সুবর্ণ জয়ন্তীর সূর্যতলে-আমার চোখে ‘ইস্পাত’ পত্রিকার পঞ্চাশ বছরের গল্প
সোমবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২৫ ৪:৩৩ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
২০২৫ সালের ১৭ নভেম্বর। আজ ইতিহাসের পাতায় ছাপার অক্ষরে, কুষ্টিয়ার সংবাদ-রাজ্যে, স্বপ্ন আর সংগ্রামের ৫০ বছর পূর্ণ করলো সাপ্তাহিক ‘ইস্পাত’।
এই দিনটি আমার কাছে নিছক একটি প্রতিষ্ঠানের বছরে নয়, বরং ব্যক্তিগত যাত্রা, মূল্যবোধ আর ন্যায়ের শিক্ষা—সবকিছুকে ধরে রাখা এক মহাসমুদ্র। কারণ, ‘ইস্পাত’ ছিল আমার সাংবাদিকতার প্রথম ইনস্টিটিউট—যেখানে আমি শিখেছি, কীভাবে সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে হয়।
জন্ম ও বিকাশ: মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী অঙ্গীকার
আমার বাবা ওয়ালিউল বারী চৌধুরী—সাংবাদিকতার অক্লান্ত যোদ্ধা, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আমলে সাপ্তাহিক মশাল, মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘স্বাধীন বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদক, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ‘ইস্পাত’-এর প্রতিষ্ঠাতা। তার হাত ধরেই পত্রিকাটি মাসিক থেকে সাপ্তাহিকে জন্ম নেয় ১৯৭৫ সালে, স্বৈরশাসন আর বাকশালের ঘূর্ণিতে যখন সংবাদপত্র প্রায় নির্বাসিত।
‘ইস্পাত’-এর জন্মকথা মানেই সাহসের গল্প। গণমাধ্যমে সত্যের যোদ্ধার, সমাজের দূরদৃষ্টি, অপরাধ আর দুর্নীতির প্রতিবাদ—সব উঠে আসে তার সম্পাদনায়। বাবার শেখানো সেই নীতিবাক্য আজও মনে গেঁথে গেছে, “নির্ভীক সাংবাদিকের কোনো বন্ধু নেই”—সংবাদকর্মে যার বিপুল অর্থ, তার জন্য ঝুঁকি, আবার তার জন্যই প্রতিষ্ঠার আনন্দরূপ।
ইস্পাত আমার পাঠশালা
আমার কৈশোর, আমার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি হয়েছিল ‘ইস্পাত’-এর দাপ্তরিক পরিবেশে। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে, নজরবন্দী সংবাদ-মধ্যস্থলে, বাবা যখন সকল প্রতিকূলতায় সত্যনিষ্ঠ পত্রিকার শপথ নেন, তখন আমিও সেই আদর্শে গড়ে উঠি। ‘ইস্পাত’-এর ফ্লোরে রিপোর্টার, সাব-এডিটর, ফ্যাক্ট-চেকার—প্রত্যেক পেশা হাতে-কলমে শিখেছি।
স্বৈরশাসন, কঠিন বাকশাল যুগ, পত্রিকা বন্ধের সরকারি হুমকি—সব এগিয়েছে বাবার আদর্শে। কিন্তু সংবাদকর্মে সেটাই ছিল নৈতিক সাহসের শ্রেষ্ঠ পাঠ। নানা জটিলতায়, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের সমস্যায় ‘ইস্পাত’-এর রিপোর্টিং ছিল আমার কঠোর প্রশিক্ষণ, কুষ্টিয়ার গণমানুষের কণ্ঠস্বর।
পঞ্চাশ বছরের অভিজ্ঞতা
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সত্য অনুসন্ধানের বার্তা, দুর্নীতি, অন্যায়, অধিকার লঙ্ঘন বিরুদ্ধে লড়াই, শিক্ষা, সংস্কৃতি, কৃষি, শ্রমজীবী মানুষের খবর, সম্পাদকীয় স্বাধীন মতামত, প্রতিষ্ঠান নিরপেক্ষ, ক্রমাগত সামাজিক দায়বদ্ধতা, নাগরিক ন্যায়ের উদাহরণ।
‘ইস্পাত’-এর পাঠশালায় শিখতে শিখতে বুঝেছি—সংবাদপত্র কেবল খবর নয়, তা ইতিহাস, দৃষ্টিভঙ্গি, জনতার অস্ত্রও। বাবা আমার কাছে শিক্ষক, তাঁর লেখাগুলি ছিল নৈতিক আদর্শের অনন্য দৃষ্টান্ত।
নতুন অধ্যায়ের শুরু: ‘আন্দোলনের বাজার’
‘ইস্পাত’-এর শিক্ষাগার থেকে বেরিয়ে ১৯৯১ সালে আমি যখন নিজের দৈনিক প্রকাশনার স্বপ্ন দেখি, তখন সেই সাহস, সততা, প্রশিক্ষণ—সবই বাবার কাছ থেকে পাওয়া। কুষ্টিয়ার মাটি, কুষ্টিয়ার জন-জীবন, সমাজ-রাজনীতি-কৃষি-শিল্প—সবই তুলে ধরি দৈনিক ‘আন্দোলনের বাজার’-এর পাতায়।
এই পত্রিকার জন্মদিন মানে আধুনিক সাংবাদিকতার জন্য সত্যনিষ্ঠ, নির্ভীক, তথ্যনির্ভর গণমাধ্যম গড়ে তোলার স্বপ্ন। আজ ৩৪ বছরের পথে, আন্দোলনের বাজার কুষ্টিয়া অঞ্চলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য-গণমানুষের পত্রিকা; যেখানে আমার নৈতিক দৃঢ়তা, অনুসন্ধানী চোখ, গৃহীত শিক্ষা বাস্তবে প্রয়োগ করেছি।
গণমাধ্যমে আস্থা গড়ার সংগ্রাম
এই অঞ্চলে গণমাধ্যমে ‘আন্দোলনের বাজার’-এর বিস্তার জড়িয়েছে বহু চ্যালেঞ্জ। প্রশাসনিক চাপ, স্থানীয় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ঝুঁকিপূর্ণ রিপোর্ট, মিথ্যে মামলার মুখোমুখি—সবই পেরিয়ে চলেছি বাবার আদর্শে। সত্যের কাছে আপোস নয়—এই আলোকধারা আজ আমার এগিয়ে চলা।
এমন সংগ্রামে ‘ইস্পাত’-এর স্মৃতি যেন আমার নৈতিক রক্ত। সমাজের কল্যাণ, নির্যাতিতের পক্ষে, তথ্য যাচাই, সাহিত্য-সংস্কৃতির সম্মান—সব ক্ষেত্রেই আন্দোলনের বাজার পাঠকের আস্থার প্রতীক।
পাঠক, সমাজ ও ভবিষ্যৎ
‘আন্দোলনের বাজার’ পত্রিকার বড় অর্জন, পাঠক-সম্পৃক্ততা, সাংবাদিকতার উদ্ভাবনী রূপ, ইনডিপেন্ডেন্ট রিপোর্টিং—সবই ‘ইস্পাত’-এর আদর্শের উত্তরাধিকার। আর আজ যখন ‘ইস্পাত’ সুবর্ণ জয়ন্তী কুষ্টিয়ার সাংস্কৃতিক ও সাংবাদিক মহলে গর্ব, তখন ‘আন্দোলনের বাজার’—আমার সাংবাদিকতা-কর্মের দ্বিতীয় অধ্যায়—এলাকার গণ-আস্থার স্বীকৃত গণমাধ্যম।
ইতিহাস, উত্তরাধিকার ও নবদিগন্ত
পিতার হাতে গড়া ‘ইস্পাত’, আমার হাতে গড়া ‘আন্দোলনের বাজার’; দু’টি পত্রিকা আমার জীবনের দুই অধ্যায়, দুই অভিষেক।
এই সুবর্ণ জয়ন্তীতে আমার কাছে ‘ইস্পাত’ মানে সাহস, সততা ও সংগ্রামের শিক্ষাগৃহ; ‘আন্দোলনের বাজার’ মানে–সেই শিক্ষার বাস্তব প্রয়োগ, কুষ্টিয়ার মানুষের মুখপাত্র।
বাবার প্রতিষ্ঠার বিশাল ছায়া পেরিয়ে—বেসামরিক, নির্ভীক, মুক্তপ্রাণ সাংবাদিকতায় ‘ইস্পাত’-এর আলোকস্বপ্ন নতুন আঙ্গিকে, অনুভবে, কণ্ঠে… এগিয়ে চলেছে ‘আন্দোলনের বাজার’-এর মাধ্যমে। ভবিষ্যতে সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতা, মানুষের অধিকারের পক্ষে, পাঠক-সমাজের আশ্বাসে–আমার যাত্রা যেন বারবার ফিরে যায় সেই ‘ইস্পাত’-এর ‘শিকড়ে’।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
১৮২ বার পড়া হয়েছে