিক বিপর্যয় ও ব্যাপক প্রাণহানির পরও বিশ্ব মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা বা সীমিত প্রতিক্রিয়ার মূল কারণ হলো ভূরাজনৈতিক স্বার্থ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক, মুসলিম বিশ্বের বিভাজন, আন্তর্জাতিক সংস্থার সীমাবদ্ধতা এবং তথ্য যুদ্ধ। অনেক দেশ ও সংস্থা নিন্দা জানালেও, কার্যকর চাপ বা প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি—ফলে ইসরাইলের আগ্রাসন অব্যাহত রয়েছে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্ভোগ বাড়ছে।
জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, ইসরাইলের এই হামলা ও অবরোধ শিশু, নারী ও সাধারণ মানুষের ওপর চরম মানবিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে এবং একে গণহত্যা (genocide), যুদ্ধাপরাধ (war crime) ও মানবতাবিরোধী অপরাধ (crime against humanity) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
গাজা অঞ্চলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইতিহাস কী?:
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় প্রায় ৭ লাখ ফিলিস্তিনি, যাদের অনেকে গাজা অঞ্চলে আশ্রয় নেন, উচ্ছেদ ও বাস্তুচ্যুত হন। এই ঘটনা ‘নাকবা’ (বিপর্যয়) নামে পরিচিত এবং এটি ছিল গাজার মানবাধিকার লঙ্ঘনের সূচনা।
২০০৭ সালে হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর ইসরায়েল ও মিশর গাজার ওপর কঠোর স্থল, আকাশ ও সমুদ্র অবরোধ আরোপ করে। এই অবরোধের ফলে গাজার সাধারণ মানুষের চলাচল, চিকিৎসা, শিক্ষা, খাদ্য, পানি ও জ্বালানি সরবরাহ চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গাজাকে “বিশ্বের সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত কারাগার” হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
২০০৮, ২০১২, ২০১৪, ২০২১ এবং সর্বশেষ ২০২৩-২৪ সালে ইসরায়েলি সামরিক অভিযানে গাজায় হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ নিহত ও আহত হয়েছেন। এসব অভিযানে হাসপাতাল, স্কুল, আবাসিক ভবন, শরণার্থী শিবিরসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে। জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এসব হামলাকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও মানবিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর ইসরায়েলি অভিযানে গাজায় কয়েক মাসে ৫০,০০০-এর বেশি মানুষ নিহত, ১ লাখের বেশি আহত এবং লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী ও শিশু রয়েছে।
ইসরায়েলি হামলায় শিশু ও নারীর মৃত্যু অত্যন্ত বেশি। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ১৭,০০০-এর বেশি শিশু নিহত হয়েছে, অনাথ হয়েছ ৩৯,০০০-এর বেশি শিশু।
অবরোধ ও হামলার কারণে খাদ্য, পানি, চিকিৎসা সংকটে হাজার হাজার শিশু অপুষ্টি ও মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়েছে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ গাজায় সংঘটিত সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্তে একাধিকবার প্রস্তাব পাস করেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান ও অন্যান্য সংস্থা ইসরায়েলি হামলাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচনা করার কথাও বলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু পশ্চিমা দেশ ইসরায়েলি হামলায় তাদের সরবরাহকৃত অস্ত্র ব্যবহারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
গণহত্যার বিবরণ (গত এক মাসে):
গত এক মাসে ইসরাইল গাজা অঞ্চলে ব্যাপক বিমান হামলা, স্থল অভিযান ও নির্বিচার গোলাবর্ষণ চালিয়েছে। শুধু গত সপ্তাহেই ৪৬৪ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। মে মাসের মাঝামাঝি, খান ইউনিসের আল-মাওয়াসি এলাকায় শরণার্থী শিবিরে টেন্টে ঘুমিয়ে থাকা শিশুদের ওপর বিমান হামলায় অন্তত ৩৬ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছে। একই দিনে মোট ১৩২ জন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে তিনজন সাংবাদিকও রয়েছেন।
ইসরাইলি বাহিনী পরিকল্পিতভাবে হাসপাতাল, চিকিৎসাকেন্দ্র ও জরুরি সেবার ওপর হামলা চালিয়ে সেগুলো অকার্যকর করে ফেলেছে। গত সপ্তাহেই দুটি হাসপাতাল সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়েছে এবং উত্তর গাজার শেষ সরকারি হাসপাতাল ইন্দোনেশিয়া হাসপাতালও কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে।
মানবিক সহায়তা বাধা ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন:
ইসরাইল গত এক মাসে আবারও গাজায় সব ধরনের মানবিক সহায়তা, খাদ্য, পানি, ওষুধ ও জ্বালানি প্রবেশ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করেছে। মার্চ ২০২৫ থেকে এই অবরোধ আরও কঠোর হয়েছে, ফলে গাজার অধিকাংশ মানুষ চরম অনাহার ও অপুষ্টিতে ভুগছে।
আন্তর্জাতিক আদালত (ICJ) জানুয়ারি ২০২৪-এ ইসরাইলকে গাজায় অবিলম্বে মানবিক সহায়তা প্রবেশের নির্দেশ দেয়। কিন্তু ইসরাইল এই আদেশ অমান্য করে বারবার ত্রাণ প্রবেশে বাধা দিয়েছে, যা আন্তর্জাতিক মানবিক আইন ও চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের সরাসরি লঙ্ঘন।
যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, সৌদি আরব, কাতারসহ বহু দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ইসরাইলের এই মানবিক সহায়তা বাধাকে আন্তর্জাতিক আইন ও যুদ্ধবিরতির শর্ত লঙ্ঘন বলে নিন্দা জানিয়েছে।
গাজা অঞ্চলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইতিহাস মূলত দখল, অবরোধ, সামরিক অভিযান, গণহত্যা, শিশু ও নারী হত্যাসহ চলমান মানবিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বারবার এসব লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সরব হলেও কার্যকর প্রতিকার আজও অধরা।
গাজা অঞ্চলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইতিহাস দীর্ঘ, জটিল এবং বহুস্তরবিশিষ্ট। এই অঞ্চলের জনগণ বহু দশক ধরে দখল, অবরোধ, সামরিক অভিযান ও রাজনৈতিক সংকটের কারণে চরম মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে।
ইসরাইল কিভাবে দেশ হলো?:
উনিশ শতকের শেষভাগে ইউরোপে ইহুদি জনগণের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্যাতন ও বৈষম্যের কারণে “সিয়োনবাদ” (Zionism) আন্দোলনের জন্ম হয়। এর লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনে (তৎকালীন অটোমান ও পরে ব্রিটিশ শাসিত অঞ্চল) ইহুদি জাতির জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশেষ করে ইউরোপ থেকে বিপুল সংখ্যক ইহুদি ফিলিস্তিনে অভিবাসন শুরু করেন, যার ফলে স্থানীয় আরব জনগণের সঙ্গে সংঘাত বাড়তে থাকে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ফিলিস্তিন অঞ্চল ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আসে (ব্রিটিশ ম্যান্ডেট)। ব্রিটিশ সরকার ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণা (Balfour Declaration)-তে ইহুদি “জাতীয় আবাস” প্রতিষ্ঠার প্রতি সমর্থন জানায়। ১৯৪৭ সালে ব্রিটেন তাদের শাসন শেষ করার ঘোষণা দিলে জাতিসংঘ ফিলিস্তিন বিভাজনের পরিকল্পনা (UN Partition Plan, Resolution 181) গ্রহণ করে। এতে অঞ্চলটিকে দুটি রাষ্ট্রে—একটি ইহুদি, একটি আরব—বিভক্ত করার প্রস্তাব ছিল। জেরুজালেমকে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে রাখার কথা বলা হয়। ইহুদি নেতারা এই পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, কিন্তু ফিলিস্তিনি আরব ও আশেপাশের আরব দেশগুলো তা প্রত্যাখ্যান করে এবং শুরু হয় সংঘাত। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে, ব্রিটিশ শাসনের অবসানের ঠিক আগে, ইহুদি এজেন্সির প্রধান ডেভিড বেন-গুরিয়ন তেলআবিবে আনুষ্ঠানিকভাবে “ইসরাইল রাষ্ট্র” প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। পরদিন আশেপাশের আরব দেশগুলো ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে (১৯৪৮ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধ)। এই যুদ্ধে ইসরাইল কেবল জাতিসংঘ নির্ধারিত ৫৬% নয়, বরং ফিলিস্তিনের ৭৭% ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণে নেয়। পশ্চিম তীর জর্ডান ও গাজা মিশরের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এই যুদ্ধের ফলে প্রায় ৭ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হন, যাদের অধিকাংশই আর কখনো নিজ ভূমিতে ফিরে যেতে পারেননি। আরব দেশ ও ফিলিস্তিনি জনগণের বিরোধিতার মুখে যুদ্ধ ও ব্যাপক বাস্তুচ্যুতির মধ্য দিয়ে ইসরাইলের জন্ম হয়।
বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের অনেকে পশ্চিম তীর, গাজা, পূর্ব জেরুজালেম, লেবানন, জর্ডান, সিরিয়া ও অন্যান্য আরব দেশে উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নেন। আনুমানিক ১,৫০,০০০ ফিলিস্তিনি তাদের ভূমিতে থেকেই যান, যারা পরে ইসরাইলি নাগরিকত্ব পান। তবে তাদের অধিকাংশ জমি রাষ্ট্র কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয় এবং ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত তারা সামরিক আইনের অধীনে নানা বিধিনিষেধের মধ্যে জীবনযাপন করেন।
ফিলিস্তিনিদের ইতিহাস:
ফিলিস্তিন অঞ্চল হাজার বছর ধরে নানা জাতি ও সভ্যতার আবাসস্থল। উনিশ শতকের শেষভাগে ইউরোপে সিয়োনবাদী (Zionist) আন্দোলন শুরু হলে ফিলিস্তিনে ইহুদি অভিবাসন বাড়তে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে চাইলে, জাতিসংঘ ১৯৪৭ সালে ফিলিস্তিনকে দুটি রাষ্ট্র—একটি ইহুদি, একটি আরব—এইভাবে ভাগ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে (UN Partition Plan)। ইহুদি নেতারা পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও আরব ও ফিলিস্তিনি নেতারা তা প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৮৮ সালের ১৫ নভেম্বর আলজিয়ার্সে নির্বাসিত প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (PLO) ও প্যালেস্টাইন জাতীয় পরিষদ (PNC) একপাক্ষিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এই ঘোষণার সময় বাস্তবে কোনো ভূখণ্ড তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না, তবে তারা গাজা, পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের অংশ হিসেবে দাবি করে। স্বাধীনতা ঘোষণার পর ১৩৮টিরও বেশি দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তবে আজও ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা ও ভূখণ্ডের ওপর সার্বভৌম নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়নি—এখনো তা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, দখলদারিত্ব ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
বিশ্বজুড়ে ফিলিস্তিনি জনগণের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৪৩ লাখ। এর মধ্যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের (গাজা, পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম) অভ্যন্তরে বসবাস করেন আনুমানিক ৭৫ লাখ ফিলিস্তিনি। এরমধ্যে গাজা উপত্যকায় প্রায় ২১.৭ লাখ এবং পশ্চিম তীরে: প্রায় ৩১.৯ লাখ এখন বসবাস করছে।
প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস (ফাতাহ দল) এবং প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মুস্তাফা (২০২৪ সাল থেকে) নেতৃত্বে পশ্চিম তীর ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ফিলিস্তিন সরকারের প্রধান প্রশাসনিক দায়িত্বে ফিলিস্তিনি জাতীয় কর্তৃপক্ষ (Palestinian Authority, PA)।
গাজা উপত্যকায় ২০০৭ সাল থেকে হামাস ডি-ফ্যাক্টো (বাস্তবিক) শাসক হিসেবে কার্যত নিয়ন্ত্রণ করছে।
আন্তর্জাতিকভাবে ফিলিস্তিনি জনগণের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃত সংগঠন হলো প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (PLO)। পিএ ও পিএলওর নেতৃত্বও মাহমুদ আব্বাসের হাতে, যদিও বাস্তবিক ক্ষমতা পশ্চিম তীর ও গাজার মধ্যে বিভক্ত।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জাতিসংঘের পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ পেতে বাধা কোথায়?:
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদের জন্য প্রস্তাব উঠলে, অন্তত ৯টি সদস্যের সমর্থন এবং পাঁচ স্থায়ী সদস্যের (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন) মধ্যে কোনো ভেটো না থাকলেই তা পাশ হয়। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে ইসরাইলের প্রধান মিত্র হিসেবে ফিলিস্তিনের সদস্যপদ প্রস্তাবে ভেটো দিয়ে আসছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিনের সদস্যপদ প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ভেটো দেয়।
ইসরাইলের প্রধান রক্ষাকবচ যুক্তরাষ্ট্র, তারা জাতিসংঘে ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করে সবসময় ইসরাইলের বিরুদ্ধে যেকোনো কঠোর প্রস্তাব আটকে দিয়ে আসছে।
গাজা সংকটে পশ্চিমা দেশগুলোর ভূমিকা:
যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকেই ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়ে আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্রের মতোই, ইসরায়েলের নিরাপত্তার অধিকারের পক্ষে কথা বলেছে এবং হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
পশ্চিমা দেশগুলো শুরুতে ইসরায়েলের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিলেও, গাজায় বেসামরিক প্রাণহানি ও মানবিক বিপর্যয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু দেশ (বিশেষত ব্রিটেন, ফ্রান্স, কানাডা) ইসরায়েলের ওপর চাপ বাড়িয়েছে এবং নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বৃহৎ অংশ এখনো ইসরায়েলের নিরাপত্তার পক্ষে অবস্থান করছে এবং কার্যকর আন্তর্জাতিক চাপ গড়ে ওঠেনি। ত্রাণ সহায়তা বন্ধ, দ্বৈত নীতি ও কৌশলগত দ্বিধা—এসবই পশ্চিমা বিশ্বের ভূমিকার বৈশিষ্ট্য।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ফিলিস্তিনি জনগণের উপর গণহত্যার প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে একাধিক বাকস্বাধীনতা বিরোধী পদক্ষেপ নিয়েছেন, যা বিশেষভাবে প্রবাসী ও মুসলিম শিক্ষার্থী, ফিলিস্তিনি অধিকারকর্মী এবং সমর্থকদের ওপর প্রভাব ফেলছে। ট্রাম্প সতর্ক করেছেন, কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যদি “অবৈধ” বা “ইসরাইলবিরোধী” বিক্ষোভ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তাদের ফেডারেল অর্থায়ন বন্ধ করে দেওয়া হবে।
বর্তমান অবস্থা:
গাজা ও ফিলিস্তিনের জনগণ এখন চরম মানবিক বিপর্যয়, অনাহার, বাস্তুচ্যুতি ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। ইসরাইলের সামরিক অভিযানে হত্যাযজ্ঞের মাত্রা নজিরবিহীন—প্রায় ৫৪ হাজার মানুষ নিহত, লক্ষাধিক আহত, অধিকাংশ শিশু ও নারী দুর্ভিক্ষের মুখে। অবরোধ ও পরিকল্পিত হামলায় জীবনধারণের সব শর্ত ধ্বংস হয়ে গেছে, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও মানবিক আইনের সরাসরি লঙ্ঘন। ১১ সপ্তাহের পূর্ণ অবরোধের পর সামান্য ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি মিললেও, অধিকাংশ ট্রাক সীমান্তেই আটকা, মাত্র হাতে গোনা কিছু ত্রাণই মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে। নিরাপত্তা, লুটপাট ও ইসরাইলি সেনাবাহিনীর অনুমতির জটিলতায় ত্রাণ বিতরণ কার্যত অকার্যকর।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, গাজা পুরোপুরি দখল না নেওয়া পর্যন্ত ইসরায়েল যুদ্ধ চালিয়ে যাবে এবং শেষ পর্যন্ত গাজার প্রতিটি ইঞ্চি ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আসবে। তিনি এই অভিযানকে “চূড়ান্ত ধাপ” হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন, হামাসকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত ও নিরস্ত্র করা, তাদের নেতৃত্বকে নির্বাসনে পাঠানো এবং গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নই যুদ্ধ বন্ধের শর্ত।
অক্টোবর ২০২৩ থেকে মে ২০২৫ পর্যন্ত গাজায় কমপক্ষে ৫৩,৬৫৫ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১,২১,৯৫০ জন আহত হয়েছে। নিহতদের উল্লেখযোগ্য অংশ নারী ও শিশু। গত এক মাসে ইসরাইলি বাহিনী শরণার্থী শিবির, হাসপাতাল, স্কুল, আবাসিক ভবন, এমনকি তাবুতে আশ্রিত বাস্তুচ্যুতদের ওপরও হামলা চালিয়েছে। শুধু গত ১৭-১৮ মে রাতেই ৯৬ জন নিহত, এর মধ্যে ৩৬ জন আইডিপি (বাস্তুচ্যুত) তাবুতে মারা গেছে।
শিশু আয়াত ও তার মায়ের গল্প:
গাজার উত্তরের শহরতলিতে আট বছরের ছোট্ট আয়াত তার মা লায়লার হাত ধরে আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে ছুটছিল। তাদের বাড়ি আগেই বোমায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। বাবা, দাদু—সবাই মারা গেছেন। মা-ই ছিল আয়াতের একমাত্র আশ্রয়।
এক রাতে, আশ্রয়কেন্দ্রের পাশের শিশু হাসপাতালটি লক্ষ্য করে বিমান হামলা চলে। বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে চারপাশ। ধোঁয়া আর ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আয়াত মায়ের হাত ছেড়ে ফেলে।
কিছুক্ষণ পর উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে আয়াতকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে। তার মা লায়লা তখন নিথর, রক্তাক্ত। আয়াতের জ্ঞান ফিরলে সে শুধু মাকে খুঁজে কাঁদতে থাকে—
“আম্মু, তুমি কোথায়? আমি তো ভেবেছিলাম হাসপাতাল নিরাপদ…!”
কিন্তু সেই হাসপাতালও আর নেই। আয়াতের ছোট্ট হাত ধরে আর কেউ নেই।
এই কাহিনি শুধু আয়াতের নয়—এটি গাজার হাজার হাজার শিশুর, যারা প্রতিদিন মায়ের কোলে, হাসপাতালের বিছানায়, বা আশ্রয়কেন্দ্রের মেঝেতে প্রাণ হারাচ্ছে।
এটাই গাজার বাস্তবতা—নিরাপত্তাহীনতা, মায়ের কান্না, শিশুর আর্তনাদ, হাসপাতালের ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া স্বপ্ন।
গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর ইসরাইলের চলমান গণহত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আন্তর্জাতিক আইনের অব্যাহত অবজ্ঞা—এই চরম ঘৃণিত ঘটনার উপসংহার অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও উদ্বেগজনক।
গাজায় চলমান গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন শুধু একটি অঞ্চলের সংকট নয়—এটি বৈশ্বিক নৈতিকতা, মানবিকতা ও আন্তর্জাতিক আইনের চরম ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্বৈত মানদণ্ড, রাজনৈতিক স্বার্থ ও কার্যকর উদ্যোগের অভাবে ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্ভোগ দিন দিন বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে মানবতা, ন্যায়বিচার ও বিশ্ববিবেকের পুনর্জাগরণ ছাড়া স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়—তবে দেরি হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে গোটা মানবজাতি।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট
১৪৮ বার পড়া হয়েছে