সর্বশেষ

ফিচার

গাঁজা থেকে ইয়াবা: বাংলাদেশে মাদক নীতি ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা

মনজুর এহসান চৌধুরী
মনজুর এহসান চৌধুরী

মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২৫ ৪:৪৯ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
গাঁজা—বৈজ্ঞানিক নাম মারিজুয়ানা। বহু বিশেষজ্ঞের মতে এটি শুধু নেশা দ্রব্য নয়, বরং এক ধরনের ওষুধ। গত কয়েক দশকে চিকিৎসায় এটির ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে মৃগী, ক্যান্সারের ব্যথা, মানসিক রোগ, উদ্বেগ-ডিপ্রেশনের জন্য।

কিন্তু একই সঙ্গে এটি নেশার উপকরণ হিসেবেও বিতর্কিত। মন-মস্তিষ্কে সরাসরি প্রভাব ফেলায় ব্যক্তি ও সমাজে নানা দ্বিধা-সংঘাত দেখা দিয়েছে।

বৈধতার বিশ্বপর্যায়ের চিত্র
কানাডা, উরুগুয়ে, যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক রাজ্য, মাল্টা, জার্মানি, থাইল্যান্ড, স্পেন, পর্তুগাল প্রভৃতি দেশে গাঁজা আংশিক বা সম্পূর্ণ বৈধ করা হয়েছে—বিশেষত চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রিত ব্যক্তিগত ব্যবহারের ক্ষেত্রে।
কানাডা: ২০১৮ সালে একসঙ্গে বিনোদন ও চিকিৎসাজনিত ব্যবহারের জন্য বৈধ করা হয়। এখানে সরকার গাঁজার উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, ও কর আদায়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করছে; আগে যে অবৈধ বাজার ছিল, তা সরাসরি বৈধ রাজস্বের উৎসে পরিণত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র: ফেডারেল স্তরে অবৈধ হলেও ক্যালিফোর্নিয়া, কলোরাডো, নিউইয়র্কসহ বিভিন্ন রাজ্যে গাঁজা আইনসম্মতভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বৈধতা দেয়ার প্রধান কারণগুলো—অর্থনৈতিক রাজস্ব, চোরাকারবার বন্ধ, ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার সুযোগ বাড়ানো।

স্বাস্থ্যঝুঁকি ও চিকিৎসায় ব্যবহারের দিক
গাঁজার পর্যাপ্ত ব্যবহারে মৃগীরোগ, উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, ক্রনিক ব্যথা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ওষুধ হিসেবে সুফল পাওয়া যায়। তবে অপব্যবহার বা অত্যাধিক সেবনে স্মৃতিভ্রংশ, মানসিক অস্থিরতা, উদ্বেগ-বিষণ্ণতা, একঘেয়েমি ও আসক্তির ঝুঁকি রয়েছে। পৃথিবীর যে দেশগুলো বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেয়—তারা “নিয়ন্ত্রিত চিকিৎসা-ব্যবহার” অথবা “অর্থনৈতিক ও জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তা”র যুক্তিতে গাঁজার বৈধতা দিয়েছে।
চিন্তাভাবনায় একটা বড় পরিবর্তন এসেছে—গাঁজা সিগারেটের মতো ক্ষতিকর নয় (তাতে ক্যান্সারের প্রবণতা কম), কিন্তু সব দেশের সরকার সতর্কতামূলক স্বাস্থ্য বার্তা গাঁজার প্যাকেটে বাধ্যতামূলক করেনি।

বাংলাদেশে গাঁজা নিষিদ্ধ হওয়ার পটভূমি
বাংলাদেশে ব্রিটিশ আমল ও পাকিস্তান পর্বে সরকারি অনুমোদনে গাঁজা চাষ ও বিক্রি হতো; নওগাঁর গাঁজা সমিতি পুরো জেলার অর্থনৈতিক ভরকেন্দ্র ছিল এবং হাজারো মানুষের কাজ, শস্য, রাজস্ব, সরকারি উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য ছিল।
১৯৮৭ সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে গাঁজা পুরোপুরি নিষিদ্ধ হয়—এরশাদ সরকারের সময়ে। সরকার যুক্তি দিয়েছিল, গাঁজার কারণে মাদকাসক্তি বাড়ছে, সামাজিক অবক্ষয় বাড়ছে। কিন্তু গবেষণা-পরিসংখ্যান বলছে, গাঁজা নিষিদ্ধ হওয়ার পর নওগাঁসহ বহু এলাকা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে এবং দেশে অবাধে মারাত্মক মাদক প্রবেশ করে—হেরোইন, ফেনসিডিল, ইয়াবা, আইস, এলএসডি ইত্যাদির দ্রুত বিস্তার ঘটে।

গাঁজা বনাম মারাত্মক মাদক: অপরাধ ও সামাজিক ক্ষতি
গাঁজা সেবনকারীর অপরাধ: বাংলাদেশে গাঁজার সেবন, বহন, ক্রয়-বিক্রয় আইনত দণ্ডনীয়; কিন্তু বড় অপরাধে যুক্ত হওয়ার প্রবণতা কম। কোনও কোনও উৎসবে বা লোকজ সংস্কৃতিতে সীমিত ব্যবহারে সামাজিক চাপে পড়ে অপরাধ সংঘটিত হয় না।
হেরোইন, ইয়াবা, ফেনসিডিল সেবনকারীর অপরাধ: চুরি, ছিনতাই, নারী-শিশু নির্যাতন, হত্যা, পরিবার ভাঙন, অর্থ পাচার, জঙ্গিবাদে অর্থ জোগান, সংঘবদ্ধ অপকর্মের আয়, গুরুতর মানসিক ও দেহগত ক্ষতি। পুনর্বাসন কেন্দ্রের ব্যয়, দেশের স্বাস্থ্যখাতে চাপ, স্কুল-কলেজ থেকে ঝরে পড়া, সমাজবিরোধিতা বৃদ্ধি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন—গাঁজা নিষিদ্ধ করলে বাজারের শূন্যতা পূরণ করতে আরো মারাত্মক মাদক দ্রুত প্রবেশ করে, ফলে অপরাধ বাড়ে, জনস্বাস্থ্য বিনষ্ট হয়।

আইন, সমাজ ও আন্তর্জাতিক শিক্ষা
বাংলাদেশে গাঁজার বিরুদ্ধে কঠোর আইন, প্রচুর পুলিশি অভিযান ও আদালত ব্যবস্থা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, সরকারি অফিস—গাঁজা সেবনে বহিষ্কার, জরিমানা; উল্টো দিকে ইয়াবা/হেরোইনে জেল, মামলার হার হাজারে হাজার।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলো অপরিকল্পিতভাবে কম ক্ষতিকর পদার্থ নিষিদ্ধ না করে গবেষণা, নিয়ন্ত্রণ, চিকিৎসা-ব্যবহার, এবং কর ব্যবস্থার মাধ্যমে অধিক মারাত্মক মাদক প্রবাহ সীমিত করতে পেরেছে।

এখন যা করণীয়
বাংলাদেশে একসময় বৈধ গাঁজার আয় ও গ্রামীণ অর্থনীতির চিত্র বদলে গেছে নিষেধাজ্ঞা, সামাজিক নির্মাণ, ও মারাত্মক মাদক প্রবাহের কারণে। আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, বিষাক্ত মাদক দ্রুত সমাজ, পরিবার, স্বাস্থ্য ও দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এখন প্রয়োজন বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা, সামাজিক সচেতনতা, স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা, আধুনিক নীতি সংস্কার—সব মিলিয়ে বাংলাদেশের মাদক সমস্যার সমাধান।


লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ।

১৪৪ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
ফিচার নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন