দৈনিক আন্দোলনের বাজারঃ কুষ্টিয়ার সাংবাদিকতার আলোকবর্তিকা

বৃহস্পতিবার , ৮ মে, ২০২৫ ১২:৪০ অপরাহ্ন
শেয়ার করুন:
কুষ্টিয়ার মাটিতে সাংবাদিকতার আধুনিক বীজ বপন করেছিল যে পত্রিকাটি, তার নাম দৈনিক আন্দোলনের বাজার। আজ এই প্রিয় পত্রিকার জন্মদিন, সুদীর্ঘ ৩৪ বছরের গৌরবময় পথচলায় পদার্পণ করেছে। এই দীর্ঘ যাত্রা কেবল একটি পত্রিকার পথচলা নয়, এটি কুষ্টিয়ার সাংবাদিকতার ইতিহাসের এক অতুজ্জ্বল অধ্যায়।
সাহিত্য ও সংস্কৃতির পাদপীঠ হিসেবে কুষ্টিয়া থেকে আধুনিক সাংবাদিকতার ধারা প্রবর্তন করে আন্দোলনের বাজার। অসংখ্য প্রতিভাবান সাংবাদিকের জন্মও হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের হাত ধরেই। যারা পরবর্তীতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে সাংবাদিকতায় নিজেদের মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন, দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কুষ্টিয়ার মুখ উজ্জ্বল করেছেন তারা।
সংবাদপত্রের রাজধানী কুষ্টিয়া অঞ্চলের সাংবাদিকতার ইতিহাসে দৈনিক আন্দোলনের বাজার একটি অবিচ্ছেদ্য নাম, এক আলোকবর্তিকা। এটি কেবল একটি সংবাদপত্র নয়, বরং আধুনিক সাংবাদিকতার এক পাদপীঠ, যা অসংখ্য প্রতিভাবান সাংবাদিক তৈরি করেছে এবং দেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায় সৃষ্টি করেছে। আন্দোলনের বাজারের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন মনজুর এহসান চৌধুরী, এক দূরদর্শী ব্যক্তিত্ব। তিনি পত্রিকা প্রকাশের জন্য বেছে নিয়েছিলেন এক বিশেষ দিন— বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন, ২৫শে বৈশাখ। এই প্রতীকী নির্বাচনই বলে দেয়, মনজুর এহসান চৌধুরী কেবল সংবাদ পরিবেশনেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, তিনি চেয়েছিলেন মননশীলতার আলো ছড়িয়ে দিতে। কুষ্টিয়ার মতো পিছিয়ে পড়া এক মফস্বল শহর থেকে তিনি প্রথম কম্পিউটারে পত্রিকা প্রকাশের দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন। সংবাদপত্রের জনক কাঙাল হরিনাথ মজুমদার হাতে লিখে কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে পত্রিকা প্রকাশের মতো ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, ঠিক তেমনি মনজুর এহসান চৌধুরীও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে খুলনা বিভাগে সর্বপ্রথম পত্রিকা প্রকাশনায় নবদিগন্ত উন্মোচন করেন। তিনি ছিলেন এক দূরদর্শী ব্যক্তিত্ব, যিনি কুষ্টিয়ার মতো এক মফস্বল শহর থেকেও আধুনিক সাংবাদিকতার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর হাত ধরেই কুষ্টিয়ার সাংবাদিকতায় এক নতুন ইতিহাস-অধ্যায়ের সূচনা হয়।
চরমপন্থী-সন্ত্রাস অধ্যুষিত কুষ্টিয়া অঞ্চলে আধুনিক পত্রিকা প্রকাশনাই ছিল এক বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু জন্মসূত্রে সাংবাদিক মনজুর এহসান চৌধুরী এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে আন্দোলনের বাজারকে শীর্ষ পর্যায়ে নিয়ে যান। তিনি কেবল একটি পত্রিকাই তৈরি করেননি, যিনি তৈরি করেছেন এক ঝাঁক দক্ষ সাংবাদিক, যারা আজ কুষ্টিয়ার সাংবাদিকতা জগতে আইকন হিসেবে পরিচিত। পরবর্তীতে তিনি প্রবাস জীবন বেছে নিলে তাঁর যোগ্য শীর্ষ্য আনিসুজ্জামান ডাবলুর হাতে পত্রিকার সম্পাদনা ও প্রকাশনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। আনিসুজ্জামান ডাবলু তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে এই গুরুদায়িত্ব যথাযথভাবে প্রতিপালন করছেন এবং প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকের মতোই পত্রিকাটির শীর্ষস্থান ধরে রেখেছেন কুষ্টিয়া অঞ্চলজুড়ে।
মনজুর এহসান চৌধুরী ছিলেন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের অগ্রদূত। তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি কুষ্টিয়ায় কম্পিউটার কম্পোজে পত্রিকা প্রকাশনার কাজ শুরু করেন। যেখানে কাঙাল হরিনাথ মজুমদার হাতে লিখে কুমারখালী থেকে ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকা প্রকাশ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, সেখানে মনজুর এহসান চৌধুরী আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পত্রিকা প্রকাশনায় এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। চরমপন্থী-সন্ত্রাস অধ্যুষিত কুষ্টিয়া অঞ্চলে এমন একটি আধুনিক পত্রিকা প্রকাশ করে শীর্ষে নেওয়া ছিল এক বিশাল চ্যালেঞ্জ, যা তিনি সফলভাবেই মোকাবেলা করেন।
মনজুর এহসান চৌধুরী শুধু একটি পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেননি, তিনি এক ঝাঁক প্রতিভাবান সাংবাদিকও তৈরি করেছেন। কুষ্টিয়ার সাংবাদিকতা জগতে তিনি এক আইকন হিসেবেও পরিচিত। পরবর্তীতে তিনি প্রবাস জীবন বেছে নিলে তাঁর যোগ্য শিষ্য আনিসুজ্জামান ডাবলুকে সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে দায়িত্ব দেন। আনিসুজ্জামান ডাবলু তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে এই গুরুদায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছেন এবং পত্রিকাটিকে শীর্ষস্থানে ধরে রেখেছেন। তাঁর নেতৃত্বে আন্দোলনের বাজার আজও কুষ্টিয়া অঞ্চলের অন্যতম প্রভাবশালী ও সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা। বস্তুনিষ্ঠ তথা নান্দনিক সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি আধুনিক প্রকাশনায় এই পত্রিকাটি আজও সবার থেকে এগিয়ে। আন্দোলনের বাজারের সাংবাদিকরাও প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকের দেখানো পথে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন।
আনিসুজ্জামান ডাবলুর নেতৃত্বে দৈনিক আন্দোলনের বাজার আজও কুষ্টিয়া অঞ্চলে প্রভাবশালী ও শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা হিসেবে তার অবস্থান অক্ষুণ্ণ রেখেছে। পরিশীলিত সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি প্রকাশনার মানেও এটি শীর্ষে রয়েছে। আন্দোলনের বাজারের সাংবাদিকরা তাদের বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ধারাকে অব্যাহত রেখেছেন, যা এই পত্রিকার মূলশক্তি।
আন্দোলনের বাজার কেবল একটি সংবাদপত্র নয়, এটি একটি প্রতিষ্ঠান, একটি পরিবার। এই পত্রিকার হাত ধরেই বহু প্রতিভাবান সাংবাদিক তাদের কর্মজীবন শুরু করেছেন এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এই পত্রিকায় বিভিন্ন সময় কাজ করেছেন এমন উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে রয়েছেন- এসএম হালিমুজ্জামান, শামসুল আলম স্বপন, জামাল উদ্দীন হায়দারী, শাহ আরিফ নিশির, আদিত্য শাহীন, রনজক রিজভী, মুন্সী তরিকুল ইসলাম, তারিকুল হক তারিক, নুর আলম দুলাল, আল মামুন সাগর, মোঃ জাহিদুজ্জামান, রেজাউল করিম, শরীফ বিশ্বাস, আ ফ ম নুরুল কাদের, অর্পন মাহমুদ, সুজন হালদার, আরিফ মেহমুদ, এস আই সোহেল, খাইরুল বাসার, শফিকুল ইসলাম শফি, শ্যামল, বরকত, সুমনসহ আরও বহুমানুষ। তাদের অনেকেই পরবর্তীতে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকা ও স্যাটেলাইট টেলিভিশনে কাজ করে দেশের সাংবাদিকতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। কেউ কেউ আজও এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত আছেন। এই দীর্ঘ তালিকায় একজন বিশেষ ব্যক্তির নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয় — তিনি হলেন পত্রিকার মেধাবী ডিজাইনার প্রয়াত সেলিম আহমেদ। অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী এই ব্যক্তি তার ব্যতিক্রমী নান্দনিক ডিজাইনের মাধ্যমে আন্দোলনের বাজারকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছিলেন, যা ছিল সবার থেকে আলাদা। তার কাজের দ্বিতীয় আর কেউ তৈরি হয়নি আজও। প্রয়াত সেলিম আহমেদকে আন্দোলনের বাজারের সকল কর্মী আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া কম থাকলেও তিনি ছিলেন এক অসাধারণ প্রতিভাবান ব্যক্তি। তার সৃজনশীলতা দৈনিক আন্দোলনের বাজার পত্রিকাকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছিল, যা ছিল অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তার ডিজাইন ছিল এতটাই ব্যতিক্রমী যে, তার মতো দ্বিতীয় আর কেউ তৈরি হয়নি। সেলিম আহমেদ আজ দীর্ঘ বছর প্রয়াত, কিন্তু তার সৃষ্ট কর্মের কথা আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন আন্দোলনের বাজারের সকল কর্মীবৃন্দ।
কুষ্টিয়া শহরের বাইরে থেকে অনেকেই ভালো কাজ করেছেন, এরমধ্যে রয়েছেন- দৌলতপুর থেকে এসআর সেলিম ও শরিফুল ইসলাম, মিরপুর থেকে আসাদুজ্জামান বাবু, আমলা থেকে কাঞ্চন কুমার হালদার, কুমারখালী থেকে সোহেল হাবীব, খোকসা থেকে মনিরুল ইসলাম মাসুদ, মেহেরপুর থেকে নুহু বাঙালি, আলমডাঙ্গা থেকে শাহ আলম মন্টুসহ আরো অনেকে। এমন আরো অনেকের নাম রয়েছে, যারা আন্দোলনের বাজারকে শীর্ষে নিয়ে যেতে নিরসভাবে কাজ করে গেছেন। আরো অনেকের নাম অজানা রয়ে গেছে। কুমারখালীর প্রবীণ সাংবাদিক বকুল চৌধুরী আন্দোলনের বাজার পত্রিকা প্রকাশনার শুরুর দিকে উৎসাহ দিয়ে গেছেন।
দৈনিক আন্দোলনের বাজার পত্রিকার জন্ম হয়েছিল প্রখ্যাত সাপ্তাহিক ইস্পাত পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আলহাজ্ব ওয়ালিউল বারী চৌধুরীর উত্তরাধিকার হিসেবে মনজুর এহসান চৌধুরীর হাত ধরে। যখন অন্যান্য পত্রিকা লেটার প্রেসে ছাপা হতো, তখন মনজুর এহসান চৌধুরী কুষ্টিয়ার মানুষকে আধুনিক পত্রিকার মুখ দেখান। আন্দোলনের বাজার আজও কুষ্টিয়ার বুকে একটি অত্যাধুনিক পত্রিকা হিসেবে শীর্ষে তার নাম ধরে রেখেছে।
ইস্পাত পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রয়াত আলহাজ্ব ওয়ালিউল বারী চৌধুরীর উত্তরসূরি হিসেবে মনজুর এহসান চৌধুরীর হাত ধরেই আন্দোলনের বাজারের জন্ম। লেটার প্রেসে ছাপা হওয়া অন্যান্য পত্রিকার ভিড়ে দৈনিক আন্দোলনের বাজারই কুষ্টিয়ার মানুষকে প্রথম আধুনিক পত্রিকার স্বাদ দেয়। এটি কেবল কুষ্টিয়ার বুকে একটি অত্যাধুনিক পত্রিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেনি, এটি আজও সবার শীর্ষ একটি নাম।
দৈনিক আন্দোলনের বাজারের ৩৪ বছর পূর্তি এই সুবর্ণযাত্রা স্মরণীয় হয়ে থাক। এই পত্রিকা কুষ্টিয়ার মাটি ও মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে আগামী দিনেও তার গৌরবময় পথচলা অব্যাহত রাখুক। এই দীর্ঘ পথচলায় পত্রিকাটি কুষ্টিয়ার সাংবাদিকতা ও সমাজজীবনে এক গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। এটি কেবল একটি পত্রিকা নয়, বরং কুষ্টিয়ার মানুষের কণ্ঠস্বর, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। কুষ্টিয়ার সাংবাদিকতার এই আলোকবর্তিকা আগামী দিনেও তার উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে দিক, দৈনিক আন্দোলনের বাজার দীর্ঘজীবী হোক!
১৯১ বার পড়া হয়েছে